অনিশ্চয়তায় আত্মসমর্পণ

ক্লিয়ারওয়াটার কাউন্টিতে ঢোকার রাস্তা
ক্লিয়ারওয়াটার কাউন্টিতে ঢোকার রাস্তা

পিছলে নেমে যাচ্ছি তো!

—কিচ্ছু হবে না। সর্বোচ্চ গতিবেগ আশি, গাড়ি এর মধ্যেই আছে। আমি আশ্বাস দিই।
—না, তুমি গতি কমাও। না হলে রাস্তা ছেড়ে জমিতে চলে যাব আমরা। স্ত্রীর ভয়ার্ত স্বর।
ভয় না পেয়ে উপায় আছে? ছোট্ট গাড়ি, টয়োটা একো। চার চাকার সিডানের চেয়ে ছোট হয় না, বাজি ধরে বলতে পারি। তবে ভীষণ কৃপণ গাড়িটা, তেল-খরচা নাই বললেই চলে। মাত্র আড়াই শ লিটারে টরন্টো থেকে ক্যালগেরি পার—পাক্কা সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার!
এখন অবশ্য অত দূরের রাস্তায় না আমরা। কাছাকাছি যাচ্ছি, আলবার্টার নয়নাভিরাম পর্যটন শহর জেসপার-মহামান্য রকির আঁচলের তলায়। পুরো পরিবার সঙ্গে; স্ত্রী-ছেলেমেয়ে। অবশ্য গল্পটা জেসপারের নয়। এত ঢের শুনেছি! পাঠক, আসুন জেসপার যাত্রাপথের গল্পটা শুনি। ক্যালগেরি থেকে বের হয়ে মহাসড়ক ১ আর ৯৩ ধরে চট করে সাড়ে চার ঘণ্টায় জেসপার। আরে! গল্প কোথায়? এত হরহামেশাই ঘটছে! ঠিক ধরেছেন, এখানে কোনো গল্প নেই। তাই এ কাজ আমরা কস্মিনকালেও করি না। নিশ্চিততায় আমাদের রোমাঞ্চ জাগে না। আমরা অনিশ্চয়তার পূজারি। ওতেই বেজায় আনন্দ পাই।

ক্লিয়ারওয়াটার কাউন্টি
ক্লিয়ারওয়াটার কাউন্টি

ক্যালগেরি থেকে মহাসড়ক ২২ ধরে ককরেইন পার হয়ে রকি মাউন্টেন হাউস শহর। এরপর মহাসড়ক ১১ ধরে ৯৩ হয়ে জেসপার। খারাপ না, মন্দের ভালো। তবে আসল গল্পটা কিন্তু আরও ভিন্ন। মহাসড়ক ১১ ধরেছি ঠিকই কিন্তু আরেকটি রাস্তা চুম্বকের টানে ডানে নিয়ে গেল। ওই যে অনিশ্চয়তার গোলাম হয়েছি। রাস্তাটি কোথায় যাবে তা জানি না। যেহেতু উত্তরে মুখ—একসময় জেসপারের আশপাশে যাবে বোধ হয়। মাবুদ, এত রাস্তা না!
জি, পাথুরে খোয়া বিছানো। এমনিতে আলগা পাথরের টুকরা তার ওপরে ছোট্ট গাড়ি—পিছলে পিছলে যায়। গিন্নির ভয় না পেয়ে উপায় আছে? দুই ধারে মহান প্রেইরির বিরানভূমি। একটু পর পর নামকরা সব পেট্রোলিয়াম কোম্পানির তেল-গ্যাসের খনি। মাঝেমধ্যে বড় বড় সব লরি চলছে তেলখনির দিকে। ক্লিয়ারওয়াটার নদী পার হয়ে ইয়েলোহেড কাউন্টিতে পা দিয়েছি। পাহাড়ি রাস্তা ধীরে ধীরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। জনমানবহীন পাথুরে পথ ধরে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের পথে চলছি তো চলছিই। অনেকক্ষণ ধরে জনমানুষের চিহ্ন নেই কোথাও। শুধুমাত্র প্রকৃতির চোখ ধাঁধানো রূপ আর বন্য প্রাণীর বিচরণ আমাদের নিকট প্রতিবেশী। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় হরিণ, এলক, খরগোশ।
মেয়েটির অতি তৃপ্তির স্বর, আহ! এই রকমটাইতো চেয়েছিলাম বাবা।

ইয়েলোহেড কাউন্টিতে ঢোকার রাস্তা
ইয়েলোহেড কাউন্টিতে ঢোকার রাস্তা

পরবর্তী পাকা রাস্তা পেতে প্রায় এক শ বিশ কিলোমিটার চলতে হয় এভাবে। আর গন্তব্যে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। হোটেলে ঢুকে আমাদের চোখেমুখে অনন্ত প্রশান্তি। আমরণ মনে রাখার মতো কিছু একটা হয়ে গেল আজ।
স্ত্রী ফুসফুস খালি করা নিশ্বাস ছেড়ে বলে, ইস! যা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আবার যাই।
আমি অন্ধভক্তের মতো বলি, রকি এ রকমই। ধন্যবাদ, প্রিয় রকি মাউন্টেন।

আবু সাইদ লিপু: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।