জাপানের শীতকাল উপভোগ করা

সেৎসুবুন দিনের বিশেষ খাবার এহৌমাকি
সেৎসুবুন দিনের বিশেষ খাবার এহৌমাকি

জাপানের শীতকাল ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু জাপানে অনেকেই মনে করেন, নভেম্বর বা ডিসেম্বরে শীত চলে আসে। পুরোনো দিনে জাপানিরা পঞ্জিকা অনুসরণ করে ঋতুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য আজকাল দেখা যায়। জাপানের শীতকালে গাছ আর পাতা মরে যায়। আকাশ খুব অনুজ্জ্বল থাকে, এ রকম দিন শীতকালে অনেক আছে। আবার ঠান্ডা আর প্রবল বাতাসও মাঝে মধ্যে বয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা সেই অবস্থাতেও বাইরে আনন্দের সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু বয়স্ক লোকজন ভেতরে থাকতে পছন্দ করেন। ঠান্ডা আবহাওয়া আর অনুজ্জ্বল দিনে মানুষ সাধারণত বিমর্ষ বোধ করেন। তবে জাপানের শীতকালে মজার ঘটনাও অনেক আছে। এখানে তা নিয়ে আমি কথা বলব।

জাপানে খ্রিষ্টান কম। তবে ডিসেম্বরে গাছ আর ভবন সাজানো হয়। লাল, সবুজ ও সাদা রঙের আলো ব্যবহার করে সাজানো জায়গায় অনেক মানুষের ভিড় দেখা যায়। বাজারে বড়দিনের নানারকম পণ্য বিক্রি হয়। বড়দিন মানুষ নানাভাবে পালন করে থাকেন। কেউ বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে কেক খায়। অন্য কেউ হয়তো বন্ধুর সঙ্গে পার্টিতে যায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা এই সময় কেনাকাটা করেন। জাপানের সংস্কৃতিতে টার্কির মাংস খাওয়ার প্রচলন নেই। কিন্তু অনেক স্বাদু খাবার টেবিলে রাখা হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করে যে, সান্তা ক্লজ তাদের জন্য চমৎকার উপহার নিয়ে আসবে। তাই তারা অন্যান্য দিনের চেয়ে আগে ঘুমতে যায়। কারণ হচ্ছে, সান্তা ক্লজ খুব লাজুক বলে ওরা জেগে থাকলে উপহার নিয়ে তিনি ফিরে যাবেন। মা ছেলেমেয়েদের ঘনঘন বলেন, তোমরা যদি ভালোভাবে চলতে না পার, সান্তা ক্লজ তাহলে তোমাদের জন্য কোনো উপহার আনবেন না। আর শিশুরা সে কথা বিশ্বাস করে বলে ডিসেম্বর মাসে ওরা ভালো শিশু হয়ে থাকার চেষ্টা করে। তাই বিশ্বের মায়েদের জন্য এটা যেন হচ্ছে জাদু-বাক্যের মতো। পরিবারের কাছে থাকলে কিংবা পরিবার থেকে দূরে থাকলেও বড় দিন আমাদের জন্য হচ্ছে পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সময়।
বড়দিনের পর নতুন বছর চলে আসে। জানুয়ারির ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত জাপানে হচ্ছে ‘ওশোগাৎসু’। এই তিন দিন জাপানে নতুন বছরের ছুটির দিন। সেই দিনে অনেক ব্যবসা বন্ধ থাকে। তাই মানুষ দেশের বাড়িতে ফিরে যায়, সেখানে নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। ছুটির মধ্যে তারা পরিচিতদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে নতুন বছরের অভিনন্দন বিনিময় করেন। আমাদের ভাষায় সেই অভিব্যক্তি হচ্ছে ‘আকেমাসিতে-ওমেদেতো’। তারপর তারা গত বছরের ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। অনেক দিন ধরে দেখা না হওয়ায় অন্তরঙ্গ অনেক আলাপ মানুষ তখন সেরে নেন।

বড়দিনের খাবার
বড়দিনের খাবার

সেই ছুটির মধ্যে লোকজন ‘শিন্তো’ মন্দিরে যান। শিন্তো মন্দিরকে জাপানে বলা হয় ‘জিঞ্জা’। সেখানে নতুন বছরে নিজের আর নিজের পরিবারের ভালো থাকার জন্য প্রার্থন করেন। এটাকে ‘হাৎসুমৌদে’ বলা হয়। জাপানের প্রচলিত রীতি এটা, তবে সেই অর্থে ধর্মাচার নয়। শুধু সেই রীতি অনুসরণ করে প্রার্থনা করার জন্য মন্দিরের সামনে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। প্রার্থনার পরে অনেকে আবার মন্দিরে রাখা ‘ওমিকুজি’ কাগজ টেনে নেয়। ওমিকুজি হচ্ছে লটারির মতো। সেই কাগজে ঈশ্বরের উপদেশ লেখা থাকে। কিন্তু সেই উপদেশ মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। জাপানিরা সেই উপদেশ মনের একটি অংশে রেখে দিয়ে নিজেদের মতো করে চিন্তা করে নেন। ফলে সেদিক থেকে দেখলে জাপানিরা যে ধর্মবিশ্বাসী তা অবশ্য বলা যায় না।
জানুয়ারির পরে ফেব্রুয়ারি আসে। সেই মাসে ‘সেৎসুবুন’ আছে। সেই আয়োজন প্রতিবছর ভিন্ন দিনে হয়ে থাকে। তবে জাপানিদের জন্য সেটা খুব জরুরি। সেই দিনে সয়াবিনের দানা হাতে নিয়ে তারা সেটা ছিটিয়ে দেয়। জাপানের রাক্ষসের সয়াবিন দানা অপছন্দ। তাই জাপানিরা মনে করে যে সয়াবিন দানা বাইরের দিকে ছুড়ে দিলে বাড়ি থেকে রাক্ষস পালিয়ে যাবে। আর তাই সেৎসুবুন হচ্ছে পরিবারের সকলের স্বাস্থ্যকর থাকার জন্য প্রার্থনা করার দিন। মানুষ সয়াবিন নিক্ষেপ করার সময় চিৎকার করে যে বাক্য বলে সেটা হচ্ছে ‘ওনিওয়া-সোতো! হুকুওয়া-উচি’। ‘ওনিওয়া-সোতো’ বাক্য হচ্ছে রাক্ষস তাড়ানোর জাদু, আর পরের বাক্য ‘হুকুওয়া-উচি’ হচ্ছে সদয় ভগবানকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করার জাদু। দ্বিতীয় সেই বাক্য বলার সময় সয়াবিন দানা বাড়ির ভেতরে নিক্ষেপ করতে হয়। মানুষ এরপর ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা সয়াবিন কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলো খায়। কতটা সয়াবিন খেতে হবে তা হচ্ছে একেকজনের বেলায় একেকরকম। যেমন, আমার বয়স ২১ বলে ২২টি সয়াবিন দানা আমি খাব। ১৯ বয়সের ছোট বোন খাবে ২০টি সয়াবিন দানা। অর্থাৎ, নিজের বয়সের চেয়ে ১টি বেশি সয়াবিন খেতে হয়।
আর ‘সেৎসুবুন’ দিনের বিশেষ একটি খাবার আছে, সেটা হচ্ছে ‘এহৌমাকি’। ‘এহৌমাকি’ হচ্ছে একধরনের ‘সুশি’। কিন্তু, সাধারণ সুশির চাইতে এটা ভিন্ন। এহৌমাকি লম্বা আর সরু। আর সেটার ওপরে কালো রঙের ‘নোরি’ প্যাঁচানো থাকে। সেটা খাওয়ার কিছু নিয়ম আছে। প্রথমে, সেই বছরের দিকে মুখ করে এটা খেতে হয়ে। জাপানে চারটি দিকের বৈশিষ্ট্য প্রতি বছরে আলাদা। এ ছাড়া এহৌমাকি খাওয়ার সময় কোনো কথাও বলা যাবে না। কথা বললে প্রাপ্তি শূন্য হয়ে যাবে। এসব নিয়ম আছে বলেই এহৌমাকি মজা।
এইভাবে, জাপানের শীতকালের নানা ঘটনা আছে। সেগুলো সবই মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরও আমি জাপানের শীতকাল উপভোগ করতে চাই।

ইয়ুকারি সুবোই: টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।