ওহ, ঠান্ডা!

ওয়াটারটন
ওয়াটারটন

পত্রিকা দেখলেই ঠান্ডা লাগে। হোটেল রুমে হিটার চালিয়ে বসে আছি। শীত শীত অনুভূতি আছে তবে তীব্রতা গায়ে লাগছে না। কিন্তু অনলাইনে প্রথম আলো খুলে যখন দেখি, ‘কানাডায় রেকর্ড শীত পড়েছে’—সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ঝুপ করে কম্বলের নিচে ঢুকে যাই। জানালা দিয়ে রাতের পরিবেশ দেখছি আমরা—সঙ্গে আমার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে আছে। অবিরাম তুষারপাত হচ্ছে। নববর্ষ আসার দিন কয়েক আগে বরফ-ঠান্ডা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। গত আট বছরের ক্যালগেরি বসবাসে এতে অবাক হওয়ার কী আছে?

তবে এবার আবহাওয়ার খবর ভালো ছিল না। ভয়াবহ শীত আর তুষারপাত আসছে জেনে আমাদের রোমাঞ্চপ্রিয়তা জেগে ওঠে। কিছু একটা করতে হবে। নীরস ক্যালগেরি বসে থাকার কোনো মানে হয় না। অগত্যা আমেরিকার সীমান্ত-লাগোয়া ওয়াটারটন লেকে যাত্রা। পরিচিতজনেরা চমকে ওঠেন—‘এই শীতে ওয়াটারটন?’ আমরা হাসি, ‘এখনইতো যাওয়ার সময়!’
হোটেল বুকিং দিয়ে যাত্রা শুরু ভোরেই। ওয়াটারটন পৌঁছে সকলের চক্ষু চড়কগাছ। পুরো শহর প্রায়-মৃত বলা যায়। দুটি মাত্র লজ খোলা আছে। অল্প কিছু টুরিস্ট আছেন, যাদের রক্তে আমাদের মতো ভ্রমণ নেশা রয়েছে। বিশাল লেকটা বরফের স্তূপ হয়ে আছে। রাস্তাঘাটে বরফের রাজত্ব হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর ধরে ফেলে প্রায়। সহসাই আমার প্রিয় মানুষটার কথা মনে হয়।
ভদ্রলোক ছিলেন চরম রোমাঞ্চপ্রিয়। ঘুরে বেড়াতেন মনের আনন্দে, স্ত্রী-ছেলেমেয়েসহ। শতবর্ষ আগের কথা বলছি। তিনি বের হয়েছেন কানাডিয়ান রকির পেটের দিকে। সঙ্গে তাঁবু-টাবু নিয়ে যাত্রা-প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য করতে করতে যাবেন, যত দূর চোখ যায়।
বেশ কদিন হয়ে গেছে ঘুরতে ঘুরতে। পরিবারের সবাই ক্লান্ত। ইতিমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে বেশ, কনকনে ঠান্ডা। সূর্য ডোবে ডোবে-ভদ্রলোক থামেন। তাঁবু গাড়তে হবে। পরিশ্রান্ত সকলে, বড় ছেলেটি বলে, ‘আজ রাতটা কাছের কোনো হোটেলে থাকি।’ ভদ্রলোক নাছোড়, ‘না, তাঁবুতেই থাকব।’

ওয়াটারটন
ওয়াটারটন

ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যেই তাঁবু টানিয়ে কোনোমতে শুয়ে পড়েন সকলে, ভীষণ ক্লান্ত। কাকভোরেই ঘুম ভাঙে ছেলেটির। চেন টেনে তাঁবুর দরজা খুলেই চোখ ছানাবড়া-চারিদিক সাদা তুষারে আবৃত। যত দূর চোখ যায় শুধুই সাদা। অপার্থিব সৌন্দর্যে অভিভূত ছেলেটি চিৎকার করে ওঠে, ‘ড্যাডি, আমরা তুলার মধ্যে ডুবে গেছি।’ ছেলেটি তার আত্মকথায় লিখেছে, ‘সেদিন তাঁবুতে না থাকলে বড় ক্ষতি হয়ে যেত। সেই সকালের দৃশ্য দেখে প্রকৃতির মায়ায় পড়ে গেছি। আজও সেই মায়ার টানেই ঘুরে বেড়াই।’
আমরা ঠিক অতটা পারি না। রাতটা তাই তাঁবুতে থাকা হয়নি। সকালে ওয়াটারটন লেক রিসোর্টের রুম থেকেই গাড়ি স্টার্ট দিয়েছি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে। মিনিট দশেক পরে হোটেল রুমের দরজা সবে খুলেছি, সেই ভদ্রলোকের কথা বেশ মনে হলো। আহা প্রকৃতি! মনের অজান্তেই বলে ফেলি ‘তোর শীত-গ্রীষ্ম সব ভালোবেসে ফেলেছি, প্রিয় রকি মাউন্টেন।’

আবু সাইদ লিপু: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।