মেধাবীদের কত দিন দূরে রাখবে দেশ?

ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

রইস উদ্দিন (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণ গবেষক আমার পরিচিত। তিনি ম্যাটেরিয়াল কেমিস্ট্রি নিয়ে কাজ করেন। গবেষণায় তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। তাঁর কাজের মানে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। এই তরুণের গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নাল ও এঙ্গুভান্টে কেমিসহ রসায়নের জগৎখ্যাত জার্নালে। এসব জার্নালে প্রকাশনাই তাঁর যোগ্যতাকে তুলে ধরে। কোরিয়া থেকে পিএইচডি করা এই তরুণ বর্তমানে সেখানেই পোস্টডক করছেন।

এই তরুণ বাংলাদেশে কাজ করতে চান। শুধু দেশে থাকার ইচ্ছে থেকে তিনি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনও করেছেন। দূরদেশ থেকে ইন্টারভিউ দিতেও দেশে গিয়েছেন। তাঁর মুখে সেখানকার নিয়োগ পরিস্থিতির কথা শুনে বিস্মিত হয়েছি। লজ্জায় ও ক্ষোভে নির্বাক হয়েছি। এই তরুণের এত যোগ্যতা থাকার পরও তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়নি। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেখানকার শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীকে, যাদের কোনো পিএইচডি ডিগ্রি নেই। নিয়োগ কর্মকর্তাদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে হয়, তাঁর চেয়ে যোগ্য প্রার্থী কি তারা পেয়েছিলেন? একজন প্রার্থীর যোগ্যতাকে তারা মূলত কীসের মানদণ্ডে যাচাই করেন? মেধা নাকি অন্য কিছু দিয়ে?

‘দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে এলে আর ফিরে যায় না’—এই যে ধারণটা প্রচলিত আছে, সেটা ভুল! ভয়ংকর রকমের ভুল! দেশের প্রচুর ছেলেমেয়ে ফিরতে চায়। নিজ ইচ্ছায় ফিরতে চায়। অনেকেই স্বপ্ন দেখে নিজের গবেষণার অভিজ্ঞতাকে দেশে কাজে লাগিয়ে তরুণ গবেষক তৈরি করবে। শুধু দেশে থাকার ইচ্ছে থেকে, বহু কিছু বিসর্জন দিয়েই ফিরে যেতে চায়। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেই রাষ্ট্রের। তাদের ফিরিয়ে নিয়ে সঠিক জায়গায় নিয়োজিত করার প্রকল্প নেই রাষ্ট্রের। বাংলাদেশে এখনো সেরকম কোনো কার্যকর প্রকল্প চালু করা হয়নি। সুতরাং, যেসব ছেলেমেয়েরা নিজের প্রচেষ্টা, শ্রম ও মেধা দিয়ে তাদের জীবনকে গড়েছেন, তাদের সাধুবাদ দিন। উৎসাহিত করুন। তাদের অভিযুক্ত না করে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে অনুরোধ করুন।

বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সারা দুনিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা গবেষণা ও শিক্ষকতা শুরু করতে পারেন। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও পারে। অথচ আমাদের দেশে তেমন নিয়ম-নীতি নেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রবেশের সুযোগ থাকলেও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ শুরুর কোনো সুযোগ নেই। কী বিস্ময়কর! চীন, কোরিয়া ও ভারতসহ দুনিয়ার বহু দেশ তাদের মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বহু প্রকল্প চালু করেছে। যেমন, চীনের উল্লেখযোগ্য এক প্রকল্পের নাম ‘থাউজেন্ড ট্যালেন্ট প্ল্যান’। প্রতিবছর সহস্র তরুণ গবেষককে বিভিন্ন গবেষণাক্ষেত্রে কাজ শুরুর জন্য অর্থ দেয় চীন সরকার। সেসব তরুণদের অবশ্যই বিদেশে গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বাংলাদেশে কী এমন প্রকল্প আমরা চালু করতে পারি না? দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিদেশ ফেরত তরুণদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারি না?

আমাদের দেশে বিসিএসআইআর, পারমাণবিক শক্তি কমিশন, পাট গবেষণা কেন্দ্র, ধান গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশ ফেরত মেধাবী তরুণদের নিয়োগ দিতে পারি। অথবা এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোই বিদেশ থেকে ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের সময় যদি উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়ে পাওয়া যায়, তাহলে তাদের নিয়োগ না দিয়ে কেন একজন কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হবে? এতে কি রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না? শিক্ষার্থীরা ভালো মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না?

রইস উদ্দিন একা নন। এমন বহু ছেলেমেয়েকে চিনি যারা দেশে ফিরতে চান। আমি নিজেও দেশে ফিরে তরুণ গবেষক তৈরির তীব্র ইচ্ছে রাখি। তবে আমাদের দেশ সেসব ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে নিতে চায় না। রইস উদ্দিনের বয়স একত্রিশ কী বত্রিশ। তার যথারীতি পিএইচডি ও পোস্টডক অভিজ্ঞতা আছে। দেশের টাকা খরচ করে তিনি এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। অন্যদিকে, রাষ্ট্র তার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সেখানকার শিক্ষকদের পিএইচডি করাবে অথচ রইস উদ্দিনের মতো গবেষককে নিয়োগ দিয়ে দেশের টাকা বাঁচাবে না। কী বিস্ময়কর! দেশের মেধাবীদের এভাবে আর কত যুগ দূরে রাখব আমরা-কেউ কি বলতে পারেন?

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>