সাকিবের মঙ্গলযাত্রা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আবাহনী অনুষ্ঠান: মঙ্গলযাত্রা অনুষ্ঠানে ডেলিগেটরা হাজার প্রশ্ন করে। একজনকে কন্যা কুমারিকা মঙ্গলে আহ্বান করে বলেন, এসো বৈচিত্র্য খুঁজে পাবে। অনেকেই আগ্রহী হন। সাকিব আলোড়িত হয়। ডেলিগেটরা হচ্ছেন তার মঙ্গলযানের অভিযাত্রী। তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। সে ছুটছে লাল গ্রহের দিকে।

সাকিবের স্পেস ক্যাম্প চলছিল। মঙ্গলে যাওয়ার জন্য নভোচারীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে আরও তিন মাস আগে। এরই মধ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠাতার একটি ইমেইল।
ছুটি কবে? এ সময় ঢাকা আসছ তো?
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কন্যা কুমারিকা। তিনি এখানকার প্রধান কার্যনির্বাহী। সবাইকে তার জানা। শুধু জানাই নয়, চেনাও। তিনি নাম ধরে ধরে শিক্ষার্থীদের ডাক দেন। অভিভাবকদের সঙ্গেও হৃদয়ের সম্পর্ক। কাউকে তিনি বুকে টেনে নেন। বলেন, এই আমার ছেলে। শিক্ষকেরা তার পরিবারের সদস্য। তিনি তাদের বাস ভবনের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার বেতন দিতে হয় না। তারা সুখী। সেই চিত্র ফুটে ওঠে স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানে।
শিক্ষকদের ইউনিফর্ম বৈচিত্র্য আনে। তারা জ্বলে ওঠেন মেধা ও পোশাকে। সে মাধুর্য ছড়িয়ে পড়ে তাদের আপ্যায়নে। তারা দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান অতিথিদের।
শিক্ষার্থীরাও অনুষ্ঠানে শামিল হয় প্রাণের আবেগে। মুখগুলো তখন মেধা আর শুদ্ধতায় চিকচিক করে তারার আলোর মতো।
কন্যা কুমারিকা বরাবরই শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক—সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। সাকিবের ইমেইল তার এই চর্চারই অংশ।
সাকিব একাডেমিক ক্যালেন্ডারে দেখতে পায় তার স্কুল প্রোগ্রামটি হচ্ছে তার ছুটির মাসেই। এই সময়েই আয়োজন করা হয়, পাস দ্য মার্স—মঙ্গলযাত্রা নামের আবাহনী অনুষ্ঠান।
স্কুলে মঙ্গলযাত্রা অনুষ্ঠানটি বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। সাকিব মঙ্গল গ্রহের ওপর সামান্যই বলে। কেবল একজন সঞ্চালককে যতটুকু বলতে হয় ততটুকুই। এর বেশি নয়।
হাসিমুখে আনন্দের বার্তাটি দেয় সে। আমাদের মধ্যে আছেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কন্যা কুমারিকা। তিনিই ভালো বলবেন মঙ্গল নামের লাল এই গ্রহটির ওপর। সাকিব মাইক্রোফোনটি এগিয়ে দেয়।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

প্রতিষ্ঠাতার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই একজন অভিভাবক সামনে আসেন।
—আমরা কি আজকেই মঙ্গলে যাওয়ার ভিসা পাব?
তিনি এই অনুষ্ঠানের একজন ডেলিগেটও।
—অবশ্যই! সাকিবের ঝটপট উত্তর। তবে তার আগে কিছু কাজ আছে সেগুলো করতে হবে। টেবিলের ওপর নীল প্রচ্ছদের কতকগুলো ছোট বই।
সাকিব এরই একটা বইয়ের পাতা খোলে।
—এই দেখুন এখানে গ্রহচারীর নাম ধাম। আছে কে তার সহগামী হবে সেই ঘর।
বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রতিটি লাইনে আঙুল চালায় সাকিব। আঙুলের সঙ্গে চলে সবার চোখ।
—এই যে ইনি।
প্রথম পৃষ্ঠার ছবিটি হাসছে, সাকিব বলে, ইনিই স্কুল প্রতিষ্ঠাতা। সবাই একবার বিদুষী নারীর দিকে, আরেকবার বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ রাখেন।
কন্যা কুমারিকাকে কে না চেনে! সাকিব আরও বইয়ের ওপর হাত রাখে।
এ সময় সবার মনোযোগ চলে আসে বইয়ের সামনের ওই নারীর দিকে।
অভিবাদন! মৃদুকণ্ঠে একসঙ্গে বলেন সবাই।

—আজকের বিকেলের রোদ্দুর মিষ্টি একটি খবর দিল।
এক ডেলিগেটের মুখে মৃদু হাসি।
—এ জন্যই স্কুল প্রাঙ্গণের এ জায়গাটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আরেক ডেলিগেট তার জায়গায় দাঁড়িয়েই কথাটা বললেন।
—মঙ্গলে যেতে কতটুকু নিশ্চয়তা পাচ্ছি আমরা? মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে প্রচণ্ড রকমের আগ্রহ দেখান সামনে আসা ডেলিগেট।
মূল জায়গায় আলোচনা ফিরে আসে।
—কতটুকু ঝক্কি-ঝামেলাইবা আছে এতে? আরেকজনও জানতে চান।
সৌরজগতের এই নাগরিককে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই পৃথিবী নামক এই গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যাত্রার কথা এখানে স্পষ্ট। সাকিব পৃষ্ঠাটি মেলে ধরে।
সবাই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারা দেখতে চান লেখাটুকু।
সাকিব কাছে এনে দেখানোর চেষ্টা করে লাইন কটি।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মহাশূন্যে কারা বাস করে সে কথা কি সবাই জানে? কেউ জানে, কেউ জানে না। এই জানা এবং অজানার মধ্যেও আছে অনেক কৌতূহল।
অজানা পথ। সেখানে যাত্রাপথে কাদের মোকাবিলা করতে হবে? মানুষ না অন্য কোনো জীব? তারা কি মানুষের চাইতে বেশি বুদ্ধিমান নাকি কম? যেটাই হোক, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া এমন যাত্রায় কেউ উড়াল দিতে পারে না। সে জন্যই তাদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। আর এটাই স্বাভাবিক।
কাগজপত্র তৈরিতে অতিরিক্ত সময় যাতে না লাগে সে ব্যাপারে সতর্কতা রয়েছে। মঙ্গলযাত্রায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা সবাই তো আর যাচ্ছি যাচ্ছি করে বসে থাকতে পারে না!
সাকিবও বিষয়টিতে আন্তরিক! সে বলে একটি দল দীর্ঘদিন ধরে এ জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
—প্রয়োজনে মঙ্গলযাত্রাকে আইনানুগ সহায়তা প্রদর্শনের বিষয়টিও যুক্ত এখানে। আরও বেশি জোর দিয়ে বলে সাকিব।
—কন্যা কুমারিকা কবে সই করবেন পাসপোর্টে?
চূড়ান্ত প্রশ্ন প্রথম ডেলিগেটের।
—সে জন্যই আজকের আয়োজন। সাকিবের মুখে আলাদা সুষমা তখন।
—আমরা কি ইচ্ছে করলে সবাই যেতে পারব? ডেলিগেটের মনে আলাদা শিহরণ তখন। আনন্দ আনন্দ ভাব তার কণ্ঠে।
সাকিব দেরি করে না। সেও বলে, বিশ্বাস করি। সে হাসে। এই হাসির অর্থ হ্যাঁ কিংবা না, কোনোটাই বোঝা যায় না। তবে তারা হয়তো প্রথমটাই ভেবে নেন।
ড্রিমল্যান্ড স্কুল। এখানে সাকিব বারোটি ক্লাস পড়েছে। শুরুর দুই ক্লাস ধরে চৌদ্দটি বছর তার এখানে কেটেছে। দীর্ঘ এই সময়ে স্কুল ভবন, ক্লাস রুম, খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক মঞ্চ—সবকিছুর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শিক্ষকদের মাঝে তার একটি জায়গা তৈরি হয়ে আছে। তাকে ভালোবাসেন শিক্ষকেরা, অত্যন্ত স্নেহ করেন কন্যা কুমারিকা।
সে জন্য তিনি মঙ্গলযাত্রা অনুষ্ঠানে ডাকেন তার স্কুলের এই প্রিয় ছাত্রকে।
মঙ্গলে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতিটা কেমন হতে পারে? ডেলিগেট বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলেন, মানে—কীভাবে কতটুকু প্রস্তুত হওয়ার প্রয়োজন পড়বে? উনি মঙ্গলে যাবেন কি যাবেন না—সেটা বলা যায় না। তবে তার জানার আগ্রহ প্রচণ্ড। তার দিকে মুখ করে সাকিব বলে, আপনি যেতে চাচ্ছেন?
কন্যা কুমারিকার চোখ এড়ায় না। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে ডেলিগেটের দিকে তাকান। বলেন, এসো, বৈচিত্র্য খুঁজে পাবে জীবনে।
আমি মঙ্গলে যাচ্ছি। ডেলিগেটদের মনোভাবে সাকিবের আগ্রহ বেড়ে যায়। বারবার মনের ভেতরে কথাগুলো বলে সে।
আমি নভোচারী। তার মন আন্দোলিত হয়। তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক।
এই ডেলিগেটরা হবেন আমার মঙ্গলযানের অভিযাত্রী। আনন্দ তার দেহ মনে দোলা দেয়।
মহাকাশযান ছুটছে পৃথিবী থেকে। যাচ্ছে মঙ্গলের দিকে।
সাকিব নাচে। সে ঢেউ তোলে শূন্যে।
মহাশূন্যে ওজন কম বোধ হয়। নিজেকে হালকা মনে হয়।
তারও তাই মনে হয়।
আমি যাচ্ছি আর যাচ্ছি। পৃথিবীর মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে বাংলাদেশের জনগণ। আমি দুই হাত ছড়িয়ে আনন্দের অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছি। হা-রে রে-রে রে-রে, আমায় ছেড়ে দে-রে দে-রে...।
মঙ্গলযাত্রার এ দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে দূর দর্শনে।
কী মজা! কী মজা! সাকিবের আনন্দ আর ধরে না। (ক্রমশ)

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।