সুখ পাখিটার খোঁজে...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার বাসার খুব কাছেই ওয়ালমার্ট। সবকিছুর জন্য আমার আবার সেখানেই যেতে হয়। বেশির ভাগ দিন হয়তো বাচ্চাকে স্কুলে ড্রপ করে ওয়ালমার্ট ঘুরে বাজার করে বাসায় চলে আসি।

এই ওয়ালমার্টেই আমার পরিচয় বিউটির সঙ্গে, সে এখানে কাজ করে।
সকালের দিকে পুরো সুপার শপটা বেশ ফাঁকা থাকে। বাচ্চাদের সঙ্গে আমাকে বাংলায় কথা বলতে দেখে একদিন নিজের থেকেই পরিচিত হলো।
এরপর প্রায় তাকে দেখতাম। কখনো ভীষণ ব্যস্ত কাস্টমার সামলাতে, কখনো বা ফুড সেকশনে।
একদিন সুযোগ পেয়ে সে বলে, আপু আপনার মোবাইল নম্বরটা কি দেওয়া যাবে। আপনাকে দেখলে ভীষণ আপন মনে হয়।
আমি না করতে পারলাম না তাকে, মোবাইল নম্বর দিয়ে দিলাম।
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন সে কল দেয় আমাকে। নিজের সম্পর্কে বলে। ঢাকার ময়মনসিংহে তার বাপের বাড়ি। দুই ভাই ও দুই বোনের ছিমছাম গোছানো সংসার তার মায়ের। সবার মাঝে সে দ্বিতীয়জন।
বিউটি বলে, আপা পড়াশোনা বেশি করতে পারিনি। আমেরিকায় থাকে পাত্র পেয়ে বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এরপর হাজবেন্ডের সঙ্গে এখানে চলে আসা।
ডিভি লটারি পেয়ে এই দেশে আসা বিউটির। স্বামী এই ১০-১২ বছরেও কিছু করতে পারেনি। বরং বিউটিকে দেশ থেকে আনার সঙ্গে সঙ্গে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সকাল–সন্ধ্যা ওয়ালমার্টে কাজ করে সে।
গত তিন বছর আগে একটা মেয়ে সন্তান হওয়ায় বেচারীর কাজের চাপ এখন কিছুটা কমলেও একবেলায় চাকরিতে যেতেই হয়। প্রথম থেকেই তার স্বামী প্রচণ্ড নির্যাতন করত তার ওপরে।
বিউটি বলে, সব সহ্য করে যাই শুধু কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই, তাই। আগে শারীরিকভাবে নির্যাতন করলেও এখন মানসিকভাবে বেশি করে। উঠতে বসতে শুধু অপমান করে। লেখাপড়া কম করেছি বলে কত কী যে বলে সারা দিন। আর যেদিন কোনো বাঙালির বাসায় দাওয়াত থাকে তাহলে তো কথাই নেই, বাসায় ফিরে অনবরত খারাপ ব্যবহার চলতেই থাকে। আমি নাকি কিছু পারি না, সেখানে সবার বউরা কত স্মার্ট আর আমি নাকি পুরাই গেঁয়ো। ভালো লাগে না আপু, ইচ্ছে করে সব ছেড়ে চলে যাই। শুধু বাচ্চাটার জন্য পারি না।
আহারে বেচারীর কষ্টের কথা শুনে খুব খারাপ লাগত আমার। ভীষণ মায়া লাগত আমাকে আপু বলে ডাকা ছোট বোনটাকে।
এত হাসি হাসি মুখ কিন্তু বুকের মাঝে পুষে রেখেছে নিজের গোপন কান্না।
এ দেশে বড়দিন এবং নিউ ইয়ারের ছুটিতে ব্যস্ত সবাই। আজকেও সে আমাকে ফোন দিয়েছিল, কান্নাভেজা স্বরে জানতে চাইল, আপু আমি কি করব?
আসলেই, কী–ই-বা আমি বলতে পারি তাকে।
উত্তরটা আমার নিজের কাছেও যে নেই।
রাতের আঁধারে শুয়ে ভাবি, আলো ঝলমলে এই শহরেরই হয়তো কোথাও নীরবে কাঁদছে কেউ সুখ পাখিটার খোঁজে। রাতের নিয়ন আলোর দিকে তাকিয়ে, সেও হয়তো ভাবছে এক দিন সব দুঃখ মুছে যাবে তার।

রিফাত নওরিন: আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র।