জাপানের বাধ্যতামূলক শিক্ষা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

চরিত্র গঠনের শিক্ষা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? ইতিহাস থেকে? গণিতবিদ্যায়? আমার তো মনে হয় অনেকে স্কুলে সেটা শিখেছে। আমিও সেখানে শিখেছি। স্কুলে অনেক কিছু শেখা যায়। যেমন ভাষা, চরিত্র ইত্যাদি। সেরকম শিক্ষা ছাড়াও, মানুষের সঙ্গে কথা বলার মতো সামাজিকতাও আমরা স্কুলে শিখতে পারি। সেরকম স্কুল আমাদের জন্য খুব জরুরি। জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয় আর মিডল স্কুল বা জুনিয়র হাইস্কুলের সঙ্গে আমি এখানে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব।

জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয় আর মিডল স্কুল হচ্ছে বাধ্যতামূলক শিক্ষার পর্যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছয় বছর, মিডল স্কুল তিন বছর এবং দুটি একত্রে যোগ করে নিলে হয় মোট নয় বছর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুরা ছয় বয়স থেকে যায়। সেই বয়স হলেই কেবল শিশুরা স্কুলে যেতে পারে। অনেক শিশু সরকারি স্কুলে যায়। তবে বেসরকারি স্কুলেও কেউ কেউ যায়। আগে আমি বলেছি, ছয় বছর বয়স হলে স্কুলে যাওয়া যায়। জাপানের প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রী যখন স্কুলে যেতে শুরু করে, তখন একটি টুপি ওরা পরে আর ‘রানদোশেরু’ নামের থলের ভেতরে পাঠ্যপুস্তক রাখে। টুপি একেক স্কুলের ভিন্ন রং আর আকারের হয়। কিছু স্কুলে একই রকম পোশাকের ব্যবস্থা আছে। তবে টুপির বেলায় স্কুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর রানদোশেরু দেখতে ব্যাক-প্যাকের মতো। সেটা বর্গাকারের ও একটু বাঁকানো এবং কঠিন ও বেশ মজবুত। সেটা নানা রঙের হয়ে থাকে। সাধারণত ছেলেরা কালো, তবে মেয়েরা লাল রঙের সেই ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে স্কুলে যায়। তবে আজকাল নীল, আকাশি ও সবুজ রঙেরও দেখা যায়। শিশুর স্কুলে যাওয়ার সময় তখন সেগুলো পিঠে ঝুলিয়ে নেয় এবং বন্ধুদের সঙ্গে মিলে স্কুলের পথে ওরা হেঁটে যায়। স্কুলে আসার পর অনেক স্কুলে জুতা বদল করে করে ঘরের জুতা পরে নিতে হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা রকমের ক্লাস আছে। যেমন জাপানি ভাষা, গণিতবিদ্যা, ইতিহাস, শরীরচর্চা, সংগীত ও শিল্প ইত্যাদি। শিশুরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ক্লাস করে। সেরকম একেকটি ক্লাসে এদের সংখ্যা হচ্ছে ৩৫-৪০ জন। প্রতি ক্লাসের জন্য একজন শিক্ষক থাকেন। তিনি ক্লাসে শিশুদের বিভিন্ন বিষয় শেখান। কিন্তু সংগীত আর শিল্প শিক্ষার বেলায় বিশেষজ্ঞ শিক্ষক শিশুদের শেখান। এ ছাড়া জাপানের স্কুলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু কাজকর্ম শিশুদের করতে হয়। যেমন দুপুরের খাবার সময়, পরিষ্কার করা সময় এবং সকালের সমাবেশের সময়।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

অনেক স্কুলে শিশুরা নিজের বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার আনে না। স্কুলে খাবার তৈরি করা হয় এবং সেই খাবার ছাত্রছাত্রীদের খেতে দেওয়া হয়। সকালের ক্লাস শেষ হলে প্রতিটি ক্লাসে খাবার আসে। খাবার বড় পাত্রের ভেতরে রাখা থাকে। খাবারের মধ্যে যেমন আছে ভাত, রুটি, নুডলস, তরকারি, মাছ, মাংস ও ফল ইত্যাদি। প্রতিদিন সেটার পরিবর্তন হয়। তবে শুধু দুধ প্রতিদিন একই রকম থাকে। ক্লাসে খাবার এলে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের প্লেটে সেগুলো তুলে নেয়।
জাপানের স্কুলে ক্লাসরুম পরিষ্কারের দায়িত্বও ছাত্রছাত্রীদের। দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে ও দিনের সব ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই কাজ ওরা করে। ক্লাসরুম ছাড়া বারান্দাও ওদের পরিস্কার করতে হয়। সেখানে ঝাড়ু দিয়ে, ধুলা ঝেড়ে তার তারপর কাপড় দিয়ে মেঝে ওরা মুছে নেয়। প্রতিদিন সেই কাজ ওরা করে।
সকালের সমাবেশ হচ্ছে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে স্কুলের বাগান ও জিমনেসিয়ামে সব শিশুর মিলিত হওয়া। প্রধান শিক্ষক আর অন্য শিক্ষকেরা সেখানে কথা বলেন। সেই সমাবেশ অবশ্য প্রতিদিন হয় না।
জাপানের স্কুলে শিক্ষা ছাড়াও নানারকম অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। যেমন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ও স্কুল উৎসব ইত্যাদি। এ রকম উৎসবের জন্য ছাত্রছাত্রীদের অনেক আগে থেকে তৈরি হতে হয়। তাই ওদের জন্য এসব হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। এর বাইরে স্কুল ভ্রমণও আছে। সেটা যেমন বনে ক্যাম্প করে থাকা কিংবা জাপানের অন্য শহর যাওয়া।
এরপর আসছে মিডল স্কুলের কথা। জাপানে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ হলে মিডল বা জুনিয়র হাইস্কুলে যেতে হয়। অনেকে সরকারি স্কুলে যায়। এর জন্য কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। তবে কেউ কেউ বেসরকারি স্কুলে যায়। সেরকম স্কুলে অবশ্য ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। মিডল স্কুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো হলেও ভিন্ন কিছু দিকও সেখানে আছে, যার পরিচয় আমি এখানে দেব।
মিডল স্কুল সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য একই রকম কিছু ব্যবস্থা আছে। যেমন একই পোশাক এদের পরতে হয়, তবে ছেলেদের বেলায় ট্রাউজার হলেও মেয়েদের পরতে হয় স্কার্ট। এ ছাড়া নানারকম নিয়ম সেখানে মেনে চলতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নিয়মকানুন আছে, তবে মিডল স্কুলের নিয়ম হচ্ছে অনেক কঠোর। যেমন চুল রং করা নিষেধ এবং স্কার্ট যেন যথেষ্ট লম্বা হয় মেয়েদের সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।
শিক্ষার বেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতোই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে যোগ দেয়। তবে একজন শিক্ষক সেখানে একটি ক্লাসে সব বিষয় শেখান না। প্রতিটি বিষয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষক শিখিয়ে থাকেন। আর মিডল স্কুল থেকে লেখাপড়া শুরুর শিক্ষাও আছে, সেটা হচ্ছে ইংরেজি। প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ইংরেজি শেখানো হয়, তবে মিডল স্কুলে ব্যাকরণের মতো আরও বিস্তৃত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত।
মিডল স্কুলে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ছাত্রছাত্রীদের দিতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা কোন হাইস্কুলে যাবে, সেই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর তা নির্ভর করে। তাই তারা শেখার চেষ্টা সেখানে করে। সেই পরীক্ষা প্রতি সেমিস্টারে একটি কী দুটি হয়ে থাকে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আর মিডল স্কুল থেকে ক্লাব কাজকর্ম শুরু হয়। সেটা হচ্ছে খেলাধুলা, সংগীত আর শিল্পের মতো বিভিন্ন দিকে নিজেদের উৎসাহ অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের সমবেত করা। যেমন ফুটবল, বাস্কেটবল, ব্রাশ ব্যান্ড-এ রকম ক্লাব স্কুলে আছে। সেখানে মজা করে ছাড়াও সামাজিকতাও ওরা শিখতে পারে। যেমন নিজের চেয়ে বয়সে বড় মানুষদের কীভাবে সম্মান করতে হয়, জাপানের সেই জ্যেষ্ঠতা ব্যবস্থার পাঠও সেখানে ওরা পায়।
মিডল স্কুল শেষ করে অনেকে হাইস্কুলে গেলেও কেউ কেউ আবার কাজ করতে শুরু করে। হাইস্কুলে যাওয়ার জন্য সবাইকে পরীক্ষা দিতে হয়। কারণ হাইস্কুল বাধ্যতামূলক শিক্ষা নয়। স্কুল নিজের পছন্দের মতো ছাত্রছাত্রীদের বেছে নেয়। সে জন্যে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা সেই পুরো এক বছরে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন বিষয় শেখার চেষ্টা করে।
জাপানের স্কুল ব্যবস্থায় এ রকম নানারকম বৈশিষ্ট্য অনেক আছে। শিশুরা সেখানে দিনের অনেকটা সময় কাটায় এবং অনেক কিছু শিখতে পারে। আমার মনে হয় পরবর্তী জীবনে সেগুলো এদের জন্য খুবই উপকারী হয়ে দেখা দেয় বলে সেরকম শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নাহো তানাকা: টোকিওর বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।