প্রবাসজন সবজন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রবাসীর সুখ-দুঃখের কথা ভাগের অধিকার সম্পাদকের মাধ্যমে গচ্ছিত হয়েছে। লেখার এমন সুযোগ রেখেও বাকপটুতে বলি, স্বীয় দুঃখকষ্টের ওপর কাউকে অধিকার দিলেতো সে কষ্ট আর একান্ত রইল না। বেলা-অবেলায় যাই ঘটুক দুঃখ জীবনকে উপভোগ করার বিশেষ অংশ। এই অংশে যদি খুঁজে পাই জীবনের চারপাশে কোথাও কোনো দুঃখ অবশিষ্ট নেই এবং অলিগলির সব দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়ে গেছে, সেইমতে বেশি দূর এগোতে ভালো লাগে না। কেননা, দুঃখ দিয়ে সুখকে জয় করা যায়, সুখ দিয়ে দুঃখকে নয়। দুঃখের সামান্যও হৃদয়ে পরিতাপের ছাপ ফেলে। সুখ প্রাসাদের মতো হলেও অবলীলায় হারিয়ে যায়। দুঃখে স্বকৃতের অন্বেষণ ঘটে, সুখেরা অনায়াসে দিশেহারা। কিছু মানুষ সংসার বেড়াজালে বন্দী থেকেও দুঃখ জয় করণে সুখ নামের রাজকীয় বস্তুগুলোকে জাদুঘরে ঠেলে দিয়ে অনভিজ্ঞ সংসারী সেজে বসে আছেন। এদের সংখ্যা অতি নগণ্য, এরা স্বীয় নিত্যানন্দ।

দেশ না ছাড়লে দেশ পাওয়া যায় না। কখনো ভাবিনি দেশ ছেড়ে প্রবাসী হলে মন হবে উদাসী যাযাবর। এমন যাযাবর জীবন পেতেই দালালের পিছু লেগেছিলাম। যার খপ্পরে আম-ছালা দুই-ই গিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল শুধু টাকায়। উচ্চ কোনো ডিগ্রি অর্জনে নয়। লেখাপড়ার সমাপ্তি না ঘটতেই অর্থ মোহে ইউরোপের দেশে নাগরিক সুবিধা পাওয়ার লোভনীয় আশে পরাজিত হয়ে জীবনকে বেকারত্ব উপহার দিই। মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে করি দেউলিয়া। অভিশপ্ত বোধ ও দায়ের তাড়না এড়াতে বেছে নিই ক্ষণিক রাজনীতি। আর্থিক সুফলে পাই বড় ভাই ছোট ভাইয়ের খেলা। বড় ভাইয়েরা দুই-চারশ টাকা দিলে সবাই মিলে চা-সিগারেট ভালোই চলত। যেদিন কোনো ধান্দাই অর্থ জোগানের কাজে আসত না। সেদিন দলের কেউ একটা সিগারেট কিনলে সবাই মিলে ফুঁক দিতে হতো। কাড়াকাড়ি ছাড়াও কে লম্বা ফুঁক দিল তা নিয়ে চলত বাগ্‌বিতণ্ডা।
পরে দেশ ছেড়ে প্রবাসী হলাম। এক উড়ালে চলে এলাম জেদ্দায়। এই নগরের এলাকাবাসী অনেকে কাজ করতেন, আজও করেন। পুরোনো প্রবাসীদের মুখে গল্প শুনে মা-বাবার ধারণা জন্মেছিল যেখানে এক মিনিটের বিলম্বে বাস ছেড়ে দেয় জিয়াউদ্দিন সেখানে প্রতিনিয়তই বাস মিস করবে। তার চলাফেরায় বেশ ওজন। সকালের অলস ঘুমের কারণে তাকে অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন পোহাতে হবে। চটপটে না হলে কী করে বিদেশ করবে? সেদিন এই কটু বাক্যগুলো মানতে চাইনি। আজ সেগুলোই মঙ্গলে পরিণত হয়েছে। গত ১৭ বছরের হিসাব-নিকাশের কর্তব্যে একটি Single absent-ও না থাকায় জীবন আপ্লুত ভঙ্গি দাবি করেই বলে, আমি কী আর জানতাম যে, বাবা-মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই বকাগুলোই এই জীবনে আশীর্বাদ হয়ে সাড়া দেবে। আশীর্বাদের পরশে ভালোই আছি। প্রাপ্তির শুকরিয়া অবশ্যই জ্ঞাপনীয়। প্রভুর মহিমায় জীবনের সবকিছুই চির সুন্দর। যাঁর দয়ায় বেঁচে আছি, সেই দয়াময়ের বিকল্প কিছুই নেই।
সকল প্রবাসীই ব্যস্ত নগর বুনে সেই নগরে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। জীবন গড়ার সুখ-স্বপ্নময় অর্থে তারা দেশ গড়ার চাকাও ঘোরান। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থনৈতিক মুক্তি চান। দেশ নিম্নমধ্য আয়ের ধাপে পা রাখায় প্রবাসীরা বেশ উল্লসিত। হয়তো একটু মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেই এই সামান্য বেতনের চাকরি নিজ দেশে মেলার সম্ভাবনা আছে, সেই স্বপ্নও দেখি। তার আগেই ফুরিয়ে গেলে দেশের মানুষের মধ্যেই বেঁচে দেখার আকুতি আছে। অবিরাম ঘাম ঝরবে তো ঝরুক তবুও অভাবী মায়ের চোখের পানি দূর হোক।
মা-বোনের আত্মত্যাগ, বাবার সর্বস্ব বিসর্জন, হাজারো বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে, তারা জাতিকে ‘মুক্তি’ নামের স্বাধীনতা উপহার দিয়ে গেছেন। এখন বাকি আছে অর্থনৈতিক মুক্তি। একদিকে আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যুদ্ধ করি অন্যদিকে অর্থ পাচার সংবাদ পড়ি। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। যেখানে গরিষ্ঠ প্রবাসী দারিদ্র্যসীমার ওপরে দাঁড়াতে আজীবন যুদ্ধ করছে, সেখানে মুহূর্তেই কেউ লুফে নিচ্ছে অগণিত টাকা। এক দস্তখতেই আয় করে নিচ্ছে আমাদের সারা জীবনে উপার্জনের চেয়েও বেশি অর্থ। হঠাৎ আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার মতো অবাক কথা হলেও তাই সত্যি। কোনো কালের নেতা বা নেত্রীই নাগরিকের এমন মন মানসিকতাকে ঠেকাতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমরা নিজেরা নিজ দেশের মঙ্গলে আন্তরিক না হই। আমি নির্বাক ও ব্যথিত। কোনো কুল কিনারা না পেয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি, এক জীবনে এক পরিবারের ভরণ-পোষণে আর কত অর্থ চাই। জয় হোক জগন্নাথ মানুষের চরম বিবেকের।

লেখক
লেখক

অর্থের তারতম্য অনুসারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্পের বিশেষ অংশের কথা প্রায় মনে পড়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘কুষ্ঠ রোগীর বউ’-এ পড়েছিলাম:
‘এ কথা কে না জানে যে পরের টাকা ঘরে আনার নাম অর্থোপার্জন এবং এ কাজটা বড় স্কেলে করতে পারার নাম বড়লোক হওয়া? পকেট হইতে চুপিচুপি হারাইয়া গিয়া যেটি পথের ধারে আবর্জনার তলে আত্মগোপন করে থাকে সেটি ছাড়া নারীর মতো মালিকহীন টাকাও পৃথিবীতে নাই। কম ও বেশি অর্থোপার্জনের উপায় তাই একেবারে নির্ধারিত হয়ে আছে, কপালের ঘাম আর মস্তিষ্কের শয়তানি। কারও ক্ষতি না করিয়া জগতে নিরীহ ও সাধারণ হইয়া বাঁচিতে চাও, কপালের পাঁচশ ফোঁটা ঘামের বিনিময়ে একটি মুদ্রা উপার্জন করো: সকলে পিঠ চাপড়াইয়া আশীর্বাদ করিবে। কিন্তু বড়লোক যদি হইতে চাও মানুষকে ঠকাও, সকলের সর্বনাশ করো। তোমার জন্মগ্রহণের আগে পৃথিবীর সমস্ত টাকা মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করিয়া দখল করিয়া আছে। ছলে বলে কৌশলে যেভাবে পার তাহাদের সিন্দুক খালি করিয়া নিজের নামে ব্যাংকে জমাও। মানুষ পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে অভিশাপ দিবে।’
ধনী হওয়ার এ ছাড়া দ্বিতীয় পন্থা নাই।
ভাগ্যের ছিনিমিনি খেলায় আমরা মাথা নত করতে শিখিনি। প্রিয়জনদের চোখের পানি মুছে দিতে এ জাতির সন্তানেরা একটুও সংকোচ বোধ করে না। প্রয়োজনে সবকিছুই করে দেখাতে পারে। দেশ গড়ায় আমরা কোথাও থেমে নেই। শুধু নিজের একক ক্ষমতাকে বড় করে দেখাই আমাদের দৈন্যতা। তবে কোনো কালেই ক্ষমতা মানব জাতির চিরদিন ছিল না। নেই এবং থাকবেও না। আজ বাদশাহতো কাল ফকির। যিনি সার্বভৌমত্বের মালিক তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী। মা সন্তানের অধিকারী, সন্তানও মাকে ছাড়া নিরুপায়। কিন্তু মায়ের উদরে থেকে শিশু সন্তান মাকে মিস করে না। মায়ের জন্য কাঁদে না। যখনই জগতের বিস্ময়কর আলো শিশুর চোখে পড়ে তখনই সে নিরাপত্তার অভাবে কেঁদে ওঠে।
দেশের অভ্যন্তরে থেকে দেশকে যতটুকু ভালোবেসেছি তার চেয়ে অধিকতর শিখেছি প্রবাস জীবন পেয়ে। প্রবাসীরা দেশকে ভীষণ মিস করেন, দেশের মায়া মমতায় সত্যিই কাঁদেন। চোখের জল ফেলেন নীরবে নিভৃতে। সেই চোখের জলের প্রতিদানে ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে অপ্রত্যাশিত লাঞ্ছনা। আসা যাওয়ার পথে শিকার হই হয়রানির। মোকাবিলা করি বিষাদময় অভিজ্ঞতা। নিজেই যখন কমবেশি বাধা অতিক্রম করি তখন কী করে বলি, আমার চেয়েও সহজ সরল বন্ধুটির বেলায় তার পরিমাণ কম হবে। কেউ ছাড়া পেয়ে গেলে তা ছিল তার অনিশ্চিত সৌভাগ্য। নাগরিকের নিশ্চিত কিছু সৌভাগ্য থাকে, সেগুলি যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলতে না পারে তার প্রার্থনাই আমরা করি।
প্রবাসে বন্ধুরা দুঃখ করে প্রায় বলেন, প্রবাস মানেই দেশে টাকা পাঠানো। প্রতি মাসে টাকা পাঠানো প্রবাসীর অন্যতম রুটিন। যদিও প্রবাসীর প্রেরিত অর্থে পরিবার পরিজনের ৭৫ ভাগ চাহিদা পূরণ হয়, তথাপিও বেদনার্তের ৭৫ ভাগ প্রিয়জনদের কাছ থেকেই নিতে হয়। নিজে ভুক্তভোগী হয়েও বন্ধুদের সান্ত্বনা দিয়ে বলি, পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম সুখের তীব্রতা নেই; দুঃখের তীব্রতা আছে। সুখ যত স্থায়ী হয়, তত কমে; দুঃখ যত থাকে, তত বাড়ে। তীব্রতার এই দুঃখকে হাসি দিয়ে আড়াল করা শিখতে হবে। আমরা প্রবাসীরা সত্যিই দুঃখকে হাসি দিয়ে আড়াল করতে শিখেছি। দুঃখ–কষ্ট গুছাতে কখনো নিজেরাই ডাক্তার হয়ে বসে আছি। কর্মের বিকল্প কিছু নেই বলে বহু বছর কর্ম সাধন চালাচ্ছি। ভাগ্যকূলে স্বর্ণ ফলাতে চাচ্ছি। বাবা কর্ম মন্ত্র শিখিয়ে বলেছিলেন—‘কর্মীর হাতে স্বর্ণ ফলে, অকর্মীর হাতে ঝুন্না মিলে।’ কর্মহীন জীবনের ব্যাধিতে আছে ঝুন্না অর্থাৎ ভিক্ষার থলে। বাবার দেওয়া মন্ত্র ছুড়ে ফেলতে পারিনি। অতএব, ঝুন্না এড়ানোর যুদ্ধ চলছে তো চলবেই।
ভৌগোলিক দূরত্ব হৃদয় অনুভূতির জন্য বড় কিছু নয়! হকিকত তত্ত্বের ধারায় এই পৃথিবীর সবাই প্রবাসী। আমি প্রবাসী, আমরা প্রবাসী। নিয়েছি যা এখান থেকে, দিয়েছিও এখানেই। চলন্ত যাত্রায় কারও বিরতি নেই। শুধু ডাকের অপেক্ষমাণ সময়টুকুই বাকি! কেউ আগে তো কেউ পরে, যেতে আমাদের হবেই। তত্ত্বের তালাশ নিইনি, পাড়ের কড়িও জমাইনি। কথা দিয়েছিলাম, সবাই অধম হলেও আমি উত্তম হব। সে কথা রাখিনি, রাখতে পারিনি। অতএব, অধমের পাল্লাও আমায় ছাড়েনি, ছাড়তে ভোলেনি। দয়াতন্ত্রের দয়া হোক, এই অধম প্রবাসীরও একটা গতি হোক।

মো. জিয়াউদ্দিন শাহ: জেদ্দা, সৌদি আরব।