ভেনিসের দিনগুলি

গ্র্যান্ড ক্যানেল। বেল টাওয়ার থেকে তোলা। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান
গ্র্যান্ড ক্যানেল। বেল টাওয়ার থেকে তোলা। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান

মার্চেন্ট অব ভেনিস, ওথেলো অথবা মার্কো পোলো—ছোটবেলায় এরাই আমাকে ভেনিস চিনিয়েছিল। কল্পনার তুলিতে নিজে নিজেই ভেনিসের ছবি এঁকেছিলাম। তখন ভেনিসমাত্রই আমার কাছে ছিল ওথেলোর বর্ণবাদ, ঈর্ষা ও ভালোবাসার অপূর্ব ও অভিনব এক সংমিশ্রণ। অথবা অসাধারণ বৃদ্ধিমত্তা ও মেধা শক্তিসম্পন্ন পোর্তিয়ার মতো নারী শক্তির জন্মস্থান অথবা মার্কো পোলোর অসীম সাহসিকতা অথবা শত শত ক্যানেলের দেশ! চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার পর মনে হলো পুরো শহরটাই যেন শিল্পীর মাস্টারপিস।

আমরা রোম থেকেই ট্রেনে করে গিয়েছিলাম ভেনিসে। ভোরে রওনা হয়ে দুপুর ১২টার ভেতরেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। স্টেশন থেকে বাইরে বের হতেই কেমন নোনা বাতাস গায়ে এসে ধাক্কা দিল যেন। পৃথিবীর বুকে যে এত চমকপ্রদ বৈচিত্র্যময় একটি শহর থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এই একটি মাত্র স্থান পৃথিবীতে যেখানে রাস্তা দিয়ে কোনো যানবাহন চলে না। সেখানে গাড়ি, ট্রেন, বাস নেই, এমনকি একটা সাইকেলও নেই। সব যাতায়াতই করা হয় ছোট ছোট খাল দিয়ে নৌকোয় চড়ে এবং পায়ে হেঁটে।

সেন্ট মার্ক স্কয়ার ও ভেনিস। বেল টাওয়ার থেকে তোলা। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান
সেন্ট মার্ক স্কয়ার ও ভেনিস। বেল টাওয়ার থেকে তোলা। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান

ভাপোরেতোর জন্য টিকিট কাটার পর অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে প্রায় ১১৮টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা মায়াবী শহর ভেনিস জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রায় ১৭৭টি ছোট ছোট খাল। এদের যুক্ত করেছে প্রায় ৪০০ ব্রিজ! ভাবতে পারেন? চলছি আর ভাবছি, কীভাবে পানির ওপরে ইট-পাথরের বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আল্পসজুড়ে হানা দেওয়া উত্তরের দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই জলমগ্ন ভেনিসকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোনো দালান তৈরি করা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এরপর কয়েক শতক ধরে তিলে তিলে শহরটি গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে গাছের গুঁড়ি দিয়ে পাইলিং করে তার ওপর ভবন নির্মাণ করতে লাগল। সে যেন এক অসাধ্যসাধন!
হোটেলে পৌঁছানোর পথে, মানে জলপথে খানিক পরপরই খালের ওপর দিয়ে পারাপারের জন্য নয়ন জুড়ানো রং, নকশা, স্থাপত্যশৈলীর সব সেতু। । এর মাঝে গ্র্যান্ড ক্যানেলের ওপরের বিশাল সেতুটাই সবচেয়ে জমকালো। যখন যানটি গ্র্যান্ড ক্যানেলের কাছাকাছি পৌঁছাল, আমি নীল সৌন্দর্যে প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়লাম। এটি শহরটিকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা সবচেয়ে চওড়া খাল যা গ্র্যান্ড ক্যানেল নামে জগদ্বিখ্যাত। স্থাপনার জগতে এক অটুট বিস্ময় এই গ্র্যান্ড ক্যানেল। সত্যিই তাই। বেল টাওয়ার থেকেই এর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

পিয়াজা সান মার্কো। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান
পিয়াজা সান মার্কো। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান

ওহ, ভাপোরেতোর কথা তো বলাই হয়নি। ভাপোরেতো হচ্ছে জলজ ট্যাক্সি। সেই ভাপোরেতো চড়েই স্বপ্নের শহর ভেনিসে ঘুরে বেড়িয়েছি। ইঞ্জিন আর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, এ ছাড়া কোনো আওয়াজ যেন শুনতেই পেলাম না! গ্র্যান্ড ক্যানালের দুই পাশে বড়বড় প্রাসাদ, চার্চ, রেস্টুরেন্ট বাসাবাড়ি আর দোকানপাট দেখতে দেখতে শুনতে পেলাম ছেলের বাবার গলা, সামনেই নামতে হবে। এর মধ্যে আবার ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেও শুরু করেছে। আবার আকাশে সূর্য মামাকেও দেখা যাচ্ছে। কী বিপদ রে বাবা! বাবাই, পুত্রের পিতা, আমাদের তিন সদস্য বিশিষ্ট টিমের লিডার। তিনি নেমেই গুগল ম্যাপকে দেখাতে বলল আমাদের হোটেলটি কোন দিকে। বিশ্বাস করুন, রহস্যময় অলিগলিতে প্রায় হারাতে হারাতেই খুঁজে পেলাম হোটেলটি!
হোটেল থেকে দুই পা হেঁটে গেলেই ভেনিসের বিখ্যাত সেন্ট মার্ক স্কয়ার। বিশাল এলাকা জুড়ে চত্বরটির মাঝখানে রয়েছে সেন্ট মার্কের গির্জা। কথিত আছে, মিসর থেকে সাধু মার্কের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে এই স্থানে পুনরায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এর অপর পাশে রয়েছে ১৭০০ সালের তৈরি সান্তা মারিয়া দেলা সালুতে নামে একটি সুন্দর গির্জা। ভয়ংকর প্লেগে যখন লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল মধ্যযুগে, তখন ভেনিসবাসীরা প্রতিজ্ঞা করে যে এই মহামারি থেকে মুক্তি পেলে তারা একটি গির্জা তৈরি করবে ধন্যবাদ দিতে। এটিই সেই গির্জা। সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকার ঠিক সামনে ছোট স্কয়ার পিয়াজা সান মার্কো। শুধু মানুষের কলরব, পানির শব্দ আর হাজার হাজার ভিড় করা পায়রার ডানার শব্দ। আমার পুত্র তো আনন্দে আত্মহারা। সে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে কতবার যে পায়রা ধরে ফেলেছিল তার হিসাব নেই! আর খাবার বের করলেই সব পাখি যেন গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! সে এক কথায় অভূতপূর্ব অনুভূতি।

গ্র্যান্ড ক্যানেলের সামনে সপরিবারে লেখিকা
গ্র্যান্ড ক্যানেলের সামনে সপরিবারে লেখিকা

এখানে পায়রার সঙ্গে খেলতে খেলতেই হঠাৎ ঝড় নামল। আমরা দৌড়ে ষোড়শ শতকে তৈরি প্রায় ১০০ মিটার উঁচু বেল টাওয়ারের নিচে আশ্রয় নিলাম। বিশাল লাইন ওপরে যাওয়ার জন্য। যারা নামছে তারা সবাই শীতে কাঁপছে। ভাবছি কী রে বাবা, এত ঠান্ডা নাকি? এলিভেটরে চড়ে যখন ওপরে উঠলাম তখন ঝড়ের ধাক্কায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ঠান্ডায় নিজে সামাল দেব, না ছেলেকে সামলাব, পুরাই বেকুব হয়ে গেলাম! বাতাস আমাদের প্রায় উড়িয়েই যেন নিয়ে যাচ্ছিল। কী সে দাপুটে বাতাস। ভাবছিলাম এ রকম ঝড় হলে কীভাবে একসময় এখান থেকে বাতি দেখাত। এটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রও ছিল বটে। এতে পাঁচটা ঘণ্টা রয়েছে—মেলিফিসিও, নোনা, ত্রোত্তিয়েরা, মেজ্জা-তেরজা আর মারাঙ্গটা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় সেগুলো বাজানো হতো। যেমন মেলিফিসিও ঘণ্টা বাজত যখন কোনো অপরাধীকে জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। বেল টাওয়ারের ওপর থেকে গ্র্যান্ড ক্যানেল যে কী অসম্ভব সুন্দর দেখায়!
মন খারাপ করা দীর্ঘশ্বাস সেতু! Bridge of Sighs-এর কথা কে না জানে; আজ থেকে অনেক বছর আগে বিচারের পর কয়েদিদের ছাদে ঢাকা সেতু দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো কারাগারে; যার ঘুলঘুলি দিয়ে কয়েদিরা শেষবারের মতো দেখতে পেত বাইরের পৃথিবী। জীবনের সৌন্দর্যের শেষ দৃশ্যটি একটি দীর্ঘশ্বাস হয়ে রয়ে যেত তাদের আত্মা। দেখলেই কেমন যেন একটা বিষাদের অনুভূতি হয়, জীবন, মৃত্যু আর সৌন্দর্য—সব একাকার হয়ে যায়।

দীর্ঘশ্বাস সেতু। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান
দীর্ঘশ্বাস সেতু। ছবি: সৈয়দ হাসিবুল হাসান

ভেনিসের সৌন্দর্য অন্যরকম। সরু গলি দিয়ে চলতে চলতে মনে হয় যেন আমি নিজেও শত বছর পিছিয়ে গিয়েছি! নিজেকে শত বছর আগের কোনো চরিত্র বলেই মনে হতে থাকে। রাতের ভেনিসও জমজমাট; হোটেলের বন্ধ জানালা দিয়েও যেন গভীর রাতে মানুষের আড্ডায় জমজমাট ভাবটা শেষ হয়েও হয় না শেষ।

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল: নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও ব্লগার। জার্মানি।