পারিবারিক মায়ার জিয়ন কাঠি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সদ্য হওয়া মা বাবার প্রথম আবেগের নাম তাদের বড় সন্তান। বাংলাদেশের একান্নবর্তী পরিবারের অতন্দ্র এক প্রহরী সংসারের বড় সন্তান। আর সেই সন্তান যদি হয় কন্যা সন্তান তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে হয় পারিবারিক মায়ার জিয়ন কাঠি। ছোট ভাইবোনদের মমতার মালায় গেঁথে রাখা যত্নবান মালি। বড় ভাইরাও হয়তো ভিন্ন আঙ্গিকে তেমন। তবে আমার আজকের এই শব্দের মালা এমন বড় আপাদের নিয়ে গাঁথা।

কন্যা সন্তান বড় হলে কেমন হয় সেই ঘরের আবহাওয়া? কেমন হয় সেই ঘরের নিত্য প্রকৃতি? বলছি আমার বড় আপার কথা। চোখ বন্ধ করলে চাকরিজীবী মায়ের হাত যতটা না দেখতে পাই আমি, তার থেকে অধিক দেখতে পাই আমার বড় আপার হাত। আমাদের বড় বোন জাহান নিপাকে।
সকালবেলা দ্রুতগতিতে বাজার থেকে আনা চিংড়ি মাছ ভেজে, নলা ধরে ভাত খাইয়ে ছোট বোনগুলোকে স্কুলে পাঠানো। বিকেল হলে স্কুল ঘরের মাঠ থেকে ধরে এনে বাধ্যতামূলক ঘুমের নিয়ম জারি। সন্ধ্যা হলে হাতমুখ ধুয়ে, চা বিস্কুট খাইয়ে পড়ার টেবিলে নিক্ষেপ। শত শাসন আর আদরে মাখা তার কত অলিখিত দায়িত্ব থাকে। প্রতি সপ্তাহে গায়ের ময়লা ঝামা দিয়ে ঘষা কর্মসূচি পালন করে লালন করা মেয়েটার নাম বড় আপা। গভীর রাতে আধভাঙা ঘুম থেকে উঠে শীতের কাপড় গায়ে জড়িয়ে দিত আমাদের চার ভাইবোনকে তার নাম বড় আপা।
আমাদের বড় আপা সেই, যার অন্য নাম ফায়ার সার্ভিস।

লেখিকার বড় বোন জাহান নিপা
লেখিকার বড় বোন জাহান নিপা

হাতে একটা টাকাও নাই। রিকশাওয়ালা ভাই নিচে দাঁড়িয়ে। খোদা রে খোদা। মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। দৌড়ে গিয়ে আপাকেই বলতাম, আপারে আমারে বাঁচা! এমন করেই প্রতিটা ভাইবোনের বিপদের মুহূর্তের সুইস ব্যাংক সে।
বহুদিন ধরে বেড়ে ওঠা বোধ বলে, মমতাতে পৃথিবীতে মায়ের বিকল্প হয় বড় বোন। অধিকাংশ সময়ই বড় আপাগুলো এত সরল সৌন্দর্যে পূর্ণ হয়। তারা সবই করে কোনো প্রকার মাইর এবং মাইনে ছাড়া! বড় আপা সেই সবসময় ঘরের মাঝারি বাঁদরগুলোর মাইরের হাত থেকে যে ছোট্টগুলোরে বাঁচায়। ছোট ভাইবোনদের শৃঙ্খলা শেখানো প্রথম শিক্ষক যে বড় আপা। সংসারের বড় সন্তান।
যেদিন আমাদের এই বড় আপার বিয়ে হয়ে যায়, সেদিন আমরাতো কোনোভাবেই আপার আঁচল ছাড়ব না। রাতে ঘুমাব কার সঙ্গে? খাটের কোণায় মামদো ভূত থাকে। ওই কোণায় কে থাকবে আপা ছাড়া? হইতো ন হইতো ন বোলে শুরু হয় আমাদের বিপ্লব! ফলস্বরূপ পালকির ভেতরে অবস্থান। তারপর পালকিতেই ঘুম। ভাগ্যিস এক ঘুমেই রাত সকাল। নয়তো বড় ভাইয়ার (দুলাভাই) কপালে কী যে হতো!
ওই রাতে ভাইয়াদের বাড়িতে কার সঙ্গে ঘুমিয়েছি তা আর মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আপা সকালের সব নাশতা তৈরি করে সবাইকে ডাকছে। আমাদেরও ডাকছে। কিন্তু যে নামে আপা আমাদের ডাকে টুনু-মুনু-চুনু সেই নামে না। ওখানে আবার কাকে জানি আম্মা-আব্বাও ডাকছে।
এই দেখে শুরু হলো আমাদের কান্না। বিস্মিত আমরা। মানুষের আব্বু-আম্মুকে আমাদের আপা আব্বু-আম্মু ডাকে কেন! মানুষের ঘরে আমাদের আপা ঘুমাবে কেন! আমরা আমাদের আপাকে ‘নিই যাবোগা, হইতো ন হইতো ন।’

লেখিকা
লেখিকা

তারপর সেই দুঃখ দ্বিগুণ হলো সেবার ঈদে যখন শুনলাম আমাদের বড় আপা ঈদ করবে না আমাদের সঙ্গে। এবার আর কান্নাকাটি না, সরাসরি বিদ্রোহ। রীতিমতো নারীবাদী আন্দোলন! আম্মু আব্বুকে ঘোষণা দিলাম আমাদের আপাকে নিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর সব মেয়েকে ঈদের দিনে মা বাবার কাছেই থাকার নিয়ম করতে হবে। ‘হইতো ন হইতো ন।’
আম্মু-আব্বু তো মানাতেই পারছেন না কোনোভাবে। আব্বু বলছেন, এটাই নিয়ম। এবার আম্মু বললেন, আচ্ছা, তোমাদের আপাকে নিয়ে আসব। নিয়ে এসেই আমি চলে যাব আমার বাড়িতে। ঠিক আছে? আমরা তো অবাক! আম্মুকে বলি, ‘আন্নে আবার কোথায় যাবেন?’ আম্মু বলেন, ‘আমাদের বাড়ি! আমিও তো আমার এগারো ভাইবোনের বড় আপা। তোমাদের ঘোষণা মতে সেটাই তো করতে হবে, নইলে ক্যামনে হবে?’
আম্মুকে ছাড়া ঈদ করব, কেমনে সম্ভব! আম্মু ছাড়া ঈদ হইতো ন হইতো ন। অতঃপর যুক্তির মুক্তি গলায় পড়ে একদম পুকুরের মতো শান্ত আমরা। তবু শান্ত পুকুরের শান্তি এই, দূর থেকে হলেও মায়ের মতো মমতার আঁচল পেতে রাখে যে, সেই আমাদের বড় আপা। যার আঁচলে জমা থাকে মহাসাগরসম মমতা।

জাহান রিমা: প্যারাডাইজ ডেন্টাল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।