অচেনা আড়াল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাত সোয়া দুইটা। বহুদিন কঠিন পাথরে চেপে রাখা এক জীবন্ত দৃশ্য অস্থির ঘুমে বিষণ্ন স্বপ্নের মতো রুপার চোখে ভেসে ওঠে। শয্যা ছেড়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন বলতে চেয়েও পারছে না আর। জিহ্বা যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। অতি নীরবে জানালার পর্দাটা সরিয়ে সে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। অষ্টাদশীর ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের পালুর জোছনা। তখন অদেখা দৃশ্যের মতো খেলা করে ধান কাটা মাঠে। রুপা কেবল চেয়েই থাকে। জীবনের ওই দুর্দম শক্তির কাছে আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগছে তার।

গতকাল ছিল খাঁ সাহেবের কুলখানি। ঢাকা থেকে আসা অতিথি আর এলাকার লোকজন আত্মীয়স্বজন মিলে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি লোকের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। ভোজ শুরু হয়ে যায় অবশ্য বেলা ১১টা থেকেই। বেলা ২টা থেকে শুরু হয় নারীদের আপ্যায়ন। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকালে পরলোকগত স্বামীশোক কিছুটা সামলে রুপা আগত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চলেছে। অতি নিকটাত্মীয়দের কারও কারও সঙ্গে বহুদিন দেখা নেই। এ উপলক্ষে সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। মনটা যেন সহজ হয়ে আসছে সবাইকে দেখে। এভাবে প্রতিটি ব্যাচে খাবার শুরুর পরপরই রুপা প্যান্ডেলের ভেতরটা একবার করে ঘুরে দেখছে।
বেলা সাড়ে তিনটা। তখন শেষ ব্যাচের আপ্যায়ন চলছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে রুপার দেখা হলো তার হাইস্কুলের শিক্ষক নুরজাহানের সঙ্গে। কী এক দূরসম্পর্কে আত্মীয়তার সূত্রে রুপা তাকে খালাম্মা বলে ডাকত। প্রায় পনেরো বছর পর দেখা।
একটা চেয়ার টেনে রুপা নুরজাহানের পাশে বসে জীবনের প্রিয়-অপ্রিয় নানা ঘটনা বলে যাচ্ছে। একের পর এক লোকমা মুখে দিতে দিতে নুরজাহান তার এই সাবেক ছাত্রীর গল্প বেশ আগ্রহ ভরেই শুনছেন। ঠিক তখনই রুপার চোখ পড়ল পাশে বসা খুব সাধারণ জামাকাপড় পরা মেয়েটির দিকে। চেহারা জুড়ে কষ্টের ছাপ। মনে হলো আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হওয়া মেয়ে। কিছু নেই ওর। তারপরও কী যেন আছে।
রুপা মেয়েটির দিকে তাকানোর পর নুরজাহান বললেন, নীলু, খেতে পারছিস তো?
—জি মা, খাচ্ছি।
রুপা নীলু নামটা শুনেই কেমন যেন চমকে ওঠে। আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করে, খালাম্মা, এই নীলু আপনার কে হয়?
কথা শেষ না হতেই নুরজাহান বললেন, মাগো, ছেলেমেয়ে সব স্থায়ী হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। তোমার খালুও নেই। একা বাড়িতে থাকি। এই ভেবে আমার বড় ভাই এনে দেয় এই নীলুকে। খুব ভালো মেয়ে। ছেলেমেয়েদের জন্য আমার মনটা কেমন করে। এখন নীলুই আমার মেয়ে। বেশ ভালোই আছিগো মা।
রুপা নীরব। কোনো কথা বলার ইচ্ছে করছে না তার।
নুরজাহান বলেই চলেন—মাগো, ছেলেমেয়ের অনুরোধে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে দুই বছর থেকেছি। ওখানে খুব ভালো ছিলাম গো মা। কেন যে দেশের জন্য মায়া লাগে। মন টেকে না। আর এখন দেশে থাকি, মায়া লাগে ছেলেমেয়েদের জন্য।
নুরজাহানের কথার প্রতি উদাসীন রুপা আরেকবার নীলুর দিকে তাকিয়ে তার আর সন্দেহ রইল না, এই সেই নীলু। সঙ্গে সঙ্গেই রুপার সারা শরীর কেঁপে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অতিথিদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ চেষ্টা করেও আর ধরে রাখতে পারল না সে। কাউকে কিছু না বলে রুপা নীরবে বের হয়ে বাড়ির অদূরে লিচুবাগানের ওই কাঠের বেঞ্চিটায় এসে বসে রইল।
বহুদূরে বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে হাওরের বুকে আসন্ন বর্ষার নতুন জল উঁকি দিয়েছে কেবল। নীল জলে কীসের যেন নিরাশা। নীরবে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। কিছু জীবন্ত দৃশ্য। অনেক বড় ঘরে বিয়ে হয় রূপসী রুপার। সুখ–শান্তি–স্বপ্ন–প্রাচুর্য–ক্ষমতা। আর আজ নিষ্ঠুর সময়ের আঘাতে সব একাকার হয়ে গেছে।
নীলু রান্নাঘরেই একটা ছোট্ট বিছানা পেতে থাকত। রাত দশটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত এই ছিল তার বিশ্রাম। সেই ১১ বছর বয়সের নীলু। বাবাকে সে দেখেইনি। আর একদিন যখন ওর মাও চলে গেল, এক আত্মীয়ের সূত্রে এই অসহায় মেয়েটার আশ্রয় জুটেছিল এই রুপার ঘরে। শারীরিক অক্ষমতার কারণে রুপার কোনো সন্তান নেই। ওই রকম কোনো সম্ভাবনাও নেই।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

খাঁ সাহেব চাকরিজীবী। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অনেক সম্পত্তির মালিক। তারপরও রুপার সামনে তার অব্যক্ত বাসনাটুকু শেষ পর্যন্ত অব্যক্তই রয়ে যায়। এভাবেই কেটে যায় বছরের পর বছর। নীলুর বয়স তখন প্রায় সতেরো বছর। একদিন মাঝরাতে নীলু হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে কেবল কেঁদেই চলে। অসময়ে ঘুম ভাঙা রুপা একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নীলু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না।
ডাক্তার ডাকা হলো। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রুপাকে নীরবে ডেকে নিয়ে কিছু কথা বলে যান ডাক্তার। পরদিন নিকটস্থ ক্লিনিকে নিয়ে খুবই সাবধানে অনাগত সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করা হয় নীলুকে। মাসখানেকের মধ্যেই নীলু সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু কেমন যেন নীরব, আতঙ্কিত মেয়েটা। মেশিনের মতো কাজ করে যায় শুধু। একদিন খাঁ সাহেব বাইরে যাওয়ার পরপরই রুপা নীলুকে খালি ঘরে ফেলে বেধড়ক পিটিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয়।
অচেতনের মতো বাইরে এসে নীলু চিরদিনের জন্য এ শহরকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় গ্রামে তার বড় মামার বাড়িতে। মামার চেষ্টায় কয়েক দিনের মধ্যেই নীলুর নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে আসে স্থানীয় হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এই নুরজাহানের কাছে। মনোরম বাউন্ডারিতে গোছানো নুরজাহানের বাড়ি। প্রাচুর্যের অভাব নেই। অভাব কেবল মানুষের।
নীলুকে পেয়ে তার কারও প্রতি আর কোনো অভিযোগ রইল না। আপন মেয়ের অভাবটুকুই যেন পূরণ করে এ নীলু। নুরজাহান বলেন, মা নীলু, তোর বিয়েশাদি হোক। এত বড় বাড়িটা পড়ে আছে। জামাইসহ এখানে থাকবি। সবদিক দিয়েই তোর ভালো হবে। কোনো ছেলেকে যদি মনে ধরে থাকে আমাকে বলিস। সব ব্যবস্থা করে দেব।
নুরজাহানের ছেলেমেয়েরাও এ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে নীলুকে সবদিক দিয়ে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়। অথচ নীলুর কাছে বিয়েশাদি নিয়ে কোনো কথাই বলা যায় না। সম্মতি তো দূরের কথা, কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে কেটে যাচ্ছিল দিন। এতিম মেয়ে। বিভিন্ন কারণে মনটা হয়তো ভাঙা। এমন সুন্দর মেয়ে। বিয়ে একদিন হবেই। এ আশায় থাকেন নুরজাহান। আর মনপ্রাণ উজাড় করে আদর করেন নীলুকে।
খাওয়া শেষে নুরজাহান আর নীলু তখন বেশ দূরে চলে গেছেন। পড়ন্ত বিকেল। লিচুবাগানে একাকী বসে রুপা কত কথাই না ভাবছিল। নীলুর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই তার বুকের ভেতর এক নির্মম ব্যাকুলতা তাকে হঠাৎ দিশেহারা করে ফেলে। রুপা খুব জোরে চিৎকার করে ডাক দেয়—নীলু!
না, রুপার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না।
বসা থেকে দাঁড়াতে গিয়েও আবার বসে পড়ে রুপা। অবচেতনের ভেতর অহংকারের কঠিন আস্তরণ ভেদ করে রুপা যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, রূপসী নীলু। পাশেই ফুটফুটে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন খাঁ সাহেব। তাদের ভেতর অনেক মায়া। অনেক ভালোবাসা। কী এক কোমল খেয়াল আজ অনেক অনেক কাছে নিয়ে এল জীবনের স্বপ্নকে।
আজ নিজেকে এত অপরাধী লাগছে কেন আমার? ওই অনাগত জীবন তো নিষ্পাপ ছিল। তাই না?
এমন আরও কত কথা যে মনে পড়ছে রুপার। ততক্ষণে নীলু দৃশ্যান্তরে মিশে গেছে। ঠিক তখনই রুপা আঁচলে চোখ মুছে মনে মনে বলে, আহা, আমার স্বামী। অনেক আশা করেছিল। ওই না মেটা সাধ পাথরের মতো বুকে চেপে মানুষটা চিরদিনের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে...।
কিছুক্ষণ আগে চাঁদ ডুবে গেছে। ঘরে-বাইরে অন্ধকার। দু-একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক চিৎকারে রুপা অন্ধকার পথে বের হয়ে পড়ে। আগেরদিন বিকেলে নীলু আর নুরজাহানের ক্রমে দৃশ্যান্তরে মিশে যাওয়া পথ অনুসরণ করে দেয় এক দৌড়। আজীবন অতি সতর্ক রুপা আজ পথহারা।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: