প্রবাসে ভাপা পিঠা

ভাপা পিঠা নিয়ে লেখকের ছেলে সাফওয়ান ও বন্ধুর মেয়ে ফাতেমা
ভাপা পিঠা নিয়ে লেখকের ছেলে সাফওয়ান ও বন্ধুর মেয়ে ফাতেমা

অনেক ছোট থাকতে মা আমাকে পিঠা খাওয়ানোর জন্য খুব তোড়জোড় করতেন। তবে পিঠা একদমই পছন্দ করতাম না। শীতের দিনে আমার চার বোনেরা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এলে আমাদের ঘরে এক ধরনের আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। তাদের আগমন উপলক্ষে শীতের সকালে ভাপা পিঠা না হলে জমতই না। খেজুর রস দিয়ে সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করে ভাপা পিঠা খাওয়ার আয়োজন চলত।

আমাদের জোলার হাটের কল ঘরে গিয়ে পিঠা বানানোর জন্য চাল গুঁড়ো করে আনার দায়িত্ব ছিল আমার। বাড়ির সবার ছোট হিসেবে আমাকে কল ঘরে গিয়ে হলুদ-মরিচ, গম ও চাল গুঁড়ো করার দায়িত্ব বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হতো। আমার জীবনে অনেক কষ্টের সময়ের একটি হলো, কল ঘরে যাওয়া। আমার মোটেই পছন্দ হতো না সেখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। শীতের সময় কল ঘরে গিয়ে দুই-তিন ঘণ্টা পর্যন্ত লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। একটু বড় হওয়ার পর সেখানে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার লজ্জাও লাগত। সে কারণে মনে হয়, আমার পিঠা খাওয়ার প্রতি অনাগ্রহ জন্ম নিয়েছিল!
বিয়ে করার পর আমার শাশুড়ি খুব আগ্রহ নিয়ে জামাই আসা উপলক্ষে পিঠা বানাতেন। প্রথম প্রথম তিনি খুব অবাক হতেন আমার পিঠা খাওয়া অপছন্দ দেখে। যে কারণে তিনি আমার জন্য সকালে পরোটা ভাজতেন। তবে আমার আসা উপলক্ষে তিনি সব সময় খুব ভোরে উঠে পিঠা বানাতেন আর আমি খাই বা না খাই, নাশতার টেবিলে পিঠা পরিবেশন করে যেতেন। লন্ডনে আসার পর আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে পিঠা বানায়। তবে এখানে কেন জানি পিঠা খেতে মন্দ লাগে না। কল ঘরের সেই ভয়ানক ও অস্বস্তিকর দৃশ্য মন থেকে চলে যাওয়ার কারণে এখন পিঠা ভালো লাগে কিনা কে জানে।
এখন জানুয়ারি মাস গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর নিশ্চয় ধুম পড়ে গেছে। আগের মতো আয়োজন না থাকলেও বাংলার গ্রাম্য রীতিতে এখনো নতুন আত্মীয়দের আপ্যায়ন, পিঠা ছাড়া কিছুটা কমতি হয় বৈকি।
পিঠা নিয়ে আমাদের লন্ডনে হইচই কম হয় না। এখানে মাঝে মধ্যে সংস্কৃতিমনা কিছু মানুষদের হলরুম ভাড়া নিয়ে পিঠা মেলার আয়োজন করতে দেখা যায়। ঘটা করে পিঠা মেলা আয়োজন করা বাংলাদেশে এখন এক ধরনের ট্যাডিশন হয়ে গেছে। তবে যারা পিঠা মেলাতে হরেক রকম পিঠা বানিয়ে টিভির পর্দা কাঁপান, আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, তারা কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে তা করে থাকেন? এগুলো লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মনের ভেতর কতটুকু গ্রামের খাদ্য সংস্কৃতিচর্চা লালন করছি! আমার বিশ্বাস, যেভাবে আমরা লোক দেখানোর জন্য করছি, তার সিকি ফোটাও যদি আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার মানসে করতাম, তাহলে আজ আমাদের সকল লোকজ সংস্কৃতির এমন দুর্দশা হতো না।

লেখক
লেখক

কয়েক দিন আগে আমার বন্ধুবর কাজি ভাইয়ের বাসায় শীতকালীন ভাপা পিঠা খাবার দাওয়াত পেয়ে মনটা আনন্দে ভরে গেল। এমন দাওয়াত লন্ডনে ভাবা মুশকিল। তাই তার বাসায় দুপুরেই চলে গেলাম। খেলাম এবং গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা মারলাম। সকাল ৯টায় আমাদের ডাকা হলো গরম-গরম ভাপা পিঠা খাবার জন্য। ভাবি প্রথম পিঠাটি চুলা থেকে নামিয়ে আমাকে দিলেন। তখনো সবাই নাশতার টেবিলে আসেনি বিধায় আমি খেতে না চাইলেও ভাবির আন্তরিকতায় খেতে হলো। ভাপা পিঠা খাবার সঠিক তরিকা হলো, খেজুরের রসে চুবিয়ে চুবিয়ে খাওয়া। লন্ডন শহরে খেজুর রসের কথা চিন্তা করা অবান্তর। তবে রস ছাড়াও পিঠাটি খেতে আমার খুব মজা লেগেছে। কিছুক্ষণ পর বাচ্চারাসহ সবাই খেতে এলে, পিঠা খাবার একটি আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরি হলো।
এখানকার বাচ্চারা পিঠা চেনে না। তাদের বোঝানো হলো এগুলো আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার। পিঠাতে নারকেল ও গুড় থাকার কারণে তারাও মজা করে খেল। তাদের মধ্যেও আনন্দের ভাব পরিলক্ষিত করলাম। পিঠা খাবার এমন পরিবেশ পেয়ে আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আগের দিনে ফিরে গেলাম। তবে কল ঘরের কথা স্মরণ আসতেই মনে মনে একটু হেসে নিলাম!

মোহাম্মদ আবদুল মালেক: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।