একটি গান ও উৎসর্গের বয়ান

উৎসর্গ কথাটির সঙ্গে একটা স্বর্গীয় ব্যাপার জড়িয়ে আছে। শব্দের ঝংকারে ও ভাবের ফুৎকারে। শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ব্যক্তিগত জীবনের ছেলেবেলার স্মৃতি। ছোটবেলায় সকাল হলেই মা বলতেন, ফুলগুলো ভালো করে ধুয়ে মন্দিরে উৎসর্গ করে আসো। আর এটি ছিল আমার খুব প্রিয় একটি কাজ। আগেই বলে রাখি আমার আজকের এ লেখাটি অনেকের কাছে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত বলে মনে হবে। তবুও শিবের গীতই গাইতে চাই।

অটোয়ায় আমার প্রবাস জীবনের প্রিয় বন্ধু শাহীনুর ইসলাম একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি, লেখক, গীতিকার ও সুরকার। তিনি হঠাৎ করে তার নতুন একটা গান আমাকে উৎসর্গ করে বসেন। আর তাতেই আমার এ শিবের গীত। এমনিতে আমার লেখার অভ্যাস নেই বললেই চলে। যদি-বা ফেসবুকের বদৌলতে অনেকের মতো ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে তা হাই/হ্যালো/লাইক/কমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ফিরে আসি উৎসর্গে। স্কুলে যখন গল্প-উপন্যাসের বই পড়া শুরু করেছিলাম, তখন দেখতাম সুন্দর প্রচ্ছদ পাতার পর শাদা ধবধবে উৎসর্গ পাতা। আর তাতে লেখক তার প্রিয়জনকে উৎসর্গ করে কিছু লিখতেন। সে কথাই মনে পড়ে যায়।
এবার ফিরে আসি যাকে কেন্দ্র করে এই শিবের গীত, সেই শাহীনুর ইসলাম প্রসঙ্গে। তার সাথে পরিচয় হয় ২০১৪ সালের জুলাইয়ের শেষদিকে অটোয়া ডাউনটাউনের বাইওয়ার্ড মার্কেটে। আমার এক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সঙ্গে। জানতে পারলাম, তিনি বাঁশি বাজান আর লেখালেখি করেন। আর অমনি বুঝি ছলাৎ করে আমার ঢেঁকিতে পা পড়ে গেল। কেননা অটোয়ায় আসার পর দুই-তিন সপ্তাহের একাকিত্ব আমাকে হাঁপিয়ে তুলেছিল। ঢেঁকিতে ধান ভানা কথাটি বলতেন আমার ফেলে আসা বন্ধুরা, কিছুটা অপবাদের সুরে প্রবাদের বাণীতে—‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’।
অবশ্য অটোয়াকে তখন আমি স্বর্গ বলব নাকি অন্য কিছু সে হিসাব মেলাতে পারিনি তখনো। এই যাযাবর জীবনে অভিবাসনের সিদ্ধান্তটি যখন নিয়েছিলাম, তখন কানাডাকেই বেছে নিয়েছিলাম। আর শহর হিসেবে ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী গান—‘আমি এক যাযাবর...’। এর মাধ্যমে পূর্ব পরিচিত অটোয়া শহরকে বেছে নিয়েছিলাম। যদিও পরে শুনেছি এ শহরকে অনেকে মৃত শহর বলে। কিন্তু আমি বলি ছিমছাম নীরবতা ও আভিজাত্যে গড়া রাজধানী শহর-অটোয়া। আর এখন তো সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ডে বলা যায় ভরপুর।
আমার এই স্বর্গ বনাম উৎসর্গের পেছনে রয়েছেন শাহীনুর ইসলাম। তিনি অনেকের মধ্যে অন্যতম, যাদের বন্ধুত্বের সান্নিধ্যে এই অটোয়া শহরে নিকটজনদের ছেড়ে সাড়ে তিন বছর আমার নিবাস। প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতায় একটু সময় পেলেই বাঁশি আর ছোট ডুগডুগি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম ব্রিটানিয়া বিচ, মুন্নিজ বে, রিডো ফলস, পিট্রি আইল্যান্ড, পার্লামেন্ট হিলস ইত্যাদি ইত্যাদি জায়গায়। অথবা সেই বাইওয়ার্ড মার্কেটে। দেখা হলে নতুন সুর, নতুন গান নিয়ে আলোচনা-পরামর্শ হতো। আমার হলো সবকিছুতেই সাধুবাদ বা মঙ্গল মঙ্গল। কেননা আমি তো ভাবি যে, প্রবাসের কঠিন বাস্তবতায় মাতৃভূমির চিরচেনা পরিবেশের ভাবনা লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা দুরূহ কাজ। আবার তাও যদি হয় গান ও সুরে। সে রকমই একটি গান তিনি আমাকে উৎসর্গ করেন। সবার জন্য পুরো গানের কথা এখানে শেয়ার করছি:
‘তোমার হাতে দিলাম ইছামতী নদী
ইচ্ছে হলে সাঁতার দিয়ো
আমায় না হয় গেলেই ভুলে
জন্মান্তরের মতো।
গলায় দিলাম তারার মালা
আলোক-সভার রাত
অধরে রইল ভোর জাগানো
সোহাগের ধারাপাত।
ইচ্ছে হলে পড়ে নিয়ো
কী ব্যথায় জাগে ফের ভালোবাসা
তারার কাছে জানিও।।
পাহাড়চূড়ার বুনো ফুলে
দিলাম কপাল ছুঁয়ে
নয়ন ভরালাম গাঙচিল মনের
জলের স্বপ্ন দিয়ে।
ইচ্ছে হলে ভাসিও
আবার ভালোবাসিও
কেন জাগে ফের পাওয়ার আশা
জলের কাছে শুনিও।।
গানটি আপনারাও শুনতে পারেন এই ওয়েবসাইটটিতে: <gaan.musitrature.com/ইছামতী-নদী>
‘ইছামতী নদী’ গানটি শুনতে শুনতে আমি যেন হারিয়ে যাই আমার কৈশোরে, আর ফিরে পাই গ্রামের স্মৃতি। আন্দোলিত হই মেঠো সুরের মূর্ছনায়। হলফ করে বলতে পারি, এ অনুভূতি হতে পারে আপনারও।
ঘটনাবহুল এই সময়গুলোতে আমার ঝুলিতেও পুরতে থাকল বাংলা ক্যারাভান, বাংলা-টিভি. সিএ, বাংলা বাজার-এর মতো কিছু সৃজনশীল উদ্যোগ। আর জড়িয়ে পড়লাম অ্যালাইভ এডুকেশন (AlivEducation) এবং পিসের (PEACE) মতো শিক্ষামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। অজান্তেই আরও জড়িয়ে গেলাম অটোয়ার বাংলা ও মূলধারার সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। এসব কাজে জড়িত থেকে আমি যে আনন্দিত হই তার উৎস রয়েছে তরুণ বয়সে লালিত-পালিত সংশপ্তক-এর মূলমন্ত্রে ‘বিরাজিত থাক সুষ্ঠু সংস্কৃতি, বিকশিত হোক সুপ্ত প্রতিভা’। পাশাপাশি নিজেকে নির্মাণের সুযোগ লাভ করছি-এও বা কম কীসে। আর এসব কাজে আমার এই বন্ধুটির অনুপ্রেরণাও সাহস জুগিয়েছে নিরন্তর।
জয় হোক বন্ধুতার! জয় হোক বন্ধু শাহীনুর ইসলামের সৃজনশীল লেখা ও সুরের!

সৌরভ বড়ুয়া: অটোয়া, কানাডা।