আমার-তোমার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

খুব ভোরে নামাজ পড়ে, নাশতার টেবিলে এসে বসলেন আসাদ সাহেব। ভার্সিটিতে অনেকগুলো ক্লাস নিতে হবে। স্ত্রীর ব্যস্ততা, ছেলের স্কুলের টিফিন বক্স নিয়ে। রিপন সাত বছরে পড়ল। নতুন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আসাদ বেরোবার মুখে হাতঘড়ি খুঁজে না পেয়ে ভীষণ বিরক্ত হলেন। কী আর করা, মোবাইলে সময় দেখে নেবেন।

সময়মতো ক্লাস শুরু করার ব্যাপারে আসাদ সাহেবের সুনাম আছে। ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য কিছুদিন জার্মানিতে ছিলেন। তখন থেকে সময়ের আরও বেশি গুরুত্ব দেন। এতে সময় অনেক বাঁচে।
—রুপা, আমার ঘড়িটা পাচ্ছি না। কোথাও দেখেছ? আসাদ সাহেব বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন।
স্কুলের সময়টা রুপা একটা ব্যাংকে অর্ধেকবেলা কাজ করেন। বিকেলে ছেলের ঘরে সম্ভবত গোছানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বললেন, টয়লেটে দেখো, হয়তো ওখানে অজু করতে গিয়ে রেখেছ। বলতে বলতে রিপনের দিকে তাকালেন। দৌড়ে রিপন তার বালিশের নিচে থেকে ঘড়ি বের করে বলল, যাও, তাড়াতাড়ি আব্বুকে দিয়ে এসো।
সন্ধ্যায় রুপার ছোট বোন রীমা বেড়াতে এসে একটা দুঃসংবাদ দিল। ওর দেবরের তালাক হতে পারে। রীমার জা শ্বশুর বাড়ি থেকে বেশ কিছু দিন হলো বাপের বাড়িতে আছেন। কারণগুলো অদ্ভুত। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিনি ইচ্ছানুযায়ী জিনিসপত্র নাকি তার বাবা মায়ের ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেমন বিয়েতে পাওয়া গয়না, শাড়ি ইত্যাদি। এ ছাড়া নাকি শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা না করে তার দামি শাড়ি পরে বেড়িয়ে গেছেন। অদ্ভুত বাজে অভ্যাস।
রীমা রুপাকে বলল, আপু, আমি মিলনকে বললাম, ওর ছোট ভাইকে কারণ জিজ্ঞাসা করতে। মিলন ভীষণ রেগে বলে, যে মেয়েকে বিশ্বাস করা যায় না, সৌজন্যবোধ শব্দটার অভাব, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাই ঠিক সিদ্ধান্ত। এরা পুরো বিষয়টি নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করছে!
রুপার মনটা একটু খারাপ হলেও, নিজেকে ছেলের শাশুড়ির জায়গায় বসিয়ে ভাবতে লাগল। মনে ভাবল সত্যি ভীষণ রকমের অভদ্রতা, কারও জিনিস না বলে নেওয়া।
রিপন তার লেগো নিয়ে খেলছিল। রীমা চলে গেলে রুপা ছেলেকে আদর করে কাছে ডেকে বললেন, না বলে আর কখনো কোনো জিনিস নেবে না। সব সময় জিজ্ঞাসা করবে, কেমন? ঘড়িটা খুঁজতে কত সময় নষ্ট হলো আজ!
ছুটির দিন আসাদ সাহেব বিকেলে আরামকেদারায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রুপা বুঝি রিপনের স্কুল ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন। হঠাৎ বকাবকি শুনে বললেন, আহা, ওকে বকছ কেন?
আবার অন্য কারও খেলনা ওর ব্যাগে—চিৎকার করে বললেন রুপা।
বহুকাল ধরে পুষে রাখা কষ্ট বুকের ভেতর মোচড় দিল আসাদ সাহেবের। আজ আর দুই চোখে ঘুম নেই। চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পেলেন, এক বাড়িতে ছোট্ট একটা ঘরে অনেক জিনিসপত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিলেন। তার তখন বয়স কত হবে? বড়জোর সাত অথবা আট। কিন্তু মনে হচ্ছে গতকাল।
তার ভাবি প্রায়ই তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ভাবির বাপের বাড়িতে। নিজের মা শয্যাশায়ী, প‍্যরালাইজড। ওই বাড়িতে সবাই বয়সে বড়। সারা বাড়িতে যে যার ঘরে ব্যস্ত। ভুল তিনি করেছিলেন, অনেক বড় ভুল। হয়তো কৌতূহল! হয়তো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ! হঠাৎ ওই ছোট্ট কোণার ঘরে ভাবির এক বোন খুব জোরে বকা দিয়ে বলল—এগুলো পকেটে কেন ঢুকিয়েছ?
কিছু স্টাম্প। কারও অতি শখের, অতি যত্নে বহু বছরের পরিচর্যায় টিনের বাক্সে রাখা, একটা ঘড়ি, কারও পুরোনো স্মৃতি, একটা নেইলকাটারের নিকেলের রিংটা, একটা চশমা। পকেট থেকে টেনে টেনে জিনিসগুলো বের করে তিনি কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেন ঢুকিয়েছ এগুলো?
তখন এর উত্তর তার জানা ছিল না। ওই বাড়িতে আর কোনো দিন পা দেননি, কোনো দিন কারও সামনে যেতে লজ্জা পেয়েছেন।
আসাদ সাহেব শুনতে পেলেন রিপনের কান্নার শব্দ। স্ত্রীকে ডেকে বললেন, থাক না, খেলনাটা কাল তুমি স্কুলে ফিরিয়ে দিয়ে এসো।
তারপর রিপনকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, আব্বু, শুধু তোমার নিজের জিনিস নেবে। অন্যের জিনিস ধরবে না। লোকে ভালো বলবে না, কেমন? তোমার প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে, কেউ নিয়ে নিলে তোমার খারাপ লাগবে না?
রুপা বলল, এটা আর কখনো করবে না, তাহলে কেউ তোমাকে ভালো বলবে না, আদর করবে না।
রিপন মায়ের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিল।

এ্যানা রাজ্জাক আলী: জার্মানি।