আভিজন-বিভবের কুঞ্জকানন

ওয়াকার হাউস
ওয়াকার হাউস

কী বলব তাকে? তার সময়ের রাজা, আমার কাছে তো তাই মনে হয়। দারুণ এক কর্মময় জীবন তার। যা ঐশ্বর্য ও সাফল্যে পরিপূর্ণ। কানাডার আলবার্টা প্রদেশের ক্যালগেরি শহরের অনিন্দ্য সুন্দর বাড়িটা আর বাড়ির পেছনের জলাধারে পাখিদের অভয়ারণ্য দেখে, সেই ইতিহাস না ছুঁয়ে পারা যায় না। এই বাড়ির বারান্দায় বসে থেকে আমি সব সময় সেই রাজা-রানির সময়ে চলে যাই। তীব্রভাবে অনুভব করি সেই আভিজাত্য।

কর্নেল জেমস ওয়াকার হাউস বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের আলবার্টার ধনী লোকদের কাছে অতি প্রিয় নিদর্শন এই নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপত্য। শুধু স্থাপত্যের জন্য নয়, ক্যালগেরি শহরের ইতিহাসেও এ বাড়ি মহা মূল্যবান। যেখানে ২৫ বছর বসবাস করেছেন এই শহর শুরুর দিকের সবচেয়ে প্রভাবশালী নাগরিক জেমস ওয়াকার। তাইতো ঐতিহাসিক সম্পদ হিসেবে আলবার্টা প্রদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংরক্ষণ করছে এই বাড়ি। আর জেমস ওয়াকার নির্বাচিত হয়েছেন শতাব্দীর নাগরিক (Citizen of the Century) হিসেবে।
তবে জেমস ওয়াকারের মৃত্যুর পর হারিয়ে যেতে বসেছিল তার এই বাড়ি। সেটা না হয় পরে বলি। এখন ঘুরে আসি জেমসের সফল রাজত্বে।
জেমস এই বাড়ির নাম রেখেছিলেন ইঙ্গলউড। এতটাই তখন তার প্রভাব এই শহরে, এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই বাড়ি, যে পুরো এলাকাই পরিচিত হয়ে উঠল ইঙ্গলউড নামে। এর আগে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীনতম এই এলাকা পরিচিতি ছিল ব্রুউয়ারি ফ্ল্যাট বা ইষ্ট ক্যালগেরি নামে। ১৯১১ সাল থেকে অফিশিয়ালি এর নামকরণ হয় ইঙ্গলউড।
১৯১০ সালে তৈরি করেছিলেন তিনি এই বাড়ি। লাল ইটের এই বাড়ি তিনি বানিয়েছিলেন অনেক বেশি খরচ করে। হয়তো আগের দুর্দশার কথা চিন্তা করেই। কেননা এর আগে তৈরি জেমসের দুই দুটো বাড়ি হারিয়ে গিয়েছিল বো (Bow) নদীর বন্যায়। দোতলা এই বাড়িটির নকশায় ১৯ শতকের ইতালীয় প্রভাব আছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে টানা প্রশস্ত বারান্দা। ঢালু হয়ে নেমে আসা ছাদ এবং অলংকরণে তা দেখা যায়। কংক্রিট ঢেলে তৈরি হয়েছিল এর বেসমেন্ট। যা ছিল ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত ব্যয়বহুল উপকরণ। বাড়ির পেছনেই ঘোড়ার গাড়ি ঘর, একই উপাদান দিয়ে বানানো সেই বিল্ডিং।
এই বাড়ির পেছনের জলাধারটায় প্রতিবছর সমাগম ঘটে অসংখ্য অতিথি পাখির। স্নিগ্ধ শান্ত বাড়িটির বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে পাখির কুজন শুনতে শুনতে হারিয়ে যাওয়া যায় প্রকৃতির মাঝে। জানা যায়, এখানে এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে ২৭০ প্রজাতির পাখি, ২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৩৪৭ প্রজাতির গাছপালা। এই জলাধারকে ঘিরে আছে সুন্দর করে বাধানো হাঁটা পথ, পারাপারের জন্য ছোট ছোট সেতু। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় বো নদীর পাড় অবধি। এ বাড়ির খ্যাতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পাখিদের অভয়ারণ্য, এই আরণ্যক। জেমসের ছেলে সেলবি ওয়াকার, ১৯২৯ সালে ফেডারেল সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন এটাকে সরকারিভাবে পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। তখন তা ভালোভাবেই কার্যকর হয়েছিল।

ওয়াকার হাউস
ওয়াকার হাউস

জেমস ওয়াকারের জীবদ্দশার পুরোটা সময় তিনি জয়ের মুকুট পরেই ছিলেন। ইতিহাসে তার ব্যর্থতা খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যালগেরির ১২৫ একর জায়গা তিনি অর্জন করেছিলেন। যার বেশির ভাগ অংশ থেকেই সাধারণ জনগণ উপকৃত হচ্ছেন এখনো পর্যন্ত। যদিও ১৯৩৬ সালে তার মৃত্যুর দুই বছর পর থেকে প্রায় ২২ বছর তার সম্পত্তি নানা হাত ঘুরেছে। কৃষি থেকে শহরে রূপান্তরিত জমির ট্যাক্স জটিলতায় সবই হারিয়েছিলেন তার বংশধরেরা। অবশেষে ১৯৬০ সালে পাখিদের এই অভয়ারণ্য পুনরুদ্ধার হয় পরিবেশবাদীদের হস্তক্ষেপে। সম্ভবত এটিই এই প্রদেশের প্রথম অভয়ারণ্য।
ক্যালগেরির অসংখ্য প্রথমের সঙ্গে জেমসের নাম জড়িত। তার দান করা জায়গাতেই এ শহরের প্রথম স্কুল। যা তিনিই উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্রথম স্কুল ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৪ বছর। এখনো তার নামেই পরিচিত ও সমাদৃত এই স্কুল। তিনিই প্রথম ক্যালগেরিতে সাইড ওয়াক বসিয়েছিলেন। এই শহরের প্রথম টেলিফোন লাইনও তার আনা। শোনা যায়, পর্যাপ্ত তারের অভাবে বাড়ির ভেতরে তা আনা যায়নি, বাইরে রাখা ছিল সেই ফোন। তার জমি থেকে পাওয়া তেল কূপ থেকে তিনি প্রথম বাণিজ্যিক ও আবাসিক কার্যে ব্যবহারের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ শুরু করেন। এই গ্যাস দিয়েই তিনি তার ঘর গরম করতেন—নিজের ঘর ও শহরকে আলোকিত করেছেন। তিনিই গড়েছিলেন ক্যালগেরি এগ্রিকালচারাল সোসাইটি। বর্তমানে বিখ্যাত ক্যালগেরি স্ট্যামপিডের আদিরূপ। গড়েছিলেন প্রথম বয়েজ স্কাউট। ছিলেন প্রথম জাস্টিস অব দ্য পিস ও প্রথম জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক।
১৮৮১ সালে তিনি নর্থ-ওয়েস্ট মাউন্টেন ((NWMP) পুলিশের সক্রিয় দায়িত্ব ছেড়ে দেন। শুরু করেন ব্যবসা; করাত কল, খামার, হাউজিং—আর দ্রুতই সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন তিনি। সুঠাম শরীর, মিলিটারি ব্যাকগ্রাউন্ড, সাহস আর বাস্তববুদ্ধি তাকে এনে দিয়েছে উত্তরোত্তর সাফল্য। ক্যালগেরিতে বসবাসের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিনিয়ত তিনি নতুন কিছু করে গেছেন সফলতার সঙ্গে। নিজের আর কিছু প্রয়োজন না থাকলেও ভেবেছেন ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য, দেশের জন্য। ফিরে এসেছিলেন আবার মিলিটারিতে, উত্তর পশ্চিম বিদ্রোহের (North West Rebellion) সময়ে তিনি হোম গার্ড গঠন করেছিলেন। তিনিই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি বিদেশে গিয়েছিলেন কানাডীয় ফরেস্ট্রি কর্পসের দায়িত্ব নিয়ে। তখন তার বয়স ছিল ৭০ বছর।
এই বাড়ির অপরূপ পরিবেশ কিংবা এই জলাধারের বুকে কি জেমস তার কর্মমুখর সফল জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন? পেছনের সেই সময়ই কি তাকে আরও বেশি কাজের প্রতি উদ্যোগী, উদ্যমী করে তুলত? অল্প বয়সের সাহস আর যোগ্যতার কারণেই তো তিনি অন্টারিওর মতো প্রতিষ্ঠিত শহর ছেড়ে এসেছিলেন এই অখ্যাত দুর্গম জায়গায়।
ওয়াকার হাউসের এই রাজা জন্মেছিলেন অন্টারিওর হ্যামিলটনের কাছে। তার ক্যালগেরিতে আগমনের ইতিহাসও বীরত্বগাথায় পূর্ণ। বাবা-মার সাত সন্তানের মধ্যে পঞ্চম তিনি। বাবার সান্নিধ্যে কৃষিকাজ আর ঘোড়া চালনায় পারদর্শী ছিলেন তিনি, ছিলেন মিলিটারি বিষয়েও আগ্রহী। বর্তমানের রয়াল মিলিটারি কলেজ অব কিংস্টন (অন্টারিও) থেকে ট্রেইনিং নিয়ে তিনি যোগ দিয়েছিলেন নর্থ-ওয়েস্ট মাউন্টেন পুলিশে ১৮৭৩ সালে। খুব তাড়াতাড়ি মানুষ ও ঘোড়া—দুটোই ম্যানেজ করার ক্ষমতা দেখিয়ে জেমস নতুন দায়িত্বের জন্য মনোনীত হন। তিনি ছিলেন প্রথম অরিজিনাল কমিশন্ড অফিসার।
অন্টারিওর এক অভিজাত পরিবারের মেয়ে ইওফিমিয়া ডেভিডসন কোয়ারিকে ১৮৭৬ সালে বিয়ে করেন তিনি। নববধূকে নিয়ে যখন পশ্চিমে আসেন জেমস, তখনো কমান্ডারের বাসস্থান তৈরি হয়নি। শহুরে জীবনে বেড়ে ওঠা এই দুই নরনারী সেই জীর্ণ রুক্ষ পরিবেশকেই করে তুলেছিলেন ফলবান। নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতার কথা ভেবে জেমস ব্যারাকে সবজি চাষের প্রচলন শুরু করেন যা আজও অনুসৃত মাউন্টেন পুলিশে। সরকারের প্রশংসার পাশাপাশি নেটিভদের কাছেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। কেননা দুই পক্ষের যেকোনো আলোচনার সার্থক ফলাফল আসত জেমসের মধ্যস্থতায়। তাই তো নেটিভরা তাকে খেতাব দিয়েছিলেন, পি টিকোয়াক কি (the eagle that protects). তার এই কর্মদক্ষতার কারণেই তাকে গবাদিপশুর খামারের দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়। সক্রিয় সৈনিক জীবন ছেড়ে তিনি খামারের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেন। দুই বছর পর নিজ ব্যবসা শুরু করেন এই ক্যালগেরিতে। তারপরের ইতিহাস আগেই বলেছি। ইঙ্গলউডের অনিন্দ্য সুন্দর ওয়াকার হাউসে সফলতম জীবনের বসবাস।
তাই যখনই ইঙ্গলউডের ওয়াকার হাউসে যাই, কল্পনায় দেখতে পাই, জেমস আর ইওফিমিয়ার সাজানো সংসার। প্রচণ্ড সফল এক পুরুষ, তার ভালোবাসার যোগ্য সহযাত্রী, তাদের সন্তান উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে নতুন কোনো পাখি দেখে। কিংবা প্রাতর্ভ্রমণে বের হয়েছে আর পরবর্তী উদ্যোগ নিয়ে আলাপ করছে। অথবা রোদে পিঠ দিয়ে বসে আয়েশি সময় উপভোগ করছেন তারা। কেমন ছিল সেই সময়টা!

আফরিন জাহান হাসি: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।