নীরব সাক্ষী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সন্ধ্যা সাতটা। ডাক্তার অভি অপারেশন থিয়েটারে। এ সময় হঠাৎ করেই অভির ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিখিলের ফোন।

—দোস্ত, যত দ্রুত পারিস আত্মগোপন কর। অনন্ত আর ভাবিকে কিছুক্ষণ আগে র‍্যাব ধরে নিয়ে গেছে।
—বলিস কী!
—তুই এখনই সেজান পয়েন্টে এসে দাঁড়া। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। তোকে কোনো নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাব।
নিখিলের সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই বাসা থেকে বৃদ্ধ বাবার ফোন। হাউমাউ করে কেঁদে আর কথাই বলতে পারছেন না।
—বাবা, আমি আনু আপাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। আপা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। আমি এখনই ফোন বন্ধ করে দেব। নইলে পুলিশ ট্র্যাক করতে পারে।
নিখিল যথাস্থানে আগেই এসে অপেক্ষা করছে।
টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে নিখিল বাড়িতে এসে পৌঁছে। প্রত্যন্ত গ্রাম। চারদিকে নিশাচর আর ঝিঁঝি পোকার ডাক। ত্রয়োদশীর চাঁদটা তখন মাঝ আকাশে।
উপস্থিত যা ছিল, তা কোনো রকমে খেয়ে অভি শুয়ে পড়লে নিখিল বলল, দোস্ত, ঘুমিয়ে পড়। দুজন একই ঘরে থাকা ঠিক হবে না। আমি পাশের ঘরেই আছি। বাড়ির আঙিনায় পাহারাদার বসিয়ে রাখছি। কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও বলে রাখি। কোনো রকমের ইঙ্গিত পেলেই তোকে এসে ডাকবে। তুই পেছনের দরজাটি খুলে নদীর পাড় ধরে দিবি এক দৌড়। পাঁচগাছা বাজারের সামনে ওই যে বটগাছটা, ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবি। তোর পেছন পেছন আমিও আসব। তারপর দুজনে মিলে অন্য কোথাও...।
ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই অভির মনে পড়ল সব। এটি নিখিলের গ্রামের বাড়ি। এমবিবিএস থার্ড ইয়ার ফাইনাল শেষ হলে অভি একবার এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। দুই বন্ধু মিলে টানা দুই সপ্তাহ বেড়িয়েছিল। নিখিলের মা-বাবা আর ছিল ছোট বোন আলপনা। সে আলপনার মতোই নিখুঁত সুন্দরী। সদর কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত। অভি ডাকত আলো।
আলপনা ওকে বলেছিল, ভাইয়া, তুমি আমাকে আলো ডাকো কেন?
—তুমি আলোর মতোই সুন্দর।
—সূর্যের নাকি চাঁদের?
—অবশ্যই চাঁদের। পূর্ণিমায় পুকুরপাড়ের জোনাকি।
—ও তাই বুঝি, কবি হয়ে উঠলে নাকি?
—তোমাদের আপ্যায়ন। সবুজ সুন্দর পরিবেশ। তাই হয়তো-বা।
—আমাদের এখানে তোমার ভালো লাগে?
—অবশ্যই।
আড়ালে সরে গিয়ে স্নিগ্ধ স্বরে আলপনা বলেছিল, থেকে গেলেই তো পারো!
যৌবনের শুরুতে আলপনা সেদিন কী যেন ইঙ্গিত করেছিল। প্রতিষ্ঠার খেয়াল, অনেক অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন, সেদিন ওই ইঙ্গিতের গূঢ়ার্থ অস্পষ্ট থেকে গেলেও আজ সে বুঝতে পারছে। আজ নিখিলের বাবা নেই, মাও নেই। আলপনা অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হয়েছে। দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে সে ভালোই আছে। ছেলেটা নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনে পড়ছে। আর মেয়েটা সিডনি গার্লসে গ্রেড টেনের পরীক্ষা দিচ্ছে। বাড়ি পড়ে আছে খালি। মাঝেমধ্যে নিখিল আসে। সেদিনের অতি চেনা পরিবেশে আজ অচেনা সব।
হারিকেনের মৃদু আলোয় শুয়ে পড়ে অভি। আজকের এসব দুর্ঘটনা মনে পড়তেই মনটা ভয়ে কেঁপে ওঠে। এদিকে মনটা অতীতের ওই সুন্দর দিনগুলোয় হারিয়ে যেতে চাচ্ছে। ওই সুন্দর দিনগুলোর কথা ভাবতেই যেন ভালো লাগছে।
এভাবে শ্রান্ত চোখ দুটি তন্দ্রায় বন্ধ হয়ে আসতেই দরজায় মৃদু আঘাত। অপরিচিত কণ্ঠে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলছে, স্যার! স্যার! পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। স্যার, পুলিশ আসতাছে! নিখিল স্যার সিগারেট কিনতে গেছিল। দোকানের সামনেই ধরে ফেলছে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সহসা বজ্রাহতের মতো অভি ঘর থেকে বের হয়ে এক দৌড়ে মাঠে এসে নামে। নদীর পাড় ধরে দৌড়াতে থাকে অভি। এলাকায় একসময় ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে খ্যাতি থাকলেও বহু বছরের অনভ্যস্ততায় কিছুক্ষণ দৌড়েই তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। অদূরে শুকনো খালের পাড়ে একটা টিলার আড়ালে ক্লান্ত অভি ঘাসের ওপর বসে পড়ে।
পালুর জোছনা। রুপালি চাঁদটা ক্রমে লাল হয়ে আসে। মাঝেমধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে। পুলিশ হয়তো ধাওয়া করতে পারে। অদূরেই পাঁচগাছা বাজারের কাছে নীরব সাক্ষী ওই বটগাছটা। আজ তার চোখ দুটো বড় চঞ্চল। ঠিক তখনই দুই বছর আগে পরলোকগত মাকে মনে পড়ে অভির চোখ দুটো ভিজে ওঠে।
মনে মনে বলে, মাগো মা, তুমি ছেলেকে যেমন দেখতে চেয়েছিলে, ওই ছেলে আমি হতে পারিনি গো। মা, কী হতে কী সব হয়ে গেল।
অভি তখন স্থানীয় প্রাইমারি শেষ করে সবে হাইস্কুলে পা রেখেছে। এমনই একদিন বাড়িতে মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী সেতু তার দুই ছেলেকে নিয়ে এল বেড়াতে। বড় ছেলের বয়স এগারো আর ছোটটির বয়স আট। তিনি বিয়ের পরপরই ইংল্যান্ডে স্থায়ী হন। ছেলে দুটো আধভাঙা বাংলা বলে। ওরা দুভাই একত্রে বাংলায় একটা ওয়ার্ডও বলে না। একেবারে খাঁটি ইংলিশ। অভি অনেক চেষ্টা করছে ওদের সঙ্গে মিশতে কিন্তু ইংরেজিতে সে একটা বাক্যও ভালো করে বলতে পারছে না। মা বরাবরই ছেলে অভির এই অসহায়ত্ব লক্ষ করেন। দৃশ্যটা মাকে খুব আহত করে। তারপর মা খুব জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে অভিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করান। অভির মনেও তখন যথেষ্ট জেদ চেপে বসে। যে ইংলিশের কারণে অতিথিদের সঙ্গে বোবা হয়ে থাকতে হলো, ওই ইংলিশের গোড়া কোথায়, তা দেখে ছাড়বে বলে সে প্রতিজ্ঞা করে। এই জেদের কারণেই হয়তো সে খুব সহজেই ঢাকা মেডিকেলে চান্স পায়।
ছাত্রজীবনের পুরো সময়টা মা অভিকে যেন কোলেপিঠে করে আগলে রাখেন। ছেলেকে সুশিক্ষিত একজন আদর্শ ডাক্তার করে গড়তেই হবে, এই ছিল মায়ের প্রতিজ্ঞা। ইন্টার্নি শেষে অভি যখন প্র্যাকটিস শুরু করে, তখন চেম্বারের পাশেই তিন বেডরুমের একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে মা-বাবাকে নিয়ে আসে। মরুভূমির মতো ঢাকা শহরকে অভির সেদিন থেকেই ভালো লাগতে শুরু করে। মায়ের হাতের রান্না। বাবার জীবনের কত গল্প। আজীবন দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত মা-বাবার চোখেমুখে শান্তির হাসি। মাঝেমধ্যে চেম্বারে এসে লাইন ধরে বসে থাকা রোগীদের সঙ্গে মা-বাবা দুজনই কথা বলতেন। বাবা তেমন কথা না বললেও মা প্রত্যেক রোগীর সঙ্গেই নানান বিষয়ে কথা বলতেন। আর্থিক দিক দিয়ে কাউকে একটু দুর্বল মনে হলেই মা এসে তাঁর ডাক্তার ছেলেকে সতর্ক করে যেতেন—‘বাবা, এই রোগীর থেকে টাকা নিয়ো না।’
অভিও তা-ই করত। বরং ফ্রি স্যাম্পল ওষুধ দিয়ে দরিদ্র রোগীদের খুশি মনে চিকিৎসা করত। কিছুদিনের মধ্যেই ভালো ডাক্তার হিসেবে অভির নাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। বাড়তে থাকে হিতাকাঙ্ক্ষীর দল।
এরই মধ্যে অভির চমকপ্রদ এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। বিয়েটা হয়ে গেলেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড। দেশে থাকতে চাইলেও অসুবিধা নেই। বিসিএস পাস করতে যত রকমের লবিং দরকার, সব ওই পরিবারের হাতের মুঠোয়। আত্মীয়স্বজন হয়তো বেঁকে বসতে পারে, তাই অতি গোপনে এমনকি মা-বাবাকেও কিছু না জানিয়ে অভি ওই প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়। ওই দিনই বিকেলে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে মেয়ের ছোট মামার বাসায় অতি সংক্ষিপ্তভাবে শুভ কাজ সমাধা হয়ে যায়।
বিয়ের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অভির মা-বাবাকে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়। বলা যায় তাদের যেতে বাধ্য করা হয়। বাসায় শুরু হলো নিখুঁত ধর্মীয় অনুশাসন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কারও আর বাসার ধারেকাছে আসার উপায় রইল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছেলে অনন্তর জন্ম হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডও আর হয় না। বিসিএস তিনবার চেষ্টা করেও ওই লবিং ধরা গেল না। পরকালের রসদ জোগানোর চেষ্টায় ব্যস্ত স্ত্রী ঝুমু স্বামীকে ইহলোকের ভাবনা ছাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে, কোন স্কুলে কী পড়বে-এ নিয়ে অভির কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। স্বামীর আয়-ব্যয়ের পাই টু পাই হিসাব-নিকাশ, পাশাপাশি ছেলেকে কীভাবে শিক্ষা দিলে পরকাল সুন্দর হবে, তা নিয়ে ভাবতে থাকে ঝুমু। এভাবেই বিভিন্ন টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে কেটে যায় বছরের পর বছর।
ওদিকে অভি নিজে না পারলেও মা-বাবার শান্তির জন্য সব ধরনের দেখভাল চালিয়ে যেতে থাকে। বাড়িতে দুজন কাজের লোক সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করে মা-বাবার। এক-দেড় বছর পরপর অভি বাড়িতে আসত। গাড়ি ভর্তি করে মা-বাবার জন্য নিয়ে আসত দরকারি সব শৌখিন জিনিস। মা-বাবা অভির মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে চোখের জলে কত দোয়া করতেন। এভাবেই একদিন মা চলে গেলেন। বাবার স্বাস্থ্য বেশ দুর্বল। বার্ধক্যজনিত নানান জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে তাঁর দেহে। তাই ঝুমুকে অনেক অনুরোধ করে অনন্তসহ এক সপ্তাহের জন্য এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠানো হয়। এই সুযোগে অভি বাবাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে চিকিৎসার জন্য। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যেই হয়তো বাবার চিকিৎসা শেষ হবে।
এমনই সময় অভির কাছে ফোন আসে ঝুমু আর অনন্তকে ওই আত্মীয়ের বাসা থেকে র‍্যাব তুলে নিয়ে গেছে। এদিকে অভির বাসায় চলল র‍্যাবের তল্লাশি। অনন্ত কোথায় কী করে গত দুই মাস তার কোনো হদিস ছিল না। একদিন বাসায় তো দশ দিন বাসার বাইরে।
সবকিছু ছাপিয়ে এখন মাকেই বেশি মনে পড়ছে অভির। আনু চাচাতো বোন হলেও আপন বোনের অধিক। আনু আপা এসে বাবাকে ওর নিজের বাসায় নিয়ে যাবে। ভালোই থাকবেন বাবা। বাসায় র‍্যাবের যম তল্লাশি দেখে বাবা খুব ভয় পেয়েছেন। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। বাড়ি থেকে আসার সময় একবার অসুস্থ মা লাঠিতে ভর করে অতি কষ্টে বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত এসে বলেছিলেন, ‘বাবা, কেমন আছিস? বউমা তোর দেখভাল করে তো?’
মা-বাবার এই অসহায় অবস্থা সেদিন অভিকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। তাঁর মনে হতে থাকে মা আর বেশি দিন বাঁচবেন না। ভিজে আসা চোখ দুটো আড়াল করে অভি বলে, করে গো মা, করে।
তারপর মনে মনে বলে, কোনো কিছু না ভেবে যে ফাঁদে আটকিয়েছি। এ জীবনে আর বের হতে পারব বলে মনে হয় না গো, মা।
মা চোখ মুছে বলেন, বাবা, আমরা বুড়া হয়ে গেছি। ভালো-মন্দ মিলিয়ে জীবন কাটছে কোনো রকম। তুই শান্তিতে থাক। তোর শান্তিই আমাদের শান্তি।
কথাগুলো মনে পড়তেই অভি সিদ্ধান্ত নেয় এখনই হাঁটতে শুরু করবে। সদরে পৌঁছতে হয়তো সকাল হয়ে যাবে। ওখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে সোজা চলে যাবে বাড়িতে। মায়ের কাছে। মায়ের কবরের মাটিতে মায়ের ঘ্রাণ আছে। অশ্রুভেজা চোখে অভি ধীরপদে হেঁটে মুছে যাওয়া সময়ের নীরব সাক্ষী বটগাছটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ কীসের সাড়া পেয়ে সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে, সাত-আটজন কালো ছায়ার মতো তার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। বেশ কয়েকটি বিকট গুলির শব্দ। সাথে সঙ্গেই শোনা গেল নিখিলের আর্তচিৎকার।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>