চিরশত্রু মায়া!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কাল রাগ করে দুটো প্লেট আর একটা গ্লাস ভেঙেছে সে। প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল। রগচটা মানুষ সে। যা মুখে আসে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে শুধু বলতেই থাকে। একটা পর্যায়ে যখন অপমান চরম শিখরে উঠল আমিও বাধ্য হলাম প্রত্যুত্তর দিতে। সে এক বিশ্রী প্রতিযোগিতা। একজনকে কথায় আর চিৎকারে হারাতে পারলেই যেন আরেকজনের উদ্দেশ্য শিথিল হবে। যখন একপর্যায়ে বুঝতে পারল আমার যুক্তিতে সে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে তখন টেবিল থেকে দুটো প্লেট নিয়ে জোরে জোরে আছাড় মেরে ফেলে নিজের জেদটা প্রকাশ করল। আমিও শুনিয়ে দিলাম এ রকম আনকালচার্ড লোকের সঙ্গে আর একদিনও নয়। এই বিশ্রী সম্পর্ক বয়ে বেড়িয়ে নিজেকে আর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখব না আমি। বিয়ে হয়ে গেছে দেখে সেটা টিকিয়ে রাখা পরম ধর্ম মনে করে স্বামীর পায়ের পাপোশ হয়ে পড়ে থাকা আমার পোষাবে না।

সেও বীরদর্পে আরেকবার চেঁচিয়ে ঘোষণা করল, তাহলে চলে যাও। আমিও মরে যাচ্ছি না তোমার জন্য। যা খুশি করো, যেখানে যেতে চাও যাও। আই ডোন্ট কেয়ার! কান খুলে শুনে রাখো, আমি এবার মরে গেলেও সরি বলব না।

আমি তীব্র ঝাঁজের সঙ্গে বললাম, তোমার ওই এক পয়সা দামের সরির জন্য আমি বসে আছি নাকি? ওতে আমার অরুচি হয়ে গেছে। ছি, তোমার ওই সরি ময়লার বিনে ফেলারও যোগ্য নাই আর।

ব্যস অমনি আরেক দফা ঝনঝন শব্দ। তাকিয়ে দেখি এবার আমার পানি খাবার বড় গ্লাসটা শেষ। শখ করে কী সুন্দর ডিজাইনের এই গ্লাসটা কিনেছিলাম। সে খুব ভালো করে জানে এটা আমার প্রিয়। তাই ইচ্ছে করে নিজেরটা না ভেঙে আমারটা ভেঙে প্রতিশোধ নিল। আর থাকতে পারলাম না আমি। বললাম, জংলি, বর্বর...তোমার মতো ছোটলোকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ভাবতেও ঘেন্না লাগছে। তোমার মুখ দেখতে চাই না কোনোদিন।

জোর পায়ে এসে রুমে ঢুকে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো বাজে। ভয়ানক মেজাজ খারাপ লাগতে লাগল। পুরো পৃথিবী এখন বাঁধ সাধছে। এই রাতে বের হব কী করে? মানুষটা ইচ্ছে করে রাতে বেলাটাই বেছে নিল এ রকম জঘন্য ব্যবহার করার জন্য? কোন জন্মের শত্রু সে আমার কে জানে? মনের ভেতর হাজারো বিষ জমিয়ে রেখেছে আমার প্রতি। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। সেটা পেলেই ফণা তুলে ছোবল মারতে আসে।
নাহ, এভাবে সংসার করতে পারব না আমি। আজকে এটা মেনে নিলে কালকে আরেক ডিগ্রি বাড়বে। পরশু তারও বেশি। পুরো জীবন যাবে মেনে আর মানিয়ে নিতে। নো ওয়ে! হোক, সকালটা হোক। এবার ওকে একটা শিক্ষা আমি দেবই দেব। এমন করে সে পার পেতে পারে না। ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে এল। মানুষ কী করে এত বদলে যায়?
বিয়ের আগে কী পাগল ছিল আমার জন্য! আমি হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে না। আমি একটু মন খারাপ করলে দুনিয়া অন্ধকার দেখত। কী করে আমার মন ভালো করা যায় সেই চেষ্টা করত সারাক্ষণ।
ওকে শুধু বন্ধু হিসেবে দেখতাম আমি। আমার দিক থেকে কোনো প্রেম ছিল না। ওর ভালোবাসা আর পাগলামো দেখে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। আমাকে নিজের করে পেয়ে সে সেই দিন প্রতিজ্ঞা করেছিল সারা জীবন ঠিক এভাবেই ভালোবাসবে আমায়। কোনো দিন আমার কোনো অযত্ন করবে না। কোনো দিন আমার কোনো দুঃখের কারণ হবে না।

লেখিকা
লেখিকা

যে মানুষটার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল আমার হাসি মুখ দেখা সেই মানুষটা আজ আমাকে এভাবে কাঁদাচ্ছে? প্রচণ্ড অভিমানে আমার বলতে ইচ্ছা করল এই পৃথিবীর সব মিথ্যা। সব, সব, সব! ওর বালিশটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে ছুড়ে ফেলে এলাম। তারপর বেডরুমের দরজাটা শব্দ করে লাগলাম। যদিও জানি চাইলে বাইরে থেকে সে দরজাটা খুলতে পারবে। তবে আমি বালিশ দিয়ে আসার পর মনে হয় না আর এ রুমে আসবে।
মানসিক উত্তেজনায় ক্লান্ত ছিলাম। শোয়া মাত্রই ঘুম এসে গিয়েছিল। যখন উঠলাম দেখি সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। বুঝলাম সে অফিস চলে গিয়েছে। ভালোই হলো। সে থাকলে তার সামনে দিতে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আরও একবার ঝগড়া হতো। ঘর ছাড়ার মুখে কটু কথা শুনলে মনটা তিতা হয়ে যেত। এর চেয়ে ফাঁকা বাড়ি থেকে বের হওয়া বেটার।
ওঠার পর থেকেই মাথা ভার হয়ে আছে। জ্বর জ্বর ভাবটা টের পাচ্ছি। টেম্পারেচার দেখতে ইচ্ছে করছে না। দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে নেব নাকি? না থাক, চটপট কিছু জরুরি জিনিস ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বার হয়ে নেই, তারপর চা-পানি-ওষুধ সব খাওয়া যাবে।
চোখে মুখে পানি দিয়ে দ্রুত রেডি হলাম। ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিতে গিয়ে দেখি একটা প্লেটে দুটো স্যান্ডউইচ ঢেকে রাখা। পাশে এক প্যাকেট প্যারাসিটামল আর ছোট একটা চিঠি...।
চিঠিতে লেখা—
‘সকালে রুমে ঢুকে দেখলাম গভীর ঘুমে আছ, তাই ডাকিনি। স্যান্ডউইচ দুটো খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিয়ো। নিশ্চয়ই মাথা ধরে আছে? তোমারতো একটু অনিয়ম হলেই মাথা ধরে যায়। স্যান্ডউইচ ভালো হয়নি জানি, তবু যা পারি করলাম। গোল মরিচের গুঁড়া দিয়েছি স্যান্ডউইচে, ঝাল ঝাল খেয়ে দেখ ভালো লাগবে। খালি পেটে ওষুধ খেয়ো না আবার প্লিজ।’
পড়া শেষ করে একবার ভাবলাম ছিঁড়ে ফেলি চিঠিটা। জুতো মেরে গরু দান! নাম সম্বোধন ছাড়া চিঠি লিখে দেখানো হচ্ছে খুব কেয়ার আমার জন্য। ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি। গতকালের ঘটনার জন্য কোনো আক্ষেপ নেই, অপরাধবোধ নেই, উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এসেছেন উনি স্যান্ডউইচ আর ওষুধ খাওয়াতে। কী ভেবেছে এসব করলে আমি সব ভুলে যাব? এত সোজা?
ব্যাগ নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখি মেঝে পরিষ্কার। কখন উঠেছিল সে? এত কিছু করল কখন? ভাঙা কাচের টুকরোগুলো কী তাহলে রাতেই সরিয়েছে? ঘুমাল কখন আর উঠল কখন? আমি তো কোনো সাউন্ডই শুনতে পেলাম না।
মনটা কেন জানি হু হু করে উঠল হঠাৎ। এ রকম পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? আত্মসম্মান নিয়ে যে এখানে আর কোনোভাবেই থাকা যায় না। যে মানুষ নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না, যখন-তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আজেবাজে কথা বলে, নিম্ন শ্রেণির লোকজনের মতো চিৎকার দেয়, জিনিস ভাঙে, নষ্ট করে, সেই আবার মাথা ঠান্ডা হলে এমন অদ্ভুত সব কাজ করে যে তখন মনটা নরম হয়ে আসে।
মানুষটা বহুবার প্রমিজ করেছে আর রেগে উল্টোপাল্টা কথা বলবে না। বিশ্রী ব্যবহার করবে না। তবু সে সেটা বারবার ভুলে যায়। কিছুতেই কথা রাখতে পারে না। সেই অগ্নিমূর্তি দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না সে আমায় আর ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষকে কি এভাবে যখন-তখন আঘাত করা যায়? ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি দেখেও না দেখার ভান করে থাকা যায়? উঁহু, সে আর ভালোবাসে না আমায়। একসঙ্গে আছি হয়তো সেই বন্ধনটার প্রতি কিছু অনুভূতি অবশিষ্ট আছে তার...হয়তো আমি তার অভ্যাস পরিণত হয়েছি। আমি না থাকলে এত শত্রুতা কার সঙ্গে করবে? কাকে জ্বালাবে এত? কাকে কষ্ট দেবে?
আচ্ছা, আমিই বা কেন সব জেনেও ভেতর থেকে সায় পাচ্ছি না এভাবে চলে যাওয়ার? বিকেলে বাড়ি ফিরে খালি ঘরটা দেখে অস্থির হবে, একটা শাস্তি দিতে পারব এটা ভেবে তো আমার ভালো ফিল করার কথা। কিন্তু তার বদলে এত অস্বস্তি কেন লাগছে? তাহলে কী আরেকটা সুযোগ দেব? একটু অপেক্ষা করে দেখব এবার মন থেকে নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারে কিনা? সত্যি সত্যি নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করে কিনা?
ঠিক আছে, তাই হোক তবে।
দিন গড়িয়ে যায়।
উফ, আজ যেন অন্য দিনের চেয়েও বেশি দেরি করছে বাড়ি ফিরতে। কোনো মানে হয়? আবারও ইচ্ছে করে জ্বালাতে চাইছে! জানে দেরি করা আমি পছন্দ করি না তাই এমন করছে। ওহ, তার মানে কালকের রেশ এখনো আছে? প্রতিশোধ নেওয়া এখনো শেষ হয়নি। ওই ওষুধ, খাবার এগুলো সব প্ল্যান ছিল আমাকে বাসায় আটকে রাখার জন্য। যেন আরেকটু বেশি করে আমাকে কষ্ট দিতে পারে। আর আমি বোকার হদ্দ, ভেবে বসে আছি এবার হয়তো তার মধ্যে অনুশোচনা হবে।
ঠিকই আছে, আমার মতো ইডিয়টের সঙ্গে এমনি হওয়া উচিত। ঘরে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম, যেতাম। তা না, পুরোনো আমলের সিনেমার নায়িকাদের মতো ঢংয়ের কল্পনায় মজে গেলাম। আমি নিজেই আসলে একটা অসহ্য!
বেল বাজল অবশেষে। একরাশ রাগ আর তিক্ততা নিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দেখি মুখ কাঁচুমাচু করে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—কি হয়েছে?
চেহারার দুঃখী দুঃখী ভাবটা আরও প্রকট হলো তার....মুখটা করুন করে আমার হাতে একটা প্যাকেট দিল।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? আর এটা কি?
বলল, আমি অনেকগুলো দোকানে খুঁজলাম। ওটার মতো পেলাম না।
কি পেলে না? কি বলছ এসব?
বিশ্বাস করো। সত্যি অনেক খুঁজেছি। ওই ডিজাইনটা আর দেখলাম না কোথাও। এটাই শুধু অনেকটা ওই রকম লাগল তাই এটা কিনেছি। প্লিজ রাগ করো না। আমি নেটে খুঁজব এবার। কোথাও না কোথাও ওটা পাওয়া যাবেই। তখন আবার কিনে দেব তোমাকে।
প্যাকেট খুলে দেখি একটি গ্লাস। কিম্ভূতকিমাকার এক ডিজাইন। অন্য সময় হলে হয়তো রাগই হতো কিন্তু এখন মনটা বিষণ্ন বেদনা বিধুর হয়ে গেল। পুরুষের অসহায় মুখ বড়ই মায়াময়। কিছুটা দুর্লভও বটে। আর তাই বুঝি উপেক্ষা করা এত কঠিন। তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করে অতীতে মেয়েদের দুর্বল করেছে। ভবিষ্যতেও করবে। আমি খুব ভালো করে জানি, ও আবারও আমাকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেবে। মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করবে। আমার হতাশার কারণ হবে। বুঝে না বুঝে অপমানও করবে। তবু ওই করুণ মুখটা দেখে বারবার আমার ওর কাছেই রয়ে যেতে ইচ্ছে করবে, বিশ্বাস করতে মন চাইবে।
লোকে বলে এটাই ভালোবাসা।
আমি বলি মায়া।
অদ্ভুত শক্তিশালী এক মায়া।
আমি যে ভালোবাসার সংজ্ঞা জানি তার সঙ্গে তো এটা মেলে না...মেলে হৃদয় আর্দ্র করা মায়ার সঙ্গে।
ভালোবাসাতে তিক্ততা আসলে ভালোবাসা সৌন্দর্য হারায়, মিষ্টতা হারায়, গভীরতা হারায়।
কিন্তু মায়ায় কিছু হারানোর নেই, নষ্ট হওয়ার নেই।
ভালোবাসা দিয়ে বাঁধা না গেলেও মায়া দিয়ে ঠিকই মানুষকে বেঁধে ফেলা যায়।
বড় কঠিন জিনিস এই মায়া!
হায়রে মায়া...।
সবচেয়ে বড় শত্রুই এই মায়া...।
আবার পরম মিত্রও ঘুরে ফিরে সেই মায়াই...যুগে যুগে সম্পর্কগুলোকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে এই সর্বনাশি মায়া...।

সারা বুশরা: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী।