বেচারা স্বামী-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কি হলো, নাশতা কি দিবা না?

বউরে মিষ্টি গলায় প্রশ্ন করলাম।
—বানায়া খাও।
তিতা গলায় ঝাড়ি মেরে উত্তর দিল।
—মানে কি, বুঝলাম না।
—বাংলা বলেছি। না বোঝার কি আছে।
—না অর্থ বুঝছি, কিন্তু নাশতা না বানানোর কারণটা বুঝি নাই। তাই বলছিলাম যদি একটু কষ্ট করে বুঝায়ে বলতা, তাহলে উপকার হতো।
—শোনো আমি কোনো দাসী–বান্দি না, যে সারা দিন তোমার সংসারের কাজ করব।
—নাউজুবিল্লাহ, প্রশ্নই আসে না। তুমি কেন দাসী–বান্দি হবা। আমি তো আর দাসী–বান্দিরে বিবাহ করি নাই। আমি বিবাহ করেছি চার্লস আর হ্যারির বোনকে।
—আমার সাথে ফাজলামি করবে না। তুমি আমার দেবর না, আর আমিও তোমার ভাবি না।
—আচ্ছা করব না। হিউমার বন্ধ। এখন আমি প্রচণ্ড সিরিয়াস মুডে। চেতছ ক্যান সেটা আগে বলো।
—তোমার কী মনে আছে আগামীকাল কি?
—কেন মনে থাকবে না? ৫ ডিসেম্বর। তাতে কি?
—তাতে কী মানে? কাল আমার জন্মদিন। সেটাও কি তুমি ভুলে গেছ?
—কী যে বলো, আমি কী তোমার জন্মদিন ভুলতে পারি! দশটা না, পাঁচটা না, আমার একটা মাত্র বউ।
—ঢং করবে না। অবশ্যই ভুলে গেছ। না হলে কোনো আয়োজনই তো চোখে পড়ছে না। আসলে আমার জন্মদিন নিয়ে তোমার কোনো মাথা ব্যথাই নেই।
—জন্মদিন নিয়ে মাথা ব্যথা থাকবে কেন? এটা তো আনন্দের বিষয়। আর যদি মাথা ব্যথা হয়ই তবে পেইন কিলার খেয়ে নেব।
—ন্যাকামো করবে না। আমি মাথা ব্যথা বলতে গিফটের কথা বুঝেছি। আমার গিফট কই?
—ও তাই বলো। আচ্ছা সারপ্রাইজ বলেও তো একটা কথা আছে নাকি? প্রতি বছর তো তুমিই তোমার গিফট কেনো। এ বছর আমি তোমারে সারপ্রাইজ গিফট দেব বলে ঠিক করে রাখছি।
—তাই! আগে বলবে তো। কোথায় আমার গিফট? আদুরে গলায় প্রশ্ন করল।
—গিফট রেডি করা আছে। কিন্তু ওয়েট করতে হবে। আজ রাত বারোটা এক মিনিটে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গান গাইতে গাইতে তোমাকে গিফট হস্তান্তর করা হবে।
—না, এখনই দাও। আমি এখনই দেখব।
—এখন তো কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। কারণ গানের সুরাটা এখনো পুরোপুরি আয়ত্তে আসে নাই। আরও কয়েকবার রিহার্সাল করতে হবে। একবার কি শুনবে নাকি?
—না, তোমার বেসুরো গলার গান শুনব না। আগে সুর আয়ত্তে আনো। প্রয়োজনে আরও এক বছর ভালোভাবে রিহার্সাল করো। তারপর আগামী বছর শুনব। তবে গিফটটা এখনই দাও।
—ওকে তোমার যদি দেরি সহ্য না হয়, কী আর করা। দাঁড়াও, আসছি। তবে গানটা শুনলেই পারতা, আমি কিন্তু খুব একটা খারাপ শিল্পী না।

ড্রয়ার থেকে একটা নীল খাম বের করে বউয়ের হাতে দিলাম। বউ মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে খামটা হাতে নিল।
—অনেক অনেক ধন্যবাদ। কি আছে এর মধ্যে? গিফট কার্ড? নাকি ক্যাশ?
খুশিতে গদগদ হয়ে প্রশ্ন করল।
—খুলে দেখো, তার থেকেও মূল্যবান কিছু।
আমার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
চোখে মুখে অনাবিল আনন্দ নিয়ে সে খামটা খুলল। খাম খুলতেই হাসি গায়েব। সেখানে এসে জমল বিরক্তি। সম্ভবত রাগও ছিল।
—এটা কি?
বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল।
—তোমাকে নিয়ে একটা রোমান্টিক কবিতা লিখছি।
—কেন? আমার কি রূপ বাড়ছে? যে আমারে নিয়ে কবিতা লিখেছ।
—এখানে রূপ বাড়া বা কমার ব্যাপার আসছে কেন? তোমার জন্মদিনে তোমাকে একটা ফ্রেশ কবিতা গিফট করলাম। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।
—অবশ্যই আমি খুশি, বহুত খুশি। এত খুশি হয়েছি যে, এখন খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। নাচি?
—নাচো। ইচ্ছে যখন করছে তখন অবশ্যই নাচবা। শোনো মনের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবা না। তুমি চাইলে আমিও তোমার সাথে জয়েন করতে পারি।
—তুমি কি আমার সাথে ফাজলামি করছ?
—ছি, ছি, কী যে বলো।
—অবশ্যই করছ, না হলে জন্মদিনে কবিতা উপহার! ওরে আমার কবিরে! ওরে আমার রবীন্দ্রনাথ!
—শোনো টিটকারি মাইরো না, অনেক আবেগ দিয়া এই কবিতা লিখছি। দাঁড়াও তোমাকে আবৃত্তি করে শোনাই। তোমার ভালো লাগবে।
বলেই সুর করে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলাম—
কখনো যদি দেখো, আমি তোমার সামনে নেই
ভয় পেয়ো না। কোথাও খুঁজতে যেও না আমায়,
আমি তো তোমার বুকের ভেতরই ঘুমিয়ে আছি...।
—শোনো, তোমারে খোঁজার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই। তোমার যেখানে মন চায়, সেখানে যাও। শুধু যাওয়ার আগে আমার জন্মদিনের গিফট দিয়ে যাও। না হলে তোমার খবর আছে। আজ কিন্তু রান্না বন্ধ।
উচ্চস্বরে কথাগুলি বলল।
—চ্যাতো কেন, আরও গিফট আছে। দাঁড়াও আনছি।
রঙিন কাগজে মোড়ানো একটি ছোট্ট গিফট বক্স আমার অফিসের ব্যাগ থেকে বের করে তার হাতে দিলাম। ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে প্যাকেটটি হাতে নিল। আমি সিওর এবার সে খুশি হবে। কিন্তু হলো উল্টোটা। প্যাকেট খুলে, অবাক চোখে প্রশ্ন করল।
—এইটা কি!
—ঘণ্টা।
—কিসের ঘণ্টা?
—গরুর গলায় পড়ানোর ঘণ্টা।
—এটা কার জন্য আনছ?
—আর কার জন্য আনব। তোমার জন্য আনছি।
—মানে কি? আমার জন্য গরুর গলার ঘণ্টা! দুনিয়ায় আর কিছু পেলে না? এই ঘণ্টা কী আমি গলায় ঝুলায়ে গরুর মতো মাঠে মাঠে ঘুরব আর ঘাস খাব? আমি কি গরু? ফাজলামি পেয়েছ, জন্মদিনে তুমি আমারে গরুর ঘণ্টা গিফট দিচ্ছ!
চিৎকার করে কথাগুলো বলল।
—সমস্যা কোথায়? তুমি খুশি হওনি? বিষয়টা অনেক রোমান্টিক না?
—গরুর ঘণ্টা রোমান্টিক! এই ব্যাটা তুই রোমান্টিক কী বুঝিছ? রোমান্টিক কারে বলে তুই জানিস?
—আবার তুই তোকারি করতেছ কেন? আমি তো ভাবছিলাম তুমি খুশি হবা। তোমার মনে নাই দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে ছবিতে শাহরুখ খান কাজলরে গরুর ঘণ্টা গিফট করেছিল। যা দেখে তুমি বলেছিলে, সো সুইট, সো রোমান্টিক। সে কথা মনে করেই তো এই ঘণ্টা কিনলাম। সারা ঢাকা শহর খুঁজছি, ওই কোয়ালিটির ঘণ্টা পাইনি। পরে গাবতলীর গরুর হাট থেকে এই ঘণ্টা কিনে আনছি।
—এই তুই কী নিজেরে শাহরুখ খান ভাবিছ? তুই কি শাহরুখ খান? না, তুই শাহরুখ খান না। তুই হচ্ছিস অমরেশ পুরি-অমরেশ পুরি-অমরেশ পুরি।
—আচ্ছা চেইতো না। ঠিক আছে আমি শাহরুখ খান না, অমরেশ পুরি। তিনবার বলার তো কোনো দরকার নাই। তবে গিফটগুলা কিন্তু ভালোবেসেই দিছিলাম। ভাবছিলাম তুমি খুশি হবা। কিন্তু আফসোস, তুমি এই গিফটের মূল্যই বুঝলা না।
—আমার মূল্য বোঝার কোনো ইচ্ছা নাই। তুমিই বোঝো। শোনো তুমি সবসময় আমারে বলো না, আমি তোমারে সারপ্রাইজ গিফট দেওয়ার সুযোগ দেই না। আমি আমার গিফট নিজেই কিনে নেই। এখন বুঝছ তো, কেন আমি এই কাজ করি। কারণ নিজের গিফট নিজে না কিনলে, তুমি আমারে শুধু গরুর ঘণ্টা আর কবিতাই দিবা। তোমার গরুর ঘণ্টার গিফট আমার লাগবে না। বরং এটা তুমি তোমার গলায় ঝুলায়ে ঘোরো। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য একটা গরুর মালাও কিনে দিব। দুটো এক সাথে গলায় দিয়ে ঘুরবে। তোমাকে অনেক মানাবে। আর শোনো, আমি এবার জন্মদিনে কী গিফট নেব তা আগেই ঠিক করে রেখেছি। আমি বসুন্ধরায় সোনার একটা হার দেখে এসেছি। ওটা তুমি এখন আমারে কিনে দেবে।
—সোনার হার! দাম কত?
—জানি না। তবে ওজন মাত্র চার ভরি।
—না জান, এত ওজনের হার পড়লে গলায় দাগ পড়ে যাবে। আমি চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক। তার চেয়ে বরং ছোট-খাটো কিছু একটা কিনো।
—ছোটলোকি করবে না। আমি ওই হারটাই কিনব।
—তুমি তো মনে হচ্ছে গলায় পাড়া দিয়া গিফট নিবা। আফসোস, কেন যে তোমার মতো একটা কমার্শিয়াল মাইন্ডের মেয়েকে বিবাহ করছিলাম।
—এক্সকিউজ মি। তুমি আমারে বিবাহ করোনি। আমি তোমারে বিবাহ করেছি।
—সরি ভুল হয়ে গেছে। আসলে বলা উচিত ছিল, কেন যে তোমার মতো একটা কমার্শিয়াল মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বসছিলাম।
—তোমার সাত জন্মের ভাগ্য, যে তোমারে আমি বিবাহ করেছি। না হলে তোমার মতো বলদরে কেউ বিবাহ করত না।
—ওকে মানলাম। আমি একজন প্রচণ্ড ভাগ্যবান পুরুষ। তুমি আমারে বিবাহ করে বাধিত করেছ। এখন এই ভাগ্যবান পুরুষকে যদি একটু নাশতা দিতা তাহলে খুব উপকার হতো। খেয়ে বাঁচতাম।
—নো ওয়ে। আমার গিফট কেনার আগে বাসায় সকল প্রকার রান্না বন্ধ। বাসায় কোনো চুলা জ্বলবে না। নো গিফট, নো চুলা।
—আগে যদি জানতাম বৈবাহিক জীবনে এত সমস্যা, তাহলে শালার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই ভর্তি হতাম না।
—বিবাহের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির কি সম্পর্ক, তা তো বুঝলাম না।
—অবশ্যই সম্পর্ক আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হলে কি আর তোমার সাথে আমার দেখা হয়? বিবাহ তো পরের কথা।
—তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এখন তো আর আফসোস করে কোনো লাভ নাই। তার চেয়ে চলো গিফটটা কিনে আনি।
—আচ্ছা একটা বিষয় খেয়াল করছ, অনেক দিন হলো আমরা ঝগড়া করি না। চল না আজ একটা কঠিন ঝগড়া করি।
—জি না। চালাকি করে লাভ নাই। গিফট কেনার আগে যতই চেষ্টা করো, ঝগড়া করছি না। তার চেয়ে বরং তুমি রেডি হও, বসুন্ধরায় যাব।
—জি আফা। আই রেডি আছি। আন্নে রেডি হন।
—খবরদার, তুমি আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলবে না।
—সরি আপা, আপনি রেডি হন, আমি রেডি আছি।
—তুমি রেডি মানে? তুমি কি লুঙ্গি পরেই যাবে।
—তুমি যা শুরু করছ, এভাবে চলতে থাকলে সামনে হয়তো লুঙ্গি না, গামছা পরেই বের হতে হবে।

বি. দ্রষ্টব্য. মলম পার্টি সাধারণত চোখে মলম দিয়ে সবকিছু নিয়ে যায়। আর আমার বউ তার থেকেও ভয়ংকর। সে চোখে মলম না দিয়েই সবকিছু নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তাকে সেই হারটাই কিনে দিতে হয়েছে। না দিয়ে উপায় কী, কিছু হলেই ঘরের চুলা বন্ধ হয়ে যায়। কী যে করি? বড়ই বিপদে আছি।

ইমদাদ বাবু: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>