জাপানের সংবিধান

জাপানের সংসদ ভবন। সংগৃহীত
জাপানের সংসদ ভবন। সংগৃহীত

জাপানের সংবিধান পরিবর্তন করা হবে কিনা সেই প্রশ্নে জাপানে এখন বিতর্ক চলছে। এটা হচ্ছে এই সময়ে জাপানের সমাজের বড় এক সমস্যা।

আমাদের দেশের সংবিধানে ৭১ বছর ধরে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু আজকাল সংবিধান সংশোধনের আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে আমার নিজের অবস্থান কী সেটা আমি এখানে বলব না। তবে জাপানের সংবিধানের ইতিহাস আর সংবিধান নিয়ে নানারকম যেসব মত রয়েছে, সেগুলো এখানে আমি তুলে ধরব।

ইতিহাস
আমাদের সংবিধান ১৯৪৬ সালে প্রণয়ন করা হয়। আসলে এই সংবিধানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খুব গভীর। আমরা ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে গেলে জাপানে মার্কিন শাসন শুরু হয়েছিল। আমাদের দেশ এর আগে পর্যন্ত ছিল রাজতন্ত্র। আমরা সম্রাটকে ‘মানুষের রূপে আবির্ভাব হওয়া দেবতা’ হিসেবে দেখতাম। আমাদের দেশ তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। দেশের শাসন ব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, আমেরিকার মতো রাজনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে জাপানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা হবে। তখন থেকে জাপান বিষয়ে নানা নীতি যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করে। যেমন, সম্রাটের রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করে তাঁকে শুধু জাপানের প্রতীক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর জাপানের শিক্ষার বিষয়ও গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও নানারকম বদল করা হয়েছে। বিশাল আকারের যেসব কোম্পানি বেশি করে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছিল, সেগুলো ভেঙে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের কোম্পানি তৈরি করে নেওয়া হয়।

এ রকম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একসময় নতুন সংবিধান রচনার প্রয়োজনীয়তা কথা জাপানকে জানায় এবং এভাবেই আমাদের বর্তমান সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল।

সংগৃহীত
সংগৃহীত

মেইজি সংবিধান

বর্তমানের সংবিধান আমাদের দেশের প্রথম সংবিধান নয়। মেইজি যুগেও আমরা সংবিধান বানিয়েছিলাম। ১৮৬৭ এদো যুগ শেষ হলে নতুন মেইজি যুগের সূচনা তখন থেকে হয়।
মেইজি যুগের শুরুতে অল্প কয়েকজন নেতার হাতে সব রকম ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল এবং তাঁরা আমাদের দেশের সব রকম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সেই সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। তাই সরকারকে ধীরে হলেও সেই দাবি একসময় মেনে নিতে হয়েছে। মেইজি যুগে আমরা পশ্চিমের দেশের মতো উন্নত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। যেমন পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের মতো সামরিক বাহিনী আমরা গঠন করেছি। রপ্তানি আয় কাজে লাগিয়ে বস্ত্র ও সুতা তৈরি করার কারখানা নির্মাণ করেছি। উন্নতির এ রকম প্রক্রিয়া চলতে থাকা অবস্থায় রাজনীতির ক্ষেত্রেও একসময় আমরা পশ্চিমের দেশের পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করি।
১৮৮৫ সালে জাপানে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল এবং ১৮৮৯ সালে আমরা সংবিধান প্রণয়ন করি। কিন্তু সেই সংবিধানের সঙ্গে এখনকার সংবিধানের পার্থক্য প্রচুর। যেমন, আমাদের এখনকার সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতা দেশের সাধারণ জনগণের হাতে ন্যস্ত রয়েছে। কিন্তু মেইজি সংবিধানে সম্রাটের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল সবার ওপরে। আর আমাদের বর্তমান সংবিধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে যেটাকে গণ্য করা হয়। সেই মানবাধিকার আর ব্যক্তির মর্যাদার প্রতি সম্মানের বিষয়টি মেইজি সংবিধানে ছিল অনুপস্থিত।
এখনকার সংবিধান আর মেইজি সংবিধানের মধ্যে এ ছাড়া আরও নানা তফাত আছে। দেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য বর্তমান সংবিধান অবশ্যই অনেক ভালো। কিন্তু একদল জাপানি বলছেন যে, আধুনিক এই সংবিধান বদল করা উচিত। অন্যদিকে আরেক দল জাপানি বলছেন যে, বদল করা উচিত নয়। উভয় অবস্থানের পরিচিতি এখানে আমি তুলে ধরতে চাই।

সংবিধান বদলের পক্ষের মত

যারা বলছেন সংবিধান বদল করা উচিত, তারা ভাবছেন যে বর্তমান সংবিধান আমাদের সমাজের জন্য ভালো নয়। সংবিধান ৭১ বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছিল বলে এখনকার জাপানের সমাজ ৭১ বছরের আগের মতো একই রকম অবশ্যই নয়। যেমন, সংবিধানে লেখা আছে যে নারী ১৬ বছর বয়স থেকে বিয়ে করতে পারবে, আর পুরুষ পারবে ১৮ বছর বয়স থেকে। কিন্তু আধুনিক সমাজের জন্য এই নিয়ম ভালো নয়। এই নিয়মে নারী আর পুরুষের প্রতি একই রকম আচরণ প্রদর্শন করা হচ্ছে না। আর যারা এতটা তরুণ বয়সে বিয়ে করতে আগ্রহী তাদের সংখ্যা খুব কম বলে সংবিধানের এই অংশটি বদল করা উচিত।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিরও অনেক বদল হয়েছে এবং বাইরের অনেক দেশও বলছে যে জাপানের উচিত হবে সংবিধান পরিবর্তন করা।

মেইজি যুগ। সংগৃহীত
মেইজি যুগ। সংগৃহীত

সংবিধান বদল না করার পক্ষের মত

যারা ভাবছেন সংবিধান বদল করা উচিত নয়, তারা বলছেন জাপানের সংবিধানে উল্লেখ থাকা শান্তির ধারা অবশ্যই রক্ষা করা দরকার। তাঁরা আশঙ্কা করছেন যে, সংবিধানের কোনো একটি অংশ বদলের উদ্যোগ একবার নেওয়া হলে সেই অংশটিও বদল করে নেওয়া হতে পারে। সেরকম সম্ভাবনা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

আমার মত

সবশেষে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে আমার নিজের মতামত আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। আমার অবস্থান সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে। আমি মনে করি আমাদের আধুনিক জীবনযাপনের প্রতিফলন যেখানে ঘটবে, সেভাবে সংবিধানের কিছুটা পরিবর্তন করা দরকার। যেমন, জাপানের নাগরিকদের বিয়ে করার বয়সের বেলায় নারী আর পুরুষের যে পার্থক্য, সেটা বদল করা উচিত। আর নতুন কিছু অধিকারও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে। যেমন, পরিবেশের অধিকার, গোপনীয়তার অধিকার, সরকারির তথ্য জানার অধিকার ইত্যাদি। এ ছাড়া সংবিধানের ভাষাও পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়ে। সংবিধানের ভাষা আমাদের আধুনিক জাপানের ভাষার মতো নয় বলে এখনকার প্রচলিত ভাষায় সেটা লেখা উচিত। তবে সংবিধানে উল্লেখ থাকা শান্তির ধারা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।

কোসুকে কানেশিরো: টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।