বর্ণাঢ্য নাট্যানুষ্ঠান আর প্রিয় মুখের দর্শন

মুন্নী ও সাত চৌকিদার নাটকের একটি দৃশ্য
মুন্নী ও সাত চৌকিদার নাটকের একটি দৃশ্য

একটা ফোন। আমি স্বাগত জানাই। আজই আমাদের নাটক। চলে আসুন সপরিবার! হাতে আমার কাজ। আমি শুনছি।

এমন ক্ষেত্রে সাধারণত না বলি না। এর আগে রানা মুখার্জি পরিচালনা করতেন। তিনি দেশে ফিরেছেন। তার বেলায় এই সম্পর্কটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আজ অন্য প্রান্তে জয়দীপ চক্রবর্তী। তিনিই নাটক দুটো পরিচালনা করেছেন। এর আগে এক অনুষ্ঠানে এ ব্যাপারে একটু ধারণাও দিয়েছিলেন। সুতরাং এ আমন্ত্রণ আমার জন্য হঠাৎ নয়। কাজেই বলে দিয়েছিলাম, আসছি।
আবুধাবির ইন্ডিয়া সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে (আইএসসি) সেদিন দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রথমটি বনানী মুখার্জির ‘স্বপ্নের পাখি’ গল্প অবলম্বনে স্বপ্ন ছায়া। ৩ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যার এ উপস্থাপনাটি ছিল পরিচ্ছন্ন ও নিখুঁত। অভিনয়েও দারুণ প্রশংসিত শিল্পীরা। মায়ের ভূমিকায় অর্পিতা রাহা অন্য একমাত্রা সংযোজন করেছেন। দ্বিতীয় নাটক মনোজ মিত্র লিখিত ‘মুন্নী ও সাত চৌকিদার’। হাসি ও কৌতুকে ভরা এ নাটক বিষয় বৈচিত্র্যে অনন্য। ওপার বাংলার ‘আমরা’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দর্শক শ্রোতারা দারুণ একটি সময় পার করেছেন।

স্বপ্ন ছায়া নাটকের একটি দৃশ্য
স্বপ্ন ছায়া নাটকের একটি দৃশ্য

স্বপ্ন ছায়ার মূল কথা, আশায় জীবন। স্বপ্নই মানুষকে সামনের দিকে নিয়ে যায়। কাহিনিতে রাজু-সুষমা দম্পতির দুজনই মঞ্চশিল্পী। রাজু অভিনয়ে আশানুরূপ কিছু করতে পারেননি। সে জন্য তিনি তার কন্যা ঝিলিকের মধ্য দিয়ে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান। অন্যদিকে সুষমা অভিনয়ে সফল হওয়ার দৌড়ে কঠিন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বুঝেছেন, এ পথ তার বা তাদের নয়। সে জন্য তিনি তার স্বামী ও কন্যার পছন্দকে মোটেই সায় দেন না। বরং বিরোধিতা করেন।
ঝিলিক মুভিতে অভিনয়ের সুযোগ পায়। মেয়েকে নিয়ে রাজু গৃহত্যাগ করে মুভি জগতে ছোটেন। সুষমা একা থাকেন বাড়িতে। যা হওয়ার তাই হয়। রঙিন দুনিয়ায় ঝিলিক বাঁক নেয় ভিন্ন পথে। মা ভেতরে-ভেতরে পুড়তে থাকেন। বাবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। কিন্তু সুষমা তার বেদনা, সংযমের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। দীপ্তি, পিন্টু, জয়িতা ও ঠাকুরপো তার পাশে থাকে। তবুও সুষমা আবেগ চেপে রাখতে পারেন না। প্রিয় মানুষগুলোর বিচ্ছিন্নতায় একপর্যায়ে সুষমা ফেটে পড়েন। একটি প্রচণ্ড পারিবারিক আবেগময়ী নাটক এভাবে দর্শক-শ্রোতার হৃদয়কে স্পর্শ করে।
চা বিরতির পরেই মঞ্চস্থ হয় মুন্নী ও সাত চৌকিদার।

স্বপ্ন ছায়া নাটকের একটি দৃশ্য
স্বপ্ন ছায়া নাটকের একটি দৃশ্য

কাহিনিতে সৌরভ ও মুন্নী সুখী দম্পতি। তাদের বস শিল্পপতি ধৃতিকান্ত। একটি ট্যুরে মুন্নীকে নেওয়ার অনুমতির আশায় তারা তাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। ধৃতিকান্ত সব সময় তার এক সহযোগী খাসনবিশকে নিয়ে চলেন।
শিল্পপতির যুবতী স্ত্রী সুনন্দা একজন রাজনৈতিক নেত্রী এবং তিনি রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ধৃতিকান্ত মুন্নীর দিকে আকৃষ্ট হন। আর যুবতীকে কাছে পাওয়ার তাড়নার মধ্য দিয়েই প্রকৃত অর্থে নাটকের প্লট তৈরি হয়ে যায়। সৌরভ উপায় খুঁজতে থাকেন কীভাবে বসকে না চটিয়ে মুন্নীকে ঘোরের বাইরে আনা যায়! বস সৌরভকে পাঠিয়ে দেন ত্রিপুরা।
সৌরভ তার কাছাকাছি সবাইকে বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। পম মামা, লতু মাসি, গোগল, হরিশ্চন্দ্র ও অন্যান্যরা যে যার জায়গা থেকে নড়েচড়ে বসেন। তারা মুন্নিকে পাহারা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দুই জায়গায়ই সমস্যা। এমন বিশৃঙ্খলা পরিবারে শান্তি আনতে পারে না। সুনন্দা পরিবারের ভালোবাসা ও বন্ধনের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় শেষতক একটি স্বচ্ছ ভালোবাসাময় জীবন শুরু করতে চান ধৃতিকান্তের সঙ্গে। এটা পুরোপুরি একটি হাসির নাটক। প্রতিটি দৃশ্য হাসি আর কৌতুকে ঠাসা।
স্বপ্ন ছায়া নাটকে অর্পিতা রাহা মনছোঁয়া অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাবার চরিত্রে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
ঘটনায় ফিল্মের আমন্ত্রণে ত্রিপর্ণা ভৌমিক চলে যান বোম্বে। এর মধ্যে তারই সহযাত্রী দুই ক্লাসমেটের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কুনাল নন্দী ও সায়ন্তিকা রাই এ সময় অভিনয়ে বড় স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন।
পাশের বাড়ির মেয়ে দীপ্তির ভূমিকায় মৌলিমা রায় অভিনয় করেননি যেন। লক্ষ্মী একটি মেয়ের মতো সুষমা মাসির খোঁজ খবর নিয়ে দারুণ এক বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেন। সম্পদ রায় ও স্তবক চক্রবর্তীও নিজ নিজ জায়গায় সোনা ফলিয়েছেন।

মা চরিত্রের সঙ্গে অন্য মায়েরা
মা চরিত্রের সঙ্গে অন্য মায়েরা

মা তন্দ্রাচ্ছন্ন হন, দেখেন মেয়ে এসেছে। তার হাতে প্রাইজ। আসলে কন্যা পাঁচ বছরেও খবর নেয়নি বাড়ির। আসে শাহজাহান নাটকের দৃশ্য। রাজু ছিলেন এ নাটকে সুজা আর সুষমা পিয়ারা। মা ভেঙে পড়েন। স্বপ্নের মতো আসছে সবাই আবার ছায়ার মতো চলে যাচ্ছে। এক করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে নাটকের সমাপ্তি টানা হয়।
কথা হয় পরিচালক জয়দীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে। গল্পটির নাট্যরূপও তিনি দিয়েছেন। বলেন, আবেগঘন এ নাটকে নাট্যকর্মীরা সফল। এটাই তার ভালো লাগা, জানান তিনি।
এবার আসি মুন্নী ও সাত চৌকিদার নাটক প্রসঙ্গে।
ধৃতিকান্ত চরিত্রের অশোক পাঞ্জাবি ঝানু অভিনেতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মুন্নী এ নাটকে কিছুটা আত্মভোলা। জৌলুশে তার আকর্ষণ। হয়তো বয়সটাই এমন, ছন্দা ভাদুড়ি সাংহাই তেমনটি ফুটিয়ে তুলেছেন।
খাসনবিশ দক্ষতারই বাস্তবায়ন। অতনু বাগ কীভাবে রপ্ত করেছেন সংলাপের এমন স্টাইল, অবাক করা কাণ্ড! স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এম আর আকতার মুকুল চরমপত্র পড়তেন। তার উচ্চারণে মুক্তিযুদ্ধের একাত্তরের কথা মনে পড়ে।
পদ্ম মামা ও লতু মাসি। দুই সহোদর। তাদের বিয়ে হয়নি। সারা জীবন আলখেল্লায় কাটে। শেষের দিকে একটু হলেও ব্যত্যয় দেখা দেয় তাদের কথায় কিংবা চলনে। সমীর বিশ্বাস ও সংঘমিত্র মিশ্র ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্ক ধরে রেখে সংলাপে পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন। হয়েছেন দর্শক নন্দিত।

চারজন নারী দর্শক
চারজন নারী দর্শক

ঝুমা বিশ্বাস আধুনিক তরুণী ও রাজনৈতিক নেত্রী। মুন্নী ও সাত চৌকিদারের চরিত্রায়ণে দারুণ ঝড় তুলেছেন। বললেন নৃত্য নয়, অভিনয়ই তাকে বেশি টানে। শুভাশীষ চট্টোপাধ্যায় গান নিয়ে ছোটেন। কী সেই দৌড়! মানস দাস খেলায় ব্যস্ত কিন্তু চৌকিদারি আছে আরও ছয়জনের সঙ্গে। কারণ মুন্নীকে তো পাহারা দিয়ে রাখতে হয়! সোহম পাঞ্জাবি ডাক্তারের ভূমিকায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রহ্লাদ রায় তার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল।
পরিচালক ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র সৌরভের ভূমিকায়। এ নাটক নিয়েও তার বিশ্বাস ও নির্ভরতা যৌথকর্মে। নেপথ্যের ভূমিকায় যারা ছিলেন তাদের নাম আনলেন শ্রদ্ধায়। মিউজিকে জয়ব্রত সেনগুপ্ত ও মঞ্জিরা এবং অরিজিৎ আলোক প্রক্ষেপণে। আর মঞ্চ নিয়ন্ত্রণে সোমদত্ত বাগ ও রিনি রয়।
নাট্যসন্ধ্যার শুরুতে মঞ্চে আসেন দুই অতিথি। আইএসসির সাধারণ সম্পাদক এম আবদুল সালাম এবং বাংলাদেশ স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। তাদের হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দেয় পাঁচ স্বর্গীয় শিশু।
আবদুল সালাম বলেন, নাটক পরিশীলিত সংস্কৃতির একটি অংশ। মীর আনিসুল হাসান বলেন এর আগেরটুকু। সংস্কৃতি কিংবা নাটকের মতো মাধ্যম ছাড়া জীবন অচল। এই মাধ্যমটি মানুষকে মানবিক করে তোলে। নাটকে বর্ণাঢ্য হয় তার জীবন।
শুরুতে সান্ধ্যকালীন শুভেচ্ছা জানানো হলো। সঞ্চালকের কণ্ঠ। তিনি সংঘমিত্র দত্ত। সবাই মনোযোগী হয়ে উঠলেন।
ছোট বিরতিতে দেখা হয় কমিউনিটির প্রিয় মুখ পৃথ্বীনাথ মুখার্জির সঙ্গে। তিনি বললেন, অনন্য পরিবেশনা! পরেরটি এমন হলে খুশির মাত্রা বাড়বে বহুগুণে। হাসতে হাসতে চললেন। শুভেচ্ছা জানাই বুদ্ধিশ্বর রায়কে। ছোট একটি পার্ট। কিন্তু দাগ কাটার মতো। পার্থ বিশ্বাস দাঁড়িয়ে। কুশল বিনিময় হয়।

মঞ্চে কলা-কুশলীরা
মঞ্চে কলা-কুশলীরা

অবন্তী সেনগুপ্ত ছবি তুললেন। বলি, আমি তুলব ফটো সাংবাদিকের ছবি। ক্যামেরায় ক্যামেরার ছবি। স্মিথ হাসি তার মুখে। আমার ক্যামেরা জ্বলে ওঠে।
ধীরা মুখার্জি আমাদের সঙ্গে। তিনি মঞ্চের শিল্পীদের ব্যাখ্যা করছেন। দেবারতি মুখার্জি সামনের কাতারের বামে শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে। তারও ছবি নিই। একই কাতারে ডান দিকে আমি দুই প্যানেল অতিথির মাঝে। চমৎকার অনুভূতি, প্রথমজন বলেন। দ্বিতীয়জনের অনুবাদ, আহা কী সুন্দর সাউন্ড সিস্টেম। আমি যোগ করি, মঞ্চকর্মীদের প্রক্ষেপণেও আছে সঠিক মাপ।
আমরা চায়ের জন্য ছুটি। সেখানেও ক্যামেরার ক্লিক। বাঃ কী মধুর এ সময়!
সপরিবার নয় শুধু, সবান্ধব ছিলাম আমরা ওদিন। আমরা নাটক উপভোগ করলাম। দেখা হলো একরাশ ভালো লাগা মানুষের সঙ্গে। এমন অনুষ্ঠানে একজনের জন্য এটাও এক অর্জন। বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানের তৃপ্তি এবং প্রিয় মুখের দর্শন--দুই মিলে সন্ধ্যাটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আহা মরি মরি!

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।