মা হওয়া এত সহজ নয়!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নিউইয়র্ক শহরে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের লোকজন বসবাস করেন। এই শহরেই অনেক বছর ধরে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে পৃথিবী নামক গ্রহের বেশ অনেক দেশের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।

কয়েক মাস আগে ছোট্ট একটি মেয়ে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দোকানে ঢুকে আমার কাছে বিশেষ এক ধরনের ব্যাটারি কিনতে চাইল তার স্কুলের প্রজেক্ট বোর্ডের জন্য। সেই ব্যাটারি আমার দোকানে ছিল না। আমি না বলার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির মা তাকে ধমকানো শুরু করেছে এবং সোজা বলে দিয়েছে সে অন্য কোনো দোকানে আর যেতে পারবে না ওই ব্যাটারি খুঁজতে। মেয়েটি কান্না জড়ানো কণ্ঠে এবার তার মাকে বলল, আগামীকাল প্রজেক্ট বোর্ড জমা না দিলে মেয়েটিকে তার শিক্ষক সামার ক্লাস দিয়ে দেবে শাস্তি হিসেবে। সামার ভ্যাকেশনে মেয়েটির বন্ধুরা যখন আনন্দ করবে তখন মেয়েটিকে ক্লাস করতে হবে। মেয়েটির এই কথা শুনে এবার তার মা আরও রেগে উচ্চ স্বরে অকথ্য ভাষায় আজেবাজে কথা বলা শুরু করে মেয়েটিকে। মায়ের ধমক ও গালিগালাজ শুনে মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে আমার সামনে থেকে আর আমি বোবা চোখে মেয়েটির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অপলক।
মনে মনে ভাবছি, এ কেমন মা? মা কী করে সন্তানের প্রতি এত নিষ্ঠুর হয়? মা কী করে সন্তানকে বাজে কথা বলে? মা কীভাবে সন্তানকে ভালো কাজে কাঁদায়? এসব ভাবনায় জর্জরিত আমি হারিয়ে গেলাম আমার ছোটবেলায়।
আমার মাকে দেখেছি সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে মাঝরাত পর্যন্ত আমাদের ভাইবোনদের পড়ার টেবিলে বসে থাকতেন। আমার মায়ের মুখে জীবনে একটা খারাপ ভাষা বা গালি শুনেছি বলে সত্যিই আমি মনে করতে পারছি না। আমাদের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়। কোনো দিন আম্মাকে তার বোনের বাড়ি বা বাবার বাড়িতে এক রাত থাকতে দেখিনি। আম্মার সমগ্র সত্তা জুড়ে ছিলাম শুধু আমরা সন্তানেরা। সকালে আমাদের ভাত খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে আম্মা সারা দিন উপোস থেকে কাজ করতেন বাড়িতে।
এখানে মাদারস ডেতে আমাদের দোকানগুলোতে প্রচুর ভিড় হয়। এই বিশেষ দিনে সবাই তাদের মায়েদের জন্য ফুল, কার্ড, উপহার সামগ্রী কিনতে আসেন। সদ্য গত হওয়া মাদারস ডেতে আমি যে দোকানটিতে কাজ করছিলাম সে দোকানের প্রায় অর্ধেক উপহার সামগ্রী ও কার্ড যে ছেলেটি আমার সঙ্গে বারবার এসে দর-কষাকষি করে কিনে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে আমি চিনি। ছেলেটিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি রাতদিন। আমার স্বামীর কাছে শুনেছি ছেলেটি গোপনে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তামাক জাতীয় অবৈধ জিনিস বিক্রি করে কম দামে। ছেলেটি আমাকে মা বলে ডাকে, পথে দেখা হলেই হাত তুলে খুবই সম্মান করে।
ছেলেটিকে এত দামি সব উপহার কিনতে দেখে জানতে চাইলাম, কার জন্য তুমি এত উপহার কিনছ? কেন বারবার এসে আমাকে দাম কমানোর জন্য বিরক্ত করছ? উত্তরে ছেলেটি তার মাকে গালি দিয়ে বলল, তার মায়ের সঙ্গে কয়েকজন আত্মীয় ও বান্ধবী আছে তাদেরকেও আজকের এই বিশেষ দিনে উপহার দিতে হবে। ছেলেটির মুখের এমন অমার্জিত উত্তর শুনে আমি এবারও অবাক হয়ে বোবা চোখে হা করে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম।
কয়েক দিন আগে ছেলেটিকে পথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে ডেকে নিয়ে কিছু সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললাম একাকী। কথা শেষে বুঝলাম, ছেলেটির আজকের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের জন্য তার মা দায়ী।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছোটবেলা থেকেই ছেলেটি পরিবারে অবহেলিত। সে কোনো দিন মায়ের ভালোবাসা পায়নি। ছেলেটি আমাকে তার মায়ের সঙ্গে জড়ানো একটা সুখস্মৃতির কথাও বলতে পারেনি। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ছেলেটি একা স্কুলে যেত, ঘুমাত, খেত ও গোসল করত। ছেলেটির মা শেখায়নি তাকে কীভাবে ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়। কোনো দিন ছেলেটিকে বেড়াতে নিয়ে যায়নি পার্কে বা অন্য কোথায়ও। কোনো দিন আদর করে ছেলেটিকে জামা পরিয়ে দেয়নি তার মা। ছেলেটির মা বাইরে থাকত বেশির ভাগ সময় আর বাসায় ফিরে ছেলেটি ঘরের সব কাজ সঠিকভাবে না করলে চিৎকার চেঁচামেচি করত। মাঝরাতে হই হট্টগোলে ঘুম ভেঙে ছেলেটি দেখত তার মা নেশায় আসক্ত অন্য বন্ধু–বান্ধবীদের সঙ্গে। ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই তার মায়ের মাধ্যমেই সমাজের সকল অনৈতিক ও অন্যায় কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়।
ছেলেটির জীবনের গল্প শুনতে শুনতে আমার শরীর, মন কষ্টে অবশ হয়ে এসেছিল। চোখের পানি খুব দ্রুত মুছে নিয়েছিলাম ছেলেটি দেখার আগেই। ছেলেটি তার জীবনের প্রথম বিদ্যাপীঠ মায়ের কাছে থেকে যা শিখেছে সেভাবেই আজ সে তার মায়ের দেখাশোনা করছে। আম গাছে আম ধরে, জাম গাছে জাম, এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম।
মা হওয়া এত সহজ বিষয় নয়। মা হতে যোগ্যতা লাগে। গর্ভে ধারণ করলেই মা হওয়া যায় না। মা মানেই নিরাপদ আশ্রয়। মা মানেই গভীর মমতায় সন্তানকে সকল প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করে বুকে আগলে রাখা। সন্তানের প্রথম শিক্ষক মা যেভাবে তার সন্তানকে আদর্শিক ও নৈতিক ও শিক্ষায় দীক্ষিত করেন সেভাবেই সেই সন্তান গড়ে উঠবে ও জীবন ধারণ করবে। মায়ের ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ ভূমিকাই সন্তানকে আলোর পথ দেখাবে। সন্তানের মাথার ওপরে মাকে ছায়া হয়ে থাকতে হয় সারা দিনমান সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য।
দুনিয়াতে সবকিছুর ওপরে মা। মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশতকে সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু একজন মায়েরই। কীভাবে? তার সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মাধ্যমে।
মা হওয়া সত্যিই সহজ নয় কিন্তু, কঠিন ত্যাগ ও সাধনার বিষয়।

পলি শাহীনা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।