বই উৎসব বন্ধুত্বেরও উৎসব

অতিথিদের সঙ্গে নতুন বই হাতে শিক্ষার্থীরা
অতিথিদের সঙ্গে নতুন বই হাতে শিক্ষার্থীরা

বই উৎসব। অন্য রকম উত্তেজনা। শিক্ষার্থীরা বসে আছে নিজ নিজ আসনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হাতে পাবে নতুন বই। পেয়েও গেল। বই বিতরণ শুরু হলে উৎসবে মেতে ওঠে তারা। সেই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে অডিটোরিয়াম থেকে ক্যাম্পাস হয়ে ক্লাস পর্যন্ত।

মালিহা নবম শ্রেণিতে উঠল। ভালো ফলাফল। শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে আরও ভালো করে পড়াশোনা করার পরিকল্পনা তার। তানিকা ও আদিবাও একই শ্রেণির ছাত্রী। বই পেয়ে আনন্দ আনন্দ অনুভূতি তাদের।
রাফিদা হাসান প্রথম হয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে এবার। কী এক উচ্ছ্বাস তার! মেহেরিন বলে, অপার আনন্দ! একই ক্লাসের তামান্না, লিয়া বইয়ের ফিতা খুলে দেখাল তাদের বই। আনন্দপাঠ, সপ্তবর্ণা--আহা কী চমৎকার! 
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল। গত ৮ জানুয়ারি এই স্কুলের অডিটোরিয়ামে জমে ওঠে বই উৎসব। এ অনুষ্ঠানে ছিলেন শিক্ষক-অভিভাবকরাও।

নতুন বই গাতে শিক্ষার্থীরা
নতুন বই গাতে শিক্ষার্থীরা


উৎসবের প্রধান অতিথি সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান বই তুলে দেন শিক্ষার্থীদের হাতে। অনুষ্ঠানে তিনি তার ছেলেবেলার শিক্ষাজীবনের কথা তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আগে বড় ভাইয়ের পুরোনো বই পড়ত ছোট ভাইয়েরা। সময়ের সঙ্গে এখন এই ধারার পরিবর্তন হয়েছে। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের হাতে আসছে নতুন বই। এই বই পড়ে তারা দেশ ও জাতির ঐতিহ্য-ইতিহাস জানবে এই আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বই উৎসবে স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, সরকারের অনেক ভালো কাজের মধ্যে বই বিতরণ কর্মসূচি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এবারের বইয়ে আরও আরও নতুন ও আকর্ষণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তার আশা অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় এই কর্মসূচি এগিয়ে যাবে।
এ বছর প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি বই তুলে দেওয়া হয়। বিনা মূল্যে বই বিতরণের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। দেশে নয় শুধু বিদেশের বাঙালি পাড়ার স্কুলগুলোতেও যথাসময়ে কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। পরিবহন খরচ বহন করছে সরকার। তাইতো এ আনন্দ এখন স্কুলের শিক্ষকের, অভিভাবকদের তো বটেই।

বই বিতরণের দৃশ্য
বই বিতরণের দৃশ্য

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। বিনা মূল্যে বই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বইয়ের গন্ধে ফুলের মতো ফুটে উঠছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এ এক অভিনব এবং বিস্ময়কর ব্যাপার, বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আবু তাহের। সূচনায় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক দাঁড়িয়ে পড়েন। তারা হৃদয়ে উপলব্ধি করেন দেশকে। মনোলোকে দেখেন দেশের মানুষকে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতুতে আবিষ্কার করেন নিজেকে।
বই উৎসবে এসেছেন শর্মিলা বড়ুয়া। সঙ্গে কন্যা তার মৌনতা। সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। মা আনন্দে ভাসছেন। বই খুলে দেখছেন আর হাঁটছেন। গুটি পায়ে এগোচ্ছে কন্যা। সামনে দাঁড়িয়ে পথ-সাংবাদিক এক। বললেন, খু-উ-ব ভালো লাগছে।

বই বিতরণের দৃশ্য
বই বিতরণের দৃশ্য


শামসুন্নাহার। অভিভাবক প্রতিনিধি। বই বণ্টনে মঞ্চে ছিলেন তিনি। বললেন, অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের আনন্দেই আনন্দ। আরও যোগ করলেন, সময়ের ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতো একটি দিন আজ।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। তার চন্দ্রদ্বীপ বাড়ি। আয়শা সিদ্দিকা ও খাদিজা চৌধুরী যথাক্রমে সপ্তম ও প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হলো। এই দুই সন্তানের মাথায় আদরের হাত রাখলেন তিনি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন আজকের উৎসব আয়োজকদের উদ্দেশে।
শাহনাজ বেগম। তার গর্ব তার দুই সন্তান নিয়ে। মরিয়াম তৃতীয় শ্রেণিতে উঠল। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬০০-এর মধ্যে ৫৯৯। অভিনন্দন জানালাম। তার পুত্র আবদুল্লাহ, সে এবার পঞ্চম শ্রেণিতে। তিনি বললেন, স্কুল যত্ন নেয় ছাত্রদের, এটা এক বড় তৃপ্তি।
ভালো লাগার অনুভূতি শেষ হয় না। সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে ইমাদ। তার হাতে বই। নতুন বইয়ের গন্ধে সে মাতোয়ারা। চতুর্থ শ্রেণির সাদিয়ার মুখে হাসি। একই শ্রেণির আজরিনা সামনে তুলে ধরল 'আমার বাংলা বই’। বুঝলাম, আনন্দের পড়া অনুষ্ঠানটিরও উদ্বোধন হলো আজ।

নতুন বইয়ের অপেক্ষায় কয়েকজন শিক্ষার্থী
নতুন বইয়ের অপেক্ষায় কয়েকজন শিক্ষার্থী


ভালোর আকাঙ্ক্ষাই চতুর্দিকে ব্যাপ্ত। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান তার বক্তব্যে পিএসসি ও জেএসসিতে অধিকতর ভালো ফলাফল আশা করলেন। তারা শতভাগ পাস করুক, প্রার্থনা করলেন। এদেরই হাত ধরে একটি সমৃদ্ধ ও জ্ঞানবান প্রজন্ম গড়ে উঠবে, কামনা করলেন। তিনি বই বিতরণে সরকারের এই কর্মসূচিকে ব্যতিক্রমধর্মী বলে উল্লেখ করলেন।
উৎসব এক জায়গা বসে থাকে না। এক তরুণী মা এসেছেন ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি নীতিশাস্ত্র পড়ানোর অনুরোধ নিয়ে। বড়ুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এই তরুণী মায়ের কথা মন দিয়ে শুনলেন অধ্যক্ষ। তার সঙ্গীসহ অধ্যক্ষের কক্ষে আপ্যায়িত হলেন তিনি। সেখানে ছিল তার সন্তানও। ছিলেন অন্য এক শিক্ষক। ছিল এই অভাজনও। 
নিমতলায় রোদ্দুর। শীতের দিনে এ রোদ্দুর বড় মিষ্টি। ছবির ফ্রেমে বন্দী হলেন শিক্ষক-অভিভাবক। সময়টি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল। শেষে হলো চায়ের আয়োজন।
উৎসব অর্থ বই। আরেক মানে চায়ের পেয়ালায় চুমুক। ভালোবাসার আবেশ। পরস্পরের কাছে আসা। হৃদয়ের কথা বলা। হলোও তাই। বই উৎসব হয়ে উঠল বন্ধুত্বেরও উৎসব।

বই বিতরণ অনুষ্ঠানে অভিভাবকেরা
বই বিতরণ অনুষ্ঠানে অভিভাবকেরা

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।