ইতিহাস থেকে বর্তমানে

জাপানের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র
জাপানের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র

জাপানের ইতিহাস আমি পছন্দ করি। ইতিহাসের নানারকম মানুষ আমার পছন্দ। এদের মধ্যে আজ আমি যাদের সম্মান করি সেরকম মানুষের কথা বলতে চাই। সেরকম দুজন মানুষ আছেন। প্রথমজন হলেন এখন থেকে ৪৫০ বছর আগের মানুষ উএসুগি কেনসিন। ওদা নোবুনাগার প্রায় একই সময়ে তিনি জীবিত ছিলেন। তবে নোবুনাগা কিংবা তয়োতোমি হিদেয়োশির মতো তেমন বিখ্যাত তিনি না হলেও খুব শক্তিশালী মানুষ তিনি ছিলেন। অনেক যুদ্ধ তিনি জিতেছেন। তাই নোবুনাগাও তাঁকে ভয় করতেন। কিন্তু পুরো জাপান শাসন করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তাই আমার মনে হয় তিনি ছিলেন বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর কথা দিয়েই শুরু করা যাক।

উএসুগি কেনসিন ১৫৩০ সালে নিইগাতা জেলায় (জাপান সাগরের তীরের একই নামের বড় শহরের জেলা) জন্মেছিলেন। তিনি ছিলেন জেলার রাজার চাকরের সন্তান। তাঁর আদি নাম নাগাও কাগেতোরা। ১৫৩৬ সালে তাঁর বড় ভাই জেলার রাজার চাইতেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নাগাও পরিবার নিইগাতা জেলার নতুন রাজা হয়। প্রায় ১০ বছর পর কেনসিন তার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে অবশেষে সরকারের দায়িত্ব পান। কিন্তু আরও ভূমি দখলের ইচ্ছা তাঁর ছিল না। অনেক রাজাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, তবে ভূমি দখলের জন্য নয়। দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য ছিল তাঁর লড়াই। ফলে তাঁর নীতি হয়ে উঠেছিল দুর্বল দেশকে রক্ষা করা এবং শক্তিশালীকে পরাজিত করা। তাই আমি তাকে খুব সম্মান করি আর সেরকম একজন মানুষ আমি হতে চাই। কিন্তু এটা আমার জন্য খুব কঠিন। শেষ পর্যন্ত তিনি জাপানের সমস্ত অংশ শাসন করতে পারেননি। তবে আজও অনেক জাপানির কাছে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।
এবার ইতিহাস থেকে ভিন্ন কথা আমি বলব। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত এই বিষয়টি হচ্ছে জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখন জাপানে এই সমস্যা নিয়ে বড় বেশি আলোচনা হচ্ছে। অনেক জাপানি মনে হয় পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে থাকেন। তবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেছেন, জাপানের পারমাণবিক শক্তি দরকার। আমিও মনে করি ঠিক কথা তিনি বলেছেন। আমার এ রকম মনে হওয়ার কারণ এখানে আমি লিখতে চাই।
২০১১ সালে জাপানে যখন বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, ফুকুশিমা জেলার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তখন ভেঙে পড়ে। সাধারণ মানুষ যেখানে থাকেন সেরকম অনেক এলাকায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে এর প্রতিক্রিয়া ছিল খুব খারাপ। কিন্তু আমার মনে হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ জাপানের দরকার। এর দুটি বড় কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো জাপানে সম্পদ কম। আর প্রয়োজনের সম্পদ জীবাশ্ম জ্বালানি খুব কম হওয়ায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ হচ্ছে জাপানের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। জাপান এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যবহার না করায় জীবাশ্ম জ্বালানি ২০১১ সালের আগের চাইতে অনেক বেশি ব্যবহার করছে। এই জ্বালানির মূল্য সবটাই জাপানের মানুষকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। জ্বালানির জন্য এত বেশি অর্থ খরচ না করে বরং চিকিৎসা আর শিক্ষায় সেই অর্থ জাপানের খরচ করা দরকার। তবে, কিছু কিছু মানুষ বলছেন পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিপজ্জনক হওয়ায় এটা ব্যবহার করার দরকার নেই। কিন্তু আমার মত ভিন্ন। এক, পারমাণবিক বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রায় ১০০ হাজার জীবাশ্ম জ্বালানির সমান। তাই, আমরা যথেষ্ট নিরাপত্তা খরচে আছি। জীবাশ্ম জ্বালানি এখন সস্তা, তবে এই খরচ বেড়ে গেলে জাপানের কষ্ট হবে। অন্য কথায়, পারমাণবিক জ্বালানি বাদ দেওয়া জাপানের জন্য বিপদ হয়ে উঠবে।
অন্য কারণ হচ্ছে পারমাণবিক জ্বালানির স্থায়িত্ব। নতুন বিদ্যুতের কথা আজকাল বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা তৈরি করা কঠিন আর যে পরিমাণ বিদ্যুৎ এর থেকে পাওয়া যায় তা খুব কম। অবশ্যই নবায়নযোগ্য নতুন বিদ্যুতে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন প্রায় নেই। পারমাণবিক বিদ্যুতেও তা মূলত নেই। আর বিরতিহীনভাবে এই বিদ্যুৎ পাওয়া হচ্ছে আরেকটি বড় সমস্যা। জাপান ছোট দেশ হলে সমস্যা ছিল না। তবে জাপান আসলে হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সেরকম অবস্থান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা জাপানের যথেষ্ট নয়। জাপানের জনগণ আর সরকারের নিশ্চিন্তে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় সেরকম অবস্থান থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ জাপানের এখনো দরকার।

লেখক
লেখক

পারমাণবিক বিদ্যুতের বিপদও অবশ্যই আছে। জার্মানি তাই এর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। তবে এর ফলে বিদ্যুৎ খরচ অন্য দিকে বেড়ে গেছে এবং বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করে নিতে ফ্রান্স থেকে বিদ্যুৎ আনতে হচ্ছে। অন্যদিকে ফরাসি বিদ্যুৎ প্রায় সবটাই পারমাণবিক। এটা তাই খুবই পরস্পর বিরোধী।
জাপানের সরকার এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালুর ইচ্ছা প্রকাশ করছে। আমার মনে হয় জাপানের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যতের জন্য এটা ভালো হবে।

কাজুতোশি কাশিওয়াবারা: টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।