কল্পনা যেখানে অন্য রকম

লুভর মিউজিয়ামের সামনে লেখিকা
লুভর মিউজিয়ামের সামনে লেখিকা

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর মধ্যে একটি দেশ সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসে বাংলাদেশের কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক এবং আমাদের সবার প্রিয় লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন তাঁর দেশটি ভালো লাগেনি। না লাগার কারণ তিনি ছোট্ট দুটি লাইনে বলে শেষ করেছিলেন। তার মনে হয়েছিল যে, দেশটি বড় বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যেটা তার কাছে কৃত্রিম লেগেছে। তাঁর মতো সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের কাছে শুধুমাত্র এই একটি কারণে এত অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর একটি দেশ তার আকর্ষণ হারিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। কারণ আমার মতে, সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর। আমার নয় দিনের সফরে আমি পাঁচটি শহর ও বেশ অনেকগুলো গ্রামে গিয়েছি এবং প্রতিটা জায়গায় গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। এতটাই বিমোহিত অবস্থা ছিল যে, মনে হয়েছে নয় দিন এই দেশটির জন্য যথেষ্ট নয়। এখানে নব্বই দিন থাকলেও পরিতৃপ্ত মনে নিয়ে ফেরা হবে না। দেশটির প্রতি মুগ্ধতা কেবলই বাড়বে বই করবে না।

সূর্য ডোবার সময় আইফেল টাওয়ার
সূর্য ডোবার সময় আইফেল টাওয়ার

যা হোক, প্রশংসা বাক্য আর বাড়াব না। কারণ এটা আমার সুইজারল্যান্ডের ভ্রমণকাহিনি নয়। ভূমিকাতে এত কথা অন্য একটি কারণে লিখেছি। কারণটা এখন জানাই। হ‌ুমায়ূন আহমেদ স্যারকে যেমন আমার এই অত্যন্ত প্রিয় ও স্বপ্নের একটি দেশ (সুইজারল্যান্ড) মুগ্ধ করতে পারেনি ঠিক তেমনি পৃথিবীর একটি বিখ্যাত এবং অনেকের ভালো লাগার, ভালোবাসার একটি শহর, যার নাম প্যারিস, আমাকে মোহিত করতে পারেনি। আমার এই রচনাটি মূলত কেন প্যারিসে গিয়ে আমি হতাশ হয়েছি তার ওপরে। না, কারও মনে বিরূপ ভাব সৃষ্টি করার জন্য কিছু বলছি না। শহরটির বদনামও করছি না। একজন পর্যটকের জন্য শহরটিতে যথেষ্ট পরিমাণ দর্শনীয় বস্তু রয়েছে সেটা নিয়েও আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমি শুধুমাত্র আমার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। এখানে কাউকে কষ্ট দেওয়া বা কারও পছন্দকে ছোট করা কোনোভাবেই আমার উদেশ্য নয়।

রাতের আইফেল টাওয়ার
রাতের আইফেল টাওয়ার

কবি সাহিত্যিকেরা বরাবর প্যারিসকে পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক শহর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কত বিখ্যাত সব কবিতা, গল্প রয়েছে এই প্যারিসকে নিয়ে। আমার মতো যারা হোপলেসলি রোমান্টিক তারা সেসব লেখা পড়ে যুগে যুগে প্রভাবিত হয়ে আসছেন। তারা তাদের কল্পনায় প্যারিসকে প্রেম ও প্যাশনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নিজের মনে প্যারিসের এক অন্যরকম ছবি সাজিয়ে রাখেন। তাদের জীবনের পাঁচটি সবচেয়ে দ্রষ্টব্যস্থানগুলোর মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্যারিস থাকে। আর সেখানেই আসল ভুলটা হয়। প্যারিস মানে অসম্ভব রোমান্টিক কিছু বা কোনো স্বপ্নের শহর—এ রকম ধারণা নিয়ে না গেলে প্যারিস ভালো লাগবে। বেশ ভালো লাগবে। বিশেষ করে যারা ইউরোপের বাইরে থাকেন তাদের জন্য প্যারিস পছন্দ করার মতো একটি শহর। ইউরোপ বসবাসকারী মানুষদের কাছে আহামরি বা নতুন কিছু না লাগা কিছুটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বাইরে থেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য প্যারিসে আকর্ষিত হওয়ার এলিমেন্টের অভাব নেই তা আমি স্বীকার করছি।

আইফেল টাওয়ার থেকে তোলা প্যারিসের এক দিকের ছবি
আইফেল টাওয়ার থেকে তোলা প্যারিসের এক দিকের ছবি

যারা ইতিহাস পছন্দ করেন প্যারিস তাদের জন্য আদর্শ স্থান। লুভর মিউজিয়ামে গিয়ে আলোড়িত না হয়ে পারা যায় না। প্যারিস আসা তখন সার্থক মনে হবে। আইফেল টাওয়ার দারুণ একটা জিনিস এ বিষয়েও মতান্তর নেই। আমার নিজেরও ভালো লেগেছে। বিশেষ করে রাতেরবেলা প্রতি এক ঘণ্টা পর পর যে অদ্ভুত সুন্দর লাইটিং হয় ওটা মুগ্ধ হওয়ার মতো। আইফেল টাওয়ারের চূড়াতে গিয়ে পুরো প্যারিস শহর দেখাও একটি ভালো অনুভূতি।

লুভর মিউজিয়ামে স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
লুভর মিউজিয়ামে স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

সমস্যাটা হলো আইফেল টাওয়ারের সঙ্গে বিশাল পার্কটি। অনেক লম্বা জায়গা সেটা। হাজার হাজার দর্শনার্থী পার্কে হাঁটছেন, গা এলিয়ে পড়ে আছেন, বসে আছেন। ছবি তুলছেন। ভীষণ ভিড়ে ভারাক্রান্ত একটি জায়গা। তার চেয়েও ভয়ংকর হলো এটির রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা। খাবার দাবার, চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে ময়লা ছেঁড়া কাপড়, বিভিন্ন প্রকার উচ্ছিষ্ট—এমন কোনো নোংরা নেই যা মানুষ ফেলে রাখেনি মাটিতে। ঘাস কম, আবর্জনা বেশি। হাঁটতে গেলে সাবধানে হাঁটতে হয়। ওই ধুলোবালি নোংরার মধ্যে যারা শুয়ে-বসে থাকেন, তারা কীসের টানে থাকেন সেটা ভেবেই আমি বিস্মিত।

আইফেল টাওয়ার থেকে তোলা ছবি
আইফেল টাওয়ার থেকে তোলা ছবি

আইফেল টাওয়ার থেকে নিকটবর্তী স্টেশন ২০-২৫ মিনিটের হাঁটা। ওই ২৫ মিনিটে কম করে হলেও পনেরো জন ফেরিওয়ালারা আমাদের পথ আটকিয়েছেন। একেবারে দেশি স্টাইলে তারা তাদের হাতের ছোট ছোট বিভিন্ন শেপের মিনি আইফেল টাওয়ার নিয়ে ঘুরছেন এবং পথচারীদের জোর করে থামিয়ে তাদের সেগুলো গছিয়ে দিতে যাচ্ছেন। কিনবে-কিনবে বা নেবে-নেবে এই প্রশ্নটা একপর্যায়ে নাও নাও...কেনো কেনো পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং কিছুটা ভীতিকর ছিল ওই ব্যাপারটি। আফ্রিকান ওই দশাসই লোকগুলো চোখ বড় করে এমনভাবে ধমকে ওঠে বিক্রি করতে চাইছিল যেন আমরা না কিনলে আমাদের তাদের হাতে প্রহারিত হতে হবে। ফেরিওয়ালারা এ রকম আতঙ্কের সৃষ্টি করতে পারে সেটা প্যারিস না গেলে বোঝার উপায় ছিল না। আইফেল টাওয়ার দেখার সুখকর অনুভূতিটা ম্লান করে দিয়েছিল পরবর্তী এই ঘটনাটাগুলো।

আইফেল টাওয়ারের নিচে লেখিকা
আইফেল টাওয়ারের নিচে লেখিকা

বাসে একটা সিটি ট্যুর নিয়েছিলাম। সেখান থেকে Seine river এ বোটে করে ভ্রমণ। মোটামুটি ছিল এগুলো। লন্ডনে একাধিকবার এ রকম সিটি ট্যুর বা টেমসে বোট ভ্রমণ করেছি তাই এই ধরনের দৃশ্যগুলো নতুন করে ভালো লাগার কোনো ব্যাপার নেই। কিংবা কে জানে হয়তো শুধু আমার কাছেই পুরো প্যারিস শহরটা অতি সাধারণ বলে মনে হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বাসের অন্যান্য যাত্রীদের তো চোখে মুখে আনন্দ ঝলমল করছিল। মুগ্ধতা ছিল কিনা তা মনে নেই তবে উৎসাহের কমতি ছিল না এটা বেশ মনে আছে। এর মধ্যে একটি দম্পতি ছিল অতি আগ্রহী। তাদের সঙ্গে এক্কেবারে ছোট্ট একটি শিশু। কোনোভাবেই যার দেড়-দুই মাসের বেশি বয়স হবে না। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কীভাবে এ রকম একটা ট্রিপে তারা এল তা নিয়ে আমি বিস্ময় প্রকাশ করতেই আমার স্বামী হাসতে হাসতে বলে উঠল, আরে আমরা তো এর থেকেও ছোট বাচ্চা নিয়ে চলে এসেছি। আমাদের উৎসাহটাও তো মাশাল্লাহ কম না। এবার আমি না হেসে পারলাম না। সত্যিই তাই, আমি তখন আট সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা, স্বপ্নের প্যারিস আমাকে এত টেনেছে যে নিজের শরীরের কথা ভুলে গিয়ে তিন দিন ধরে বিশ্রামহীন ও ক্লান্তিকরভাবে হেঁটে চলে, বাসে, ট্রেনে, বোটে যতরকমভাবে সম্ভব নতুন এক জায়গা এক্সপ্লোর করে বেড়াচ্ছি।

আইফেল টাওয়ারের পাশে লম্বা পার্ক
আইফেল টাওয়ারের পাশে লম্বা পার্ক

প্যারিস পুরো শহর দেখার জন্য একদিন এবং আরেকদিন ল্যুভরের জন্য মোট দুদিন হলেই যথেষ্ট যদি ডিজনি ল্যান্ডের প্ল্যান না থাকে। আমাদের ডিজনি ল্যান্ডের প্ল্যান ছিল না তবু আমরা তিন দিন ছিলাম। রাতের প্যারিস আলাদা করে দেখার ইচ্ছে জেগেছিল। ভাবলাম দিনে ঘুরে যখন ভালো লাগল না, এতটা আশাহত হলাম দেখি রাতে অন্য রকম কিছু যদি চোখে পড়ে। মনে ক্ষীণ আশা হয়তো রাতেরবেলার প্যারিস আমার কল্পনার সঙ্গে মিলবে, হয়তো অভূতপূর্ব কোনো সৌন্দর্যের মুখোমুখি হব। কিন্তু হায়, সেরকম কিছুই হলো না। একই শহর সেই কম বেশি সব দ্রষ্টব্যস্থান একই রকম যা শুধু বিরক্তিই বাড়াল।
প্যারিস নিয়ে আমার কোনো মধুর বা স্মরণীয় স্মৃতি নেই। তার মানে এই নয় আমি কাউকে নিরুৎসাহিত করব যেতে। প্রত্যেকটি মানুষের পছন্দ ও রুচি আলাদা। যা আমার ভালো লাগবে তা আরেকজনের ভালো নাও লাগতে পারে এটা যেমন ঠিক তেমনি যা আমার আহামরি কিছু মনে হয়নি তা আরেকজনের আছে অনন্যসাধারণ লাগতেই পারে সেটাও ঠিক। আমার কল্পনার সঙ্গে মেলেনি তো কি হয়েছে, এমন বহু মানুষ পৃথিবীতে আছেন যাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যেতে প্যারিস সক্ষম হয়েছে এবং সব সময় হবে। যারা ঘুরতে পছন্দ করেন ও যাদের সুযোগ আছে তারা অবশ্যই যাবেন। তবে যারা আমার মতো কল্পনাবিলাসী বা অতিমাত্রায় রোমান্টিক তাদের ছোট্ট একটা অনুরোধ করব, আর সেটা হলো, প্যারিস গিয়ে প্রেমের এক নতুন সংজ্ঞা শিখব, ভালোবাসার এক ভিন্ন রূপ দেখে জীবন ধন্য করব বা প্যারিসের পথে ঘটে প্রেম ছড়িয়ে আছে এই ধরনের কিছু ভেবে না রাখাই ভালো। কবি সাহিত্যিক বা সিনেমার পরিচালকরা যে ধরনের রোমান্টিসিজম আমাদের মাথার মধ্যে গেঁথে দেন সেগুলো অন্ধের মতো বিশ্বাস করাটা নিতান্ত বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। এ ব্যাপারটি মাথায় রাখলেই ভ্রমণ হয়ে উঠবে আরামদায়ক, ভালো লাগাময় ও উত্তেজনায় পরিপূর্ণ।

সারা বুশরা: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী।