লাগেজ বিড়ম্বনা

লেখিকা
লেখিকা

বরের সঙ্গে আমেরিকা যাচ্ছি—২০০৮ সালের কথা। দুজনই চাকরি-টাকরি ছেড়ে আবার ছাত্রাবস্থায় ফিরে যাচ্ছি। উত্তেজনার সঙ্গে উৎকণ্ঠারও শেষ নেই। ফ্লাইট রাত ৯টায়। দুপুর চারটা পর্যন্ত ব্যাংকেই দৌড়াদৌড়ি করলাম। শুরু থেকেই বিপদ আমাদের পিছু নিল। প্লেন ছাড়ল সময়মতো কিন্তু পাঁচ মিনিট পরই আবার ফিরে এল। কি কারণ? একটি চাকা নাকি খুলে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড! চাকা চেক না করে তারা কী করে প্লেন ছাড়ল?

যা হোক, চাকা ঠিক করতে গিয়ে তারা রাত একটা বাজিয়ে ফেলল। ফ্যাক্টরি থেকে চাকা কিনে এনে লাগাতেও হয়তো এর চাইতে কম সময় লাগে। একটা সময় প্লেনের শিশুযাত্রীরা ফুসফুসের সর্বশক্তি দিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। কান্নার জন্যই কিনা কে জানে দয়া হলো কেবিন ক্রুদের। বাচ্চাদের খাবার দিলেন তারা। কিন্তু বুড়োদের নয়। আমার মতো বুড়োরা ক্ষুধা সহ্য করতে পারে এটাই হয়তো কাতার এয়ারওয়েজের বিশ্বাস!
কাতার পৌঁছলাম বেকায়দা এক সময়ে। তার চেয়েও বড় দুঃসংবাদ, আমাদের কানেকটিং ফ্লাইট আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বললাম, সম্ভব নয়, যেভাবে পার আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দাও।
—তোমাদের হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
—হোটেলে থাকতে চাই না। আমাদের এক জায়গায় রিপোর্ট করতে হবে ৭ তারিখে। এখানে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করলে সেটি সম্ভব নয়।

কাউন্টারের নারী কর্মীর দয়া হলো। তিন ঘণ্টা পর ওয়াশিংটন ডিসির একটি ফ্লাইটে তিনি আমাদের তুলে দিলেন।
আমাদের অরিজিনাল রুটতো অনেক আগেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ঢাকার সেই চাকার ঘটনার কারণে। নানা স্টেট ঘুরে মিনেসোটা পৌঁছলাম। কনভেয়ার বেল্টে এক ঘণ্টা ব্যয় করবার পর বুঝলাম যে, একটি লাগেজ এসেছে, তিনটি আসেনি! সেই একটি লাগেজ আমার।
আমরা ইউনিভার্সিটির কাছে বাসা ভাড়া নিলাম। বর দোকানে গিয়ে কাপড়চোপড় কিছু কিনল, আমিও কিনলাম। এক সপ্তাহ পর বাসায় দুটি লাগেজ হাজির। লাগেজ ফেরত পাব সেই আশা মোটামুটি ছেড়েই দিয়েছিলাম। খুললাম একটার ডালা। তুলোধুনো বোধ হয় একেই বলে। এমন কোনো জিনিস নেই যেটি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ঘেঁটে দেখেনি। বিয়ের স্যান্ডেল জোড়া ছিল সেই লাগেজে। যেটির হিলের শক্ত পাথরও তারা খুলে ফেলেছেন। শক্তির তারিফ করতেই হয়! আমার শখের গয়নাগুলোর পর্যন্ত করুণ দশা। কাঁদলাম কিছুক্ষণ জুতো আর গয়নার শোকে। হঠাৎ দেখি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির ছোট্ট একটা নোট। যার বিষয়বস্তু—কোনো জিনিসের ক্ষতি হয়ে থাকলে আমরা দুঃখিত। দুঃখ প্রকাশ করেই তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন।
তারপর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। আমরা ক্লাস শুরু করেছি ইউনিভার্সিটিতে। বর ঠিক করলেন ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন এয়ারলাইনের কাছে। একটি লাগেজের নামগন্ধ তখনো নেই। দাবিদাওয়া পর্যন্ত যেতে হলো না। কারণ দুই দিন পর হঠাৎ ফেডেক্সে করে হাজির সেই হারানো লাগেজ। খোদা জানে বেচারা লাগেজ কীসের ভেতর দিয়ে গিয়েছিল কারণ তার একপাশ থেকে অন্যপাশ ছিল ছেঁড়া। চেইন লাগানোর অবস্থা নেই বলে প্লাস্টিকের ব্যাগে করে পাঠানো হয়েছে লাগেজটিকে। খুশি হয়েছিলাম ফেরত পেয়ে কারণ কোনো কিছু খোয়া যায়নি এক মাসেও। কিন্তু অপেক্ষাটা বড় বিরক্তিকর ছিল। লাগেজটিকে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাবে না সেটি ভেবেও কিঞ্চিৎ দুঃখ পেয়েছিলাম।

ওয়ারা করিম: মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র।