তোমারেই খুঁজে ফিরি

সিঙ্গার ক্যাসেল
সিঙ্গার ক্যাসেল

সপরিবারে পাঁচ বন্ধু গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে ৩৬০ মাইল দূরে থাউজেন্ড আইল্যান্ডসে। আমেরিকা-কানাডা'র সীমান্তে ছোট বড় এক হাজারেরও বেশি আইল্যান্ডের অবস্থান যেখানে। সব মিলে ২৩ জনের বিশাল বহর। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস থেকে নির্দিষ্ট সময়ে একে একে ছেড়ে যায় আমাদের সব কটি গাড়ি। ছয় ঘণ্টার পথ যদিও, পথে পথে জিরিয়ে, আড্ডা দিয়ে, খেয়ে, কখনো বা নামাজ আদায় করে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় প্রায় দ্বিগুণ। নিজেদের গাড়িগুলো চেনার জন্য আমরা সব কটি গাড়ির পেছনে নানান রঙের পলিথিন বেঁধে দিই।

স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

৭০-৮০ মাইল বেগে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা শত শত গাড়ির ভিড়ে সহসাই আমরা নিজেদের গাড়িগুলোকে শনাক্ত করতে পারতাম এভাবে—ওই যে বাতাসে পতপত করে উড়ছে বন্ধুরা! সে এক বিশাল আয়োজন। সঙ্গে তিন দিনের পর্যাপ্ত পানি, খাবার ও জামাকাপড় ইত্যাদি। আমরা যখন আলেকজান্দ্রিয়া বে নামক গ্রামে গিয়ে পৌঁছাই ততক্ষণে সেখানে রাতের নিস্তব্ধতা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। নির্ধারিত হোটেলের সামনে এসে সব কেমন স্বপ্নের মতন মনে হতে থাকে। হোটেল রুমের পাশেই লেকের জলে ভাসছে সারি সারি স্পিডবোট। যেন গাঁয়ের পাশের বিলে বেঁধে রাখা ডিঙি নৌকা। যেন গলা উঁচিয়ে বলি, ও মাঝি, আমারে নিবা লগে?

সিঙ্গার ক্যাসেলের একটি কক্ষে রাখা সিঙ্গার সেলাই মেশিন
সিঙ্গার ক্যাসেলের একটি কক্ষে রাখা সিঙ্গার সেলাই মেশিন

ভোরের আলো ফুটেছে যখন, ধোঁয়া ওঠা গরম কফি হাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যাই গ্রামটি ঘুরে দেখতে। প্রায় সব কটি মোটেলের পাশেই থইথই জল, সারি সারি বোট। প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে ফিরে আসি রুমে। সকালের নাশতা সেরে সবাই একসঙ্গে রওনা দিই আইল্যান্ড দেখার উদ্দেশে। লঞ্চ বোঝাই দর্শনার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় একের পর এক আইল্যান্ডে। লঞ্চের ছাদে খোলা আকাশের নিচে বসে দমকা হাওয়ায় যেতে যেতে কেবলই মনে হচ্ছিল যেন, ঢাকা থেকে চাঁদপুর বাবার বাড়ি যাচ্ছি মেঘনা আর ডাকাতিয়া পেরিয়ে। মূলত আমরা যাচ্ছিলাম সেন্ট লরেন্স নদী ধরে। গাইডের স্পিকারে বলা কথাগুলো কানে আসছিল বাতাসের শো শো শব্দের মাঝেও। তিনি বলে যাচ্ছেন...তীব্র শীতের সময়ে এখানকার পানি ১০ ফুট গভীর পর্যন্ত বরফ হয়ে থাকে। চাইলেই এর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আইল্যান্ডে যেতে পারো। কিন্তু তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা কোনো কোনো স্থানের বরফ ভেঙে গাড়ি গভীরে তলিয়ে যেতে পারে।
দূরে ছোট ছোট আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছিল। যেন ছোট ছোট গ্রাম কিংবা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে এক চিলতে ঘর। আমাদের দেশে এমন জায়গাগুলোর নাম দেওয়া হয় হাইমচর, ছেঙ্গারচর। কিন্তু এখানে তেমন নয়। দ্বীপগুলো কিনে নিয়েছেন ধনীরা। প্রাসাদ তৈরি করেছেন গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে। কোনটির নাম ডার্ক আইল্যান্ড, কোনটি হার্ট আইল্যান্ড। গাইডের পিছু পিছু ডার্ক আইল্যান্ডে নামি সবাই। চারপাশে গাঢ় সবুজ ঘাস, গাছ-গাছালি ঘেরা শান্ত পরিবেশ। মাঝে অনেকটা উঁচু পাহাড়ের মতো জায়গায় একটি বিশালাকার প্রাসাদ। নাম সিঙ্গার ক্যাসেল। সিঙ্গার ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন এই ক্যাসেলটির মালিক। ভেতরে ঢুকে ডাইনিং রুম, লিভিং রুম, ড্রেসিং রুমসহ একে একে অভিজাত আসবাবে সজ্জিত রুমগুলো দেখছিলাম। হালকা আঁধারে ছেয়ে থাকা রুমের একপাশে পুরোনো পিয়ানো। হাত বোলাতেই আঁতকে উঠি। করুন কোনো কান্নার সুর বেজে উঠল কী! একটি ছোট অন্ধকার রুমে অনেকগুলো সিঙ্গার সেলাই মেশিন সাজানো। একদা কেউ কী এগুলো ব্যবহার করেছেন? আমার মায়ের এমন একটি সিঙ্গার সেলাই মেশিন ছিল। যা দিয়ে প্রতি ঈদে নানান ডিজাইনের সুন্দর সুন্দর ফ্রক বানাতেন আমাদের দুই বোনের জন্য। গাইডের ডাকে প্রাসাদের বাইরে এসে দাঁড়াই সকলে। বাইরে থেকে প্রাসাদটিকে অনেককালের পুরোনো শেওলা জমা পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি মনে হচ্ছিল। স্যাঁতসেঁতে শেওলার দেয়াল বেয়ে নেমে গেছে কিছু লতা। যেন সবুজ বিষণ্নতা ঝুলে আছে। মাথার ওপরে নীল আর সাদায় ‘আসমান’ নামের এক গল্প দাঁড়িয়ে।

থাউজেন্ড আইল্যান্ডসের একটি দৃশ্য
থাউজেন্ড আইল্যান্ডসের একটি দৃশ্য

বাইরে প্রকাণ্ড সব গাছেরা। সেই তপ্ত দুপুরে গাছের পাতাগুলো ঝিরিঝিরি কাঁপছিল। আমরা ছুটছি অপেক্ষমাণ লঞ্চের দিকে, অন্য আইল্যান্ডের উদ্দেশে। হার্ট আইল্যান্ড। সেখানে নেমেই অভিভূত সকলে। নানান রকম ফুলের বাগান। হার্টের আকারে বাগানগুলো। যেন আস্ত একটি হৃদয় ঘাসের বুকে শুয়ে আছে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে যে প্রাসাদের ভেতরে যাই, তার নাম বোল্ড ক্যাসেল। ভেতরে বিশাল বইয়ের সমারোহ। পুরোনো অভিজাত আসবাবে সজ্জিত প্রতিটি রুম। ঝাড় বাতিগুলো কালের সাক্ষী হয়ে ঝুলে আছে। ক্লোজেটে কিছু শীতের পোশাক ঝুলছে। প্রাসাদের মালিক মিস্টার বোল্ড প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর সেখানে ফিরে যাননি। ব্রিজ অথরিটি বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ করে। মিস্টার বোল্ড ও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বেঁচে নেই, কিন্তু রোজ মধ্যরাতে প্রাসাদসম বাড়িটির ভেতর থেকে কী কোনো নিঃসঙ্গ নারী বেড়িয়ে আসে খালি পায়ে সবুজ লনে? কিংবা হাহাকার করা চাপা কান্নার শব্দ কী কেউ শুনতে পায়? হৃদয় ছেঁড়া কান্না? একদা পৃথিবীর বুকে একটুকরো স্বর্গ ছিল যার?
আমরা যখন লঞ্চে আলেকজান্দ্রিয়া বে গাঁয়ের দিকে ফিরছি, তখন সেন্ট লরেন্স নদীতে সন্ধ্যার ঘন আঁধার। সঙ্গে তীব্র বেগে বয়ে যাওয়া শীতল বাতাস। আকাশে অচিন পাখি ডানা ঝাপটায়। সেই সন্ধ্যাটি আমার দেখা অন্য সকল সন্ধ্যার চেয়ে ভিন্ন। শান্ত জলের বুক চিরে লঞ্চ এগিয়ে চলছে। চাঁদের আলো লুটোপুটি খেলে জলের সঙ্গে। জ্যোৎস্না আর নৈঃশব্দ্যকে সঙ্গী করে তাকিয়ে আছি দূরে। যেন বহুদূরে কোনো মাঝি গলা ছেড়ে গাইছে—
তারে ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম পাখির পায়ে...
ক্যামনে আসে যায়...

রিমি রুম্মান: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।