রঙিন স্বপ্ন আর রংহীন বাস্তবতা

তুষারে ঢাকা চারদিক
তুষারে ঢাকা চারদিক

চার ঋতুর এই দেশে শীতকালেরই রাজত্ব। দেশটা বেশির ভাগ সময়ই থাকে বরফে ঢাকা। রাতের বাতিগুলোর যখন সেই বরফে পড়ে মনে হয় হিরা চিকচিক করছে। এই সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করে আমাকে, ঠিক তেমন দুই-তিন মাসের জন্য গ্রীষ্মকালে ফোটা ফুলগুলোর সঙ্গেও হাসি আমি। অপূর্ব লাগে যখন ম্যাপল গাছের বনে বনে আগুন লাগে। সবুজ পাতাগুলো হলুদ, কমলা, লালচে রঙ্গে রঙিন হয়। তুষারপাতের আগেই ওই সব পাতাগুলো ঝরে পড়ে আর প্রকৃতিটা লাগে অসহায়। সময়টা তখন অক্টোবর ও নভেম্বর মাস। দিনের আলো খুব কম সময় থাকে আর রাতগুলো হয় অনেক বড়। মানুষগুলো কেমন যেন মনমরা হয়ে যায়। সময়টা পার করা আসলেই কঠিন থাকে সবার জন্য। এমন কঠিন সময়ে আমি আমার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ কাজটি করতে বসেছি। লেখালিখিতে অনভিজ্ঞ আমি জানি না, নিজের মনের কথাগুলো বের করে আনতে পারব কিনা। কিন্তু ভয়কে জয় করার লোভ সামলাতে পারলাম না। লিখতে বসে গেলাম।

পৃথিবীর উত্তর মেরুর দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশে নয় বছর আগে আসা হয়েছিল অনেক রঙিন স্বপ্নের ডানায় ভর করে। দেশটির মানুষেরা নাকি অনেক সৎ। তারা মিথ্যে বলে না। অন্যের ক্ষতি করে না। দেশের ভালোর জন্য সবাই এক হয়ে কাজ করে। রাজনীতিবিদদের জন্য জনসাধারণের কোনো কষ্ট হয় না। নেই কোনো হরতাল। নেই কোনো লোড শেডিংয়ের যন্ত্রণা।
সবই কেমন যেন স্বপ্নের রাজ্যের কোনো গল্প মনে হতো। আর আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যেটা পরম সৌভাগ্যের ছিল, তা হলো বিনা খরচে উন্নত দেশের শিক্ষা লাভ। ডিগ্রি অর্জন করেই প্রিয় মাতৃভূমিতে চলে যাব। দেশের জন্য অনেক কিছু না পারলেও কিছু একটা করব। এইরকমই ভেবেছিলাম অনেকের মতো আমিও।
যখন স্বপ্নের দেশটিতে পা রাখলাম অনুভূতিগুলো আস্তে আস্তে হোঁচট খেতে থাকল। শুদ্ধ ভালো বাংলাই তখন শেখা হইনি তার পাশাপাশি চলত ইংলিশ ভাষাটি রপ্ত করার চেষ্টা। আর এরপর নতুন দেশটির নতুন ভাষা জানা হয়ে গেল অতি জরুরি। কারণ দেশটির ৫০ লাখ দেশপ্রেমী তাদের নিজেদের ভাষাকে বিলীন হতে দেবে না। তাই এখানকার প্রতিটি নাগরিক ন্যূনতম পাঁচটি ভাষা জেনেও সহজে অন্য ভাষায় কথা বলতে চান না। সেখানে কিন্তু আমরা অনেকেই কথা বলার সময় জিহ্বাকে নড়িয়ে চড়িয়ে ইংলিশ বলাকে গৌরবের মনে করি। নতুন ভাষাটি শিখতে শুরুতে কষ্ট হলেও এখন কিছুটা আয়ত্তে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে অর্জন করেছি এই দেশের নাগরিকত্ব। ভেবে দেখুন তাদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আপনার জীবনের সোনার চাবিটি হাতে পেয়ে যাবেন।

লেখিকা
লেখিকা

যা হোক, দেশটির নিস্তব্ধতা প্রথম দিকে অভিশাপ মনে হতো আর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের রিকশার বেলের শব্দ প্রায়ই কানে বাজতো। কত রকমের অভিজ্ঞতা হওয়া যে শুরু হলো তা বলে শেষ হবে না। সাদা কালো চামড়ার বৈষম্য এই দেশের মানুষেদের চেয়ে সতর্কভাবে কেউ দেখাতে পারে বলে আমার জানা নেই। কথাটি কষ্ট নিয়ে বলার কারণ, যখন দেখি আমাদের অনেক সম্ভাবনাময় অভিজ্ঞ মানুষগুলো সঠিক জায়গায় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পায় না লেখাপড়ার পর নিজ দেশে। তাই অনেকে ভালো চাকরির আশায় এই দেশকে উপযুক্ত স্থান ভেবে থেকে যায়। খুব কমসংখ্যক মানুষই পারে দেশের মাটিকে কথা দেওয়ার কথা রাখতে। সেই মানুষগুলোর কষ্ট অন্যরকম। যেন নিঃসঙ্গ এক যাত্রা। তারা না পারে দেশে গিয়ে নিজেদের পুরোপুরি মানিয়ে নিতে, না পারে প্রবাস জীবনকে ভালোবাসতে। তখন প্রবাস জীবনের অন্যান্য মানুষগুলোর মধ্যে খুঁজে বেড়ায় নিজের আপনজনের ছায়া। তারাই হয়ে উঠে আত্মার আত্মীয়।
অক্লান্ত পরিশ্রম আর নির্ঘুম অনেক রাত কাটিয়ে অপেক্ষায় থাকি মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করবই বলে। আমি জানি আপনারা যারা বিদেশের মাটিতে আছেন তারাও পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে নিজের কষ্টগুলো বিসর্জন দেন। পরিশ্রমের পর যা কিছু প্রাপ্তি সেটাই সম্মানজনক ও তৃপ্তির। বাবার কাছ থেকে এই শিক্ষা ধারণ করে তুষার শুভ্রের দেশটিতে আমার ছুটে চলা। ১৮-২০ মাস অন্তর অন্তর মাতৃভূমিতে গিয়ে মাত্র ৩০ দিন কাটানো এখন জীবনের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ইচ্ছা সত্ত্বেও কিছু অদৃশ্য কারণে মা, মাটি আর প্রিয় মানুষগুলোর থেকে ৮ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার দুরে ফিনল্যান্ডে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে, নিতান্তই কাটাতে হচ্ছে বলে। আমার রঙিন স্বপ্নগুলো রংহীন বাস্তবতায় হারিয়ে যেতে দেব না। জীবনে থেমে যাওয়া ই পরাজয়। আমরা যেন বাস্তবতার পরাঘাতে থেমে না যাই প্রবাসী সবার জন্য আমার শুভকামনা।

আবীরা জামান ন্যান্সী: ফিনল্যান্ড