মন পড়া

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এই নিয়ে ব্যাপারটি তৃতীয়বারের মতো ঘটল। এর আগের দুবারের চেয়ে এবারের ব্যাপারটি একটু ভিন্ন রকম। সাবরিনা ওর সামনে বসে থাকা পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী মানুষটার মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আস্তে আস্তে সে পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছে। প্রথমবার যেটা ঘটেছিল ওটা সাবরিনার কাছে নিছক একটা স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার অনেক পরে সে আসলে বুঝতে পেরেছে ওটা স্বপ্ন ছিল না। অন্য একজনের মন বা চিন্তা ওর মনকে গ্রাস করছিল। ওই অল্প সময়টাতে যা কিছু ভেবেছে সবই ছিল সামনে বসে থাকা মানুষটার চিন্তা-ভাবনা। ওই সময়টাতে নিজের ভাবনার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু নিজের মনের সত্তা এবং সামনে বসে থাকা আরেকজনের মনের সত্তাকে সাবরিনা খুব সহজেই আলাদা করতে পারে। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শারীরিকভাবে বিষয়টা খুব একটা সুখপ্রদ নয়। মাথায় প্রচণ্ড একটা পেইন দিয়ে ব্যাপারটা শুরু হয়। এরপর কয়েক মিনিট গভীর একটা ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া এবং স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করা। সেই স্বপ্নটা আসলে সামনে বসে থাকা মানুষটার মনের মধ্যে ঢুকে তার ওই সময়ের সমস্ত ভাবনার গভীরে প্রবেশ করা।

একটা ব্যাপারে সাবরিনার এখনো নিজের ওপরে কন্ট্রোল নেই। সেটা হলো এই মন পড়ার জগতে বিচরণ কতক্ষণ স্থায়ী হবে। প্রথমবার খেয়াল না করলেও দ্বিতীয়বারে সে খেয়াল করেছে। মাত্র দুই থেকে তিন মিনিট। মজার ব্যাপার হলো, এই অল্প সময়ে মানুষ কত কী যে ভাবে। নিজেকে দিয়ে কখনোই বুঝতে পারেনি সাবরিনা। মানুষের চিন্তা শক্তি যে কতটা ব্যাপক সেটা সাবরিনা এই বিষয়টি অর্জন না করলে কোনো দিনই বুঝতে পারত না। গত কয়েক দিনে সে অনেক ভেবেছে, অনেক পড়ালেখা করেছে এই বিষয়টা নিয়ে। মনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সে যেটা পেয়েছে তা হলো মানুষের মন হলো তার নিজস্ব চেতনা, উপলব্ধি, চিন্তাভাবনা, জাজমেন্ট ও মেমোরি এসবের সমন্বয়ে একটি অসীম, বহুমুখী এবং সীমাহীন জ্ঞানীয় অনুষদ। যা কল্পনা, স্বীকৃতি এবং সমৃদ্ধির শক্তি ধারণ করে, যা অনুভূতি ও আবেগ প্রক্রিয়াকরণের জন্য দায়ী, যার ফল মনোভাব ও কর্মের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। জটিল বিষয়ের সংজ্ঞায়ন সহজ নয় আর তাই মনের সংজ্ঞায়ন ও সহজ নয়।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সাবরিনা কোনোভাবেই তার এই অন্য আরেকজনের মনোজগতে প্রবেশ করতে পারার বিষয়টার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো খুঁজে পায়নি। কিছু কিছু ব্যাপার সে আগে থেকেই জানত যেমন, এম্প্যাথিক অ্যাকুরেসি, এম্প্যাথিক ইন্টারফেরেন্স এই সব। কিন্তু এই বিষয়গুলোর কোনোটাই ঠিক বিজ্ঞানসম্মতভাবে স্বীকৃত নয়। সামাজিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এম্প্যাথিক অ্যাকুরেসি হলো একধরনের জটিল মনোবৈজ্ঞানিক সত্তা যেখানে নিজের অবজারভেশন, মেমোরি, জ্ঞান, যথাবিহিত কারণ এসবের সমন্বয়ে অন্যের চিন্তার গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করা। কিন্তু সাবরিনার ক্ষেত্রে যেটা ঘটছে সেটাকে হয়তো শুধু মাত্র বৈজ্ঞানিকভাবেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
এই মন পড়তে পাড়ার বিষয়টি তো খুব একটা বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। মাত্র তিন সপ্তাহ। এরই মধ্যে ঘটে গেছে তিনবার। তার দুবারই ঘটেছে নিজের অজান্তে। এইবার যেটা ঘটছে সেটা তার ইচ্ছেতেই হচ্ছে। তার মানে হলো সাবরিনা ইচ্ছে করলেই এখন কারও মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। সেই ব্যক্তি কী ভাবছে, কী পরিকল্পনা করছে, কোন স্মৃতি রোমন্থন করছে—তার সবকিছুই বুঝতে পারে। ব্যাপারটি আগের দুবারে কিছুটা হলেও ভয়ের ব্যাপার ছিল কিন্তু এবার ওর কাছে আর ভয় লাগছে না। ইচ্ছে করেই সামনের বসে থাকা মানুষটার মনে ঢুকে পড়েছে শুধুমাত্র খেয়ালের বসে, কী ভাবছে এই লোকটা।
অনেকভাবে চিন্তা ভাবনা করে সাবরিনা শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টির কারণ হিসেবে একমাত্র সিটি স্ক্যানকেই দায়ী করতে পারে। কিন্তু সেটা তো করা হয়েছিল প্রায় আট মাস আগে। দীর্ঘ চার বছর ধরে মাইগ্রেনের পেইনে ভোগার পরে যখন কোনোভাবেই এই ব্যথা যাচ্ছিল না ডাক্তার ওকে সিটি স্ক্যান করার জন্য রেফার করে। যদিও সিটি স্ক্যান করে কোনো অ্যাবনর্মালিটি পাওয়া যায়নি এবং ওষুধেরও পরিবর্তন হয়নি তাই সিটি স্ক্যান করে আসলে কোনো লাভ হলো না। কিন্তু ব্রেনের সিটি স্ক্যানের কারণেই সাবরিনার এই মন পড়তে পাড়ার বিষয়টি আয়ত্তে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। সেখানেই যত ভয় সাবরিনার।
ডাক্তার প্রথমে বলছিলেন এমআরআই করতে। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সিটি স্ক্যান করতে বলেন। সিটি স্ক্যানে যেহেতু রেডিয়েশন ব্যবহৃত হয়, হয়তো রেডিয়েশনের রেটের হেরফের অথবা অধিক সময় রেডিয়েশনের এক্সপোসারের কারণেও হতে পারে। আর যে লোকটি স্ক্যান করেছে তাকেও খুব একটা এক্সপার্ট মনে হয়নি সেদিন। যেদিন মনে হয়েছে সিটি স্ক্যানের কারণেই এটা হতে পারে তখন থেকেই বেশ পড়ালেখাও করেছে সাবরিনা। বেশ কয়েকটা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ভিত্তিক সিনেমাও দেখেছে। যেমন দ্য মাইন্ড রিডার, দ্য স্কাইস্ক্রেপার সোলস, আকিরা ইত্যাদি। এসব দেখতে গিয়ে সাবরিনা টেলিকাইনেসিস বা সাইকোকাইনেসিস এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনেছে। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি সব থেকেই আলাদা।
মুভির বিষয়গুলোকে দিন শেষে নিছক কল্পনাই মনে হয়েছে। আর টেলিকাইনেসিস বা সাইকোকাইনেসিস তো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কোনো কারণ ছাড়া যে এটা হচ্ছে না সে ব্যাপারে এখন মোটামুটি নিশ্চিত সাবরিনা। কারণ জীবনে কখনোই সে এমন কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়নি। এমনকি এই ধরনের কোনো চিন্তাও মাথায় আসেনি। এই কদিনে অনেকবার ভেবেছে ডাক্তারের কাছে যাবে কিন্তু পরে ভেবেছে নাহ এই বিষয়টি নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া এখনই ঠিক হবে না। প্রথমত ডাক্তার বিশ্বাস করবেন না। দ্বিতীয়ত করলেও অযথা একগাদা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেবেন, ফলাফল কী হবে সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেষে কিনা সবাই পাগলি উপাধি দেবে।
এই মুহূর্তে যে লোকটির মনে সাবরিনা ঢুকেছে লোকটি সাবরিনার পরিচিত নয়। ডাক্তারের অপেক্ষমাণ কক্ষে বসে আছে। লোকটিও ডাক্তারের কাছে এসেছে নিশ্চয়ই। নিজের জন্য নাকি অন্য কারও জন্য সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ সাবরিনা মাত্র ডাক্তারের অপেক্ষমাণ কক্ষে ঢুকেছে। লোকটা এসেছে আরও আগে। লোকটার বয়স আনুমানিক ৫৫ হবে হয়তো। বেশিও হতে পারে। এদের বয়স বোঝা মুশকিল। লোকটি চুপচাপ বসে আছে। কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। লোকটি যে কানাডিয়ান সে ব্যাপারে নিশ্চিত। এই মানুষটির মাথায় না ঢুকলে সাবরিনা বুঝতই না একজন মানুষ কত অল্প সময়ে কত দ্রুত কত কী চিন্তা করে। মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিধি কত ব্যাপক। মাত্র দুই মিনিটে এই মানুষটি একটা মুখের কথা ভেবেছে অন্তত এক শ বার। কি দ্রুততার সঙ্গে লোকটি তার অতীতে ফিরে যাচ্ছে। সাবরিনা ভাবার চেষ্টা করেছে যে মুখটি এই মানুষটির মনে এতবার এসেছে সেই মানুষটা কে? হয়তো তার স্ত্রী, গার্লফ্রেন্ড? অথবা অন্য কেউ। এরই মধ্যে লোকটি তার ভাবনায় তার সন্তানদের কাছে চলে গেল। বাবা মার কাছে। লোকটি কাজ করে, সে একজন স্ট্রাকচারাল প্রকৌশলী মনে হচ্ছে কারণ বারবার সে দ্রুত সে তার কর্মক্ষেত্রে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ সাবরিনা তার আপন সত্তায় ফিরে আসে। একজন ভদ্রমহিলা এসে লোকটিকে ডাকছে, ‘লেটস গো’, আর তখনই সাবরিনার ওই লোকটির মস্তিষ্কে বিচরণ থেমে যায়।
এখন সাবরিনা বুঝতে পারছে দ্বিতীয় কোনো সত্তায় ঢুকতে হলে একটা বিশেষ পরিবেশ লাগবে। সেখানে বিচরণ কতটা স্থায়ী হবে তাও নির্ভর করবে চারপাশের পরিবেশের ওপরে। আবার মজার ব্যাপার হলো দূর থেকে কারও মনে সে প্রবেশ করতে পারছে না। সেটা পারলে ভালোই হতো। দেশে ফেলে আসা অনেক মানুষ কখন কী ভাবছে সেটাও জানা যেত। যার মনে প্রবেশ করবে তাকে চোখের সামনেই থাকতে হবে। অন্তত দু-একবার চোখে চোখ পড়তে হবে। এই জন্যে ইচ্ছে করলেই সাবরিনা কারও মনে প্রবেশ করতে পারছে না। অন্যের মন পড়ার বিষয়টি সে আজকাল একটু একটু এনজয় করতে শুরু করেছে। দারুণ মজার একটা ব্যাপার। অন্য একজন মানুষ তাকে নিয়ে কী ভাবছে অথবা সেই মানুষটিই কী ভাবছে, সেটা বুঝতে পারা এ এক অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেকের মনপড়া হয়ে গেছে সাবরিনার। অভিজ্ঞতা মজার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা সুখকর না। আশপাশের অনেক মানুষই তাকে নিয়ে কী সব ভাবছে অথচ দেখা হলেই মুচকি হাসি দিয়ে কী মধুর ব্যবহার। কিন্তু ভেতরে কীসব জটিল কুৎসিত ভাবনা। যদিও সবার ক্ষেত্রে এক নয়। ওর সম্পর্কে যে মানুষটির ভাবনা সবচেয়ে সুন্দর সেটা হলো ওর সহকর্মী মারিয়া। ল্যাটিন আমেরিকান এই মেয়েটির মন এতটাই স্বচ্ছ যে মাঝে মাঝে সাবরিনার মনে হয়েছে, সবার মন যদি মারিয়া মেয়েটার মতো হতো।
কেন জানি সাবরিনা এখন পর্যন্ত একবারও রাশেদের মনে ঢোকেনি। ঢুকতে চেয়েছে অনেকবার কিন্তু নিজেই থেমে গেছে। ভয়ে। যে মানুষটিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, সংসার করছে, ওদের একমাত্র ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান রয়েছে, ওর নাম শায়ান। রাশেদ সাবরিনার জন্য কি না করেছে। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত। দেশে থাকতে রাশেদ সাবরিনাকে কখনো কাজ করতে দেয়নি। বলেছে সাবরিনা কোনো কষ্ট করুক এটা তার সহ্য হয় না। বিদেশে আসার পরে অনেক দিন সেই ভাবনায় থাকলেও শেষাবধি সাবরিনাকে কাজে ঢুকতেই হয়েছে। এখানে কাজ করতেই হয়। সেটা অনেক কারণেই। সাবরিনার কাছে রাশেদ একটু জটিল ধরনের মানুষ। কিন্তু প্রচণ্ড দায়িত্বশীল। রাশেদের অনেক বন্ধুবান্ধব। সেই তুলনায় সাবরিনার বন্ধু কম। বন্ধু মহলে কিংবা কোনো বাসায়, পার্টিতে গেলে রাশেদই বেশি কথা বলে, সবাইকে মাতিয়ে রাখে। সাবরিনাকে কেউ কেউ মুডি বলে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। ও আসলে কমফোর্ট ফিল করে না। যে যাই বলুক, কী আসে যায়। ওরা তো সুখী। রাশেদ মাঝে মাঝে ছোটখাটো ব্যাপারে ঝগড়া করতে চায়, হয়তো সেটা নিছক ঝগড়ার জন্যই। সাবরিনা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। ভাবে ঝগড়া করে লাভ কী। শুধু শুধু সাময়িক অশান্তি টেনে আনা। তার চেয়ে সেই সময়টাকে কোনোভাবে উপভোগ করলেই ভালো। সাবরিনা আসলেই খুব ভয় পায় রাশেদের মনের মধ্যে ঢুকতে। কী জানি যদি আবার এমন কিছু পেয়ে যায় যেটা হয়তো সাবরিনার ভালো নাও লাগতে পারে। এটা কী অবিশ্বাস থেকে? না রাশেদকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না।
তবে হ্যাঁ, ও প্রায়ই ইচ্ছে করেই ছেলে শায়ানের মগজে ঢুকেছে। জাস্ট কৌতূহলের বশে। চার বছর বয়সের একটি বাচ্চা ছেলে আসলে কী ভাবে। খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেছে যে সময়টুকু সে শায়ানের মগজে ছিল শুধুমাত্র তিনটা মুখচ্ছবির চেহারা ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পায়নি। বেশির ভাগ সময় জুড়ে শুধু নিজের চেহারাকেই দেখেছে। কিছুটা সময় জুড়ে ছিল রাশেদ আর কিছুটা সময় পাশের ইউনিটের ছোট্ট ছেলেটি যার সঙ্গে শায়ান প্রতিদিনই খেলে। মাঝে মাঝে দুই একটা কার্টুন ছবির খণ্ডচিত্র ঠিক যে অংশগুলো শায়ান সারাক্ষণ দেখতে চায়। বয়স্ক মানুষদের মতো শায়ানের ভাবনা অত বেশি ফ্লাকচুয়েট করে না। একটা জায়গায় এসে অনেকক্ষণ স্থির থাকে। ঠিক স্লাইড শোর মতো, স্লো কিন্তু স্টেডি। বয়স্কদের ভাবনাগুলো কেমন দ্রুত ফাস্ট ফরওয়ার্ড অথবা রিভার্স ফরওয়ার্ড মুভির মতো। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম।
ওর কাজের জায়গায় কফি ব্রেকের সময় একজন বয়স্ক মানুষের মগজে ঢুকে প্রথমদিকে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছি সাবরিনা। লোকটা কফি খাচ্ছে আর কত দ্রুত তার শৈশব, কৈশোর, ফেলে আসা কত জায়গায় চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। একটু পরেই খেয়াল করল লোকটি সাবরিনাকে নিয়েই ভাবছে। একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল লোকটি এরপর কী ভাবতে শুরু করে। লোকটি তার নিজের মেয়ের সঙ্গেই সাবরিনাকে তুলনা করছে। সেই মেয়েটিকেও দেখতে পাচ্ছে সাবরিনা। কত বার সজোরে জড়িয়ে ধরে বাবা মেয়েকে আদর করছে। এরপর নিজের সত্তায় চলে আসে সাবরিনা।
এই লোকটিকে সে প্রায়ই দেখে এখানে। নিজের অফিসের পাশে কফি শপ। কফি ব্রেকে এলে মাঝে মাঝে এই লোকটিকে দেখে সে। এরপর থেকে লোকটিকে দেখে তার কেমন যেন অন্য রকম এক অনুভূতি চলে আসে। ইচ্ছে করে লোকটির আরও কাছে গিয়ে বসতে। জিজ্ঞেস করতে কী তার দুঃখ। কোথায় থাকে তার মেয়েটি? সাবরিনা বাবাকে হারিয়েছে অনেক আগে। বাবাকে খুব মিস করে সে। সামনের টেবিলে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটির মধ্যে সে বাবাকে খুঁজে পায়।
অন্যের মনন সত্তায় ঢুকে যে সব সময় সুখকর কিছু খুঁজে পেয়েছে তা কিন্তু নয়। একদিন তার নিজের অফিসের ম্যানেজারের মগজে ঢুকে তো সে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। লোকটিকে দেখে একটুও বোঝার উপায় নেই যে, ভেতরে ভেতরে তার চিন্তা ভাবনা এতটা খারাপ। কতটা রুক্ষ লোকটা।
সাবরিনার মাথা ব্যথা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে ডাক্তার দেখিয়েছে কয়েকবার। কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দুই মাসে ওষুধ বদল করা হয়েছে দুবার। ডাক্তার এখন এমআরআই-এর কথা ভাবছে। সাবরিনা এই ধরনের যেকোনো টেস্ট করাতেই ভয় পাচ্ছে এখন। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে রাশেদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু রাশেদ কী ভাববে। পাগল ভাববে নাতো? ভাবলে ভাবুক। কিছু করার নেই। যা সত্যি তাই। রাশেদকে না জানিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না।
অনেক ভেবেচিন্তে সাবরিনা রাশেদকে কথাটি বলতে শুরু করে। রাশেদ প্রথমে বড় বড় চোখ করে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকে। শুধু বলে, কি বলতেছো এসব?
সাবরিনা বলে, হ্যাঁ যা বলছি তার সব সত্যি।
তোমার বিশ্রাম দরকার, রাশেদ বলে।
রাশেদ, আমি যথেষ্ট বিশ্রামে আছি, তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো প্লিজ।
রাশেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, চলো ডাক্তারের কাছে যাই?
ডাক্তারকে ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না, সাবরিনার অভিযোগ।
পরে দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় ফ্যামিলি ডাক্তারের সঙ্গে আগে কথা বলবে।
ভদ্রমহিলা ভারতীয়। গভীর মনোযোগের সঙ্গে সাবরিনার কথাগুলো শোনেন। সাবরিনার সমস্ত হিস্ট্রি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সামনের কম্পিউটারের মনিটরে। মুচকি হেসে ড. সাক্সেনা জিজ্ঞেস করেন, তুমি আসলে কীভাবে আরেকজনের মনে প্রবেশ করো?
সাবরিনা পুরো ব্যাপারটি খুলে বলে।
তুমি যে আরেকজনের মনের মধ্যে ঢুকেছিল সেটা তুমি শিওর হলে কীভাবে? সাক্সেনা জিজ্ঞেস করেন।
আমি নিশ্চিত, কারণ আমি আমার নিজস্ব সত্তা এবং অন্যের সত্তাকে আলাদা করতে পারি, সাবরিনার উত্তর।
—ওয়েল, তুমি কি আমার মাইন্ড এখন রিড করতে পারবে?
সাবরিনা একবার রাশেদের দিকে আরেকবার ডাক্তারের দিকে তাকায়, এরপর বলে পারব।
—ইস ইট পসিবল অ্যাট অল? হাসি মাখা মুখে ডাক্তারের প্রশ্ন।
—ইয়েস অ্যাবসলুটলি পসিবল।
—ওকে, লেটস সি, গেট ইনটু মি।
সাবরিনা গভীরভাবে ডাক্তারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর দুই মিনিট। সাবরিনা আপন সত্তায় ফিরে আসে।
—কি দেখলে? কি পেলে তুমি আমার মনে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন।
সাবরিনা শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়। এই মুহূর্তে তোমার মন খুবই শান্ত, ফোকাসড আমার দিকে। কিন্তু তার পাশাপাশি তোমার মনে যা যা ঘটছে এবং তুমি যা ভাবছ আমি তা জানি। আজ সন্ধ্যায় তোমার বাসায় তুমি ড. দেব এবং তার পরিবারকে দাওয়াত করেছ। তুমি সেটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমি তোমার কল্পনায় ড. দেবের পরিবারকে দেখতে পেয়েছি। তারা সবাই দেখতে কেমন আমি সেটাও দেখেছি। তুমি যদি এই মুহূর্তে আমাকে অনেকগুলো ছবির মধ্যে থেকে তোমার আজকের গেস্টদের খুঁজে বের করে দিতে বলো আমি তা পারব। তুমি তাদের কীভাবে কী কী দিয়ে আপ্যায়ন করবে বলে ভাবছ আমি তাও জানি। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুমি একটি ব্যাপার নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
—কি সেটা?
সাবরিনা রাশেদের দিকে তাকায়। রাশেদ এই প্রথম এয়ার কন্ডিশনড রুমে বসে অনবরত ঘামতে থাকে।
—তুমি সেটা শুনতে চাও?
—হমম, বলো।
—তুমি ড. ইসাবেলার হাজব্যান্ড, ড. দেবকে নিয়ে খুবই ওরিড। তুমি তাকে পছন্দ করো। ইনফ্যাক্ট ইউ আর ইন লাভ উইথ হিম। এইটুকু বলে সাবরিনা থেমে যায়।
এবার ড. সাক্সেনা ঘামতে শুরু করেন। তাকে খুবই বিচলিত মনে হয়।
তিনি হাসিমুখে বলেন, তুমি এসব কি বলছ? কীভাবে জানো? আর ইউ অল রাইট?
—আমি সত্যিই বলছি। আমি জানতাম না, তোমার মাইন্ড রিড করে এখন জেনেছি।
—ইম্পসিবল! ড. সাক্সেনা বিস্মিত, কিছুটা বিব্রত।
—নো ইটস পসিবল ফর মি।
—আর ইউ স্টিল রিডিং মাই মাইন্ড?
—নো, আই ক্যান্ট।
নিজের চোখের সামনে বসে থাকা এই জলজ্যান্ত সত্যিটাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা ডাক্তার সাক্সেনার নাই। দ্রুত খসখস করে প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন ক্লোনাজেপাম ২০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন ঘুমের আগে, সাত দিন। গম্ভীর মুখে সাবরিনাকে বলেন সাত দিন পরে আবার এসো।
এরপর ১০ দিন পার হয়ে গেছে। সাবরিনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওষুধগুলো খেয়েছে। ঘুম বেড়েছে। ডিজিনেস বেড়েছে। এর মধ্যে মাইন্ড রিডিংয়ের ব্যাপারটি আরও তীব্রতর হয়েছে। আগে যেটা দুই মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যেত এখন সেটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
ড. সাক্সেনা শহরের অনেক নামকরা নিউরোলজিস্ট পিটার জনসনের কাছে সাবরিনাকে রেফার করেছেন। অ্যাডভান্সড এমআরআই করা হলো। পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি করা হলো। মাককোনেল ব্রেইন ইমেজিং সেন্টার, ম্যাকগিল থেকে ল্যাবরেটরি অব নিউরো ইমেজিং (UCLA)-তে পাঠানো হলো। আরও নতুন নতুন গবেষণার দার উন্মোচিত হলো হয়তো সাবরিনাকে নিয়ে। কয়েক সপ্তাহ পরে অবশেষে রাশেদ সাবরিনাকে নিয়ে বিষণ্ন মনে ফিরে এল আপন শহরে।
কী জানি কী হলো সাবরিনার। একদিন খুব ইচ্ছে করল রাশেদের মনোজগতে প্রবেশ করতে। আর সেটাই হলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। রাশেদের মনোজগতে ঢুকে সাবরিনা যা দেখতে পেল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সাবরিনা। কথাটি কোনো দিন বলতেও পারল না রাশেদকে।
আস্তে আস্তে আশপাশের চিরচেনা জগৎটাকে অচেনা মনে হতে থাকে সাবরিনার। কোনো মানুষকেই তার পারফেক্ট মনে হয় না। মানুষ তার ভেতরে আর বাইরে এত আলাদা কীভাবে হয়। পুরুষ মেয়ে বলে কথা নেই, বয়স্ক-কম বয়স্ক কোনো পার্থক্য নাই। কী অদ্ভুত বিচিত্র মানুষের মন। কেন এমন হবে? কেন মানুষ ভেতরে আর বাইরে এক হবে না? নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়, একা একা লাগে। কারও সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে না আজকাল। যে মানুষটি হাসি মুখে কথা বলছে অথচ তার মনটা কত বিশ্রী কত জটিল। এর পাশাপাশি অনেক সুন্দর মনের মানুষও সে পেয়েছে। যাদের মন আর বাইরের আচরণে অথবা বহিঃপ্রকাশে কোনো পার্থক্য নাই। তাই পুরো ব্যাপারটিকে সে কোনোভাবেই জেনারালাইজ করতে পারে না। কেন যে বিধাতা তাকে অন্যের মন পড়ার ক্ষমতাটি দিলেন। কী প্রয়োজন ছিল?
সাবরিনার খুব ইচ্ছে ছিল সুন্দর কিছু মনের সাক্ষাৎ পাওয়ার। সেই মনের গভীরে পৌঁছে তারা কীভাবে এবং কী চিন্তা করে সেটা দেখার। সে পেয়েছে তবে তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। কফি হাউসের ওই বৃদ্ধ লোকটা, যার মন কিছুটা অস্থির কিন্তু ঘুরে ফিরে কয়েকটা জায়গাতেই ঘুরপাক খেতে থাকে। দ্রুত শৈশবে ফিরে যায়, তার বাবা-মার কাছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে, পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে যেখানে সে হয়তো ঘুরে বেরিয়েছে অথবা তার আদরের একমাত্র মেয়ের কাছে। কিংবা হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর দিন গুনতে থাকা ক্যানসারে আক্রান্ত ওই বৃদ্ধা নারী যার মন জুড়ে কেবলই অদেখা স্বর্গের হাতছানি। হয়তো ওই বৃদ্ধা নারীর কোনো পাপবোধ নেই, নেই অনুশোচনা আর তাই সে নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে। তার বিশ্বাস মৃত্যুর পরেই সে স্বর্গের উদ্যানে প্রবেশ করবে। এমনকি ওই নারীর সর্গ নিয়ে যে ভাবনাটা সেটাও অদ্ভুত রকম সুন্দর। এমনটি সে অদ্যাবধি আর কারও মনেই পায়নি। বরং উল্টোটা পেয়েছে। কিছু মানুষ খারাপ কাজ করেছে, তাদের সেই কাজগুলো মনের দর্পণে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হচ্ছে। সেই কাজের জন্য তাকে ফল ভোগ করতে হবে সেটাও ভাবছে, কিন্তু নিজেদের পরিবর্তন করছে না।
সাবরিনা আগে ভাবত ব্যস্ত মানুষের মন হয়তো অনেক জটিলতায় ভরে থাকবে। তার ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে। সাবরিনা দেখেছে অনেক ব্যস্ত একজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তার চিন্তাগুলো কত একমুখী, সহজ। ধীর স্থির শান্ত অচঞ্চল। পক্ষান্তরে বসে থাকা, কাজ না করা মানুষগুলোর মনগুলো কতটা ব্যতিব্যস্ত, জটিল। সাবরিনার ধারণা মাত্র দুই মিনিটে একজন কর্মহীন মানুষের মন যেভাবে ভ্রমণ করে বাস্তবে সেই পথ অতিক্রম করতে একজন মানুষের কয়েক বছর লেগে যাবে। ইস বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা করা যেতে পারত। কিন্তু সাবরিনার এই যে চরম সত্যি একটা বিষয় যা ঘটে চলেছে তা কি কেউ বিশ্বাস করছে? করছে নাতো। ডাক্তাররাই করেননি। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয় তাই করেছে। আর রাশেদ? না, রাশেদ বিশ্বাস করেনি। রাশেদের ধারণা সাবরিনা দিন দিন তার মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। সাবরিনা জানে না এর শেষ কোথায়।
আজকাল খুব ইচ্ছে করে মানুষের মনে ঢুকে যদি তাদের খারাপ চিন্তাগুলোকে বদলে দেওয়া যেত। কিন্তু সাবরিনা তো শুধু অন্য একটি সত্তাকে কাছে থেকে অবজার্ভ করতে পারে তার ওপরে কর্তৃত্ব ফলাতে পারে না। কারণ ওটা তার নিজস্ব নয়।
এরপর আরও কিছুদিন পার হয়ে গেছে। সাবরিনার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে। ঘুম কমেছে। এখন আর সে খুব একটা অন্য কারও মনে প্রবেশ করতে চায় না। সারাক্ষণই ইচ্ছে করে শায়ানের মনের মধ্যে ঢুকে বসে থাকতে। কত সুন্দর নির্মল শায়ানের ভাবনাগুলো। ইস সব মানুষের মনগুলো কেন এমন হয় না। আবার ভাবে, বাকিটা জীবন জুড়ে সে শুধু বারবার শায়ানের মনের ভেতরেই ঢুকবে। দেখবে কীভাবে একটা ছোট্ট শিশুর সরল ভাবনাগুলো বিকশিত হয়। পরিবর্তিত হয়। এই সহজ মনজ সমীরকরণটি ঠিক কখন জটিল হতে শুরু করে, কীভাবে। সেই সৌভাগ্য কী তার হবে? একটা সময়ে নিজেকেই কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে সাবরিনার। আর ভাবতে পারে না। এখনই ঘুমের ওষুধ খেতে হবে হয়তো।

নুরুল হুদা পলাশ: সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা।