পাখিদের সঙ্গে ওড়াউড়ি

স্ট্যানওয়েল টপস থেকে দেখা প্রশান্ত মহাসাগরের প্যানারোমিক ভিউ।
স্ট্যানওয়েল টপস থেকে দেখা প্রশান্ত মহাসাগরের প্যানারোমিক ভিউ।

স্ট্যানওয়েল টপস শব্দটা শুনলেই এখন আমার চোখে ভাসে বাতাসে মানুষের ওড়াউড়ি। একেকজন মানুষ যেন একেকটা পাখি হয়ে যায় এখানে এলে। স্ট্যানওয়েল টপস অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের সিডনি ও ওলগং-এর মধ্যবর্তী তটরেখা (কোস্টলাইন) বরাবর একটি জায়গা। এই জায়গাটার সৌন্দর্যের যতই বর্ণনা দেওয়া হোক না কেন, সেটা মোটেও উপযুক্ত হবে না। পেছনে পাহাড় আর সামনে অবারিত প্রশান্ত মহাসাগর। সাগরের তীর ধরে চলে গেছে সি ক্লিফ ব্রিজ। এই সেতু আধুনিক পুরকৌশলের (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) এক অপার বিস্ময়। এটা ধরে ড্রাইভ করে আপনি পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ওলগং চলে যেতে পারেন। স্ট্যানওয়েল টপসের পাশেই রয়েছে স্ট্যানওয়েল পার্ক। সেখানে মাত্র পাঁচ শ অধিবাসীর বসবাস। পার্কের সামনেই রয়েছে স্ট্যানওয়েল সমুদ্র সৈকত।

স্ট্যানওয়েল টপসে গিয়ে আপনি যদি হ্যাং-গ্লাইডিং বা প্যারাগ্লাইডিংয়ের কোনো একটিতে অংশ না নেন তবে আপনার বেড়ানো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অ্যাডভেঞ্চারস প্লাস প্যারাগ্লাইডিং এখানে প্যারাগ্লাইডিং এবং হ্যাং-গ্লাইড অজ হ্যাং-গ্লাইড পরিচালনা করে থাকে। তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনি আপনার পছন্দের সময় অনুযায়ী বুকিং দিতে পারেন। তবে সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে দাম একটু কম সপ্তাহান্তের দিনগুলোর তুলনায়। এরপর বলড হিল লুকআউট থেকে আপনি বাতাসে ভেসে যেতে পারবেন অনায়াসে। আপনি যদি একটু ভিতু প্রকৃতির হন তাহলে তাদের অ্যাসিস্ট্যান্স নিয়েও ভেসে পড়তে পারেন। আপনি যদি আপনার ওড়াউড়ির পুরো সময়টুকু ভিডিও আকারে ধরে রাখতে চান তাহলে আপনাকে আরও কিছু বাড়তি ডলার গুনতে হবে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়াতে যেকোনো রাইডেরই আপনি যদি ছবি বা ভিডিও পেতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে বাড়তি কিছু ডলার খরচ করতে হবে।

হ্যাং গ্লাইড ভাসার মুহূর্ত
হ্যাং গ্লাইড ভাসার মুহূর্ত

বাতাসে ভেসে বেড়ানোর প্রক্রিয়াটা শুনতে যত ভীতিকর আসলে ততটা ভীতিকর নয় ব্যাপারটা। আপনি প্যারাগ্লাইডিংয়ের স্যুটের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে বলড হিলের পাড়ে গিয়ে যেই ভূমি ছেড়ে দেবেন তার আগেই আপনার প্যারাস্যুট শূন্যে ভেসে আপনাকে নিচে পড়ে যাওয়া থেকে উঠিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। একইভাবে হ্যাং-গ্লাইডয়ের সকল যন্ত্রপাতির সঙ্গে আপনি নিজেকে সংযুক্ত করে বলড হিলের পাড়ে গিয়ে যেই শূন্যে লাফ দেবেন অমনি হ্যাং-গ্লাইড আপনাকে বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এরপর সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আপনার হাতেই। এভাবে বাতাসে আধা ঘণ্টা উড়ে বেড়িয়ে আপনি পাশেই স্ট্যানওয়েল পার্কের খোলা জায়গায় ল্যান্ড করতে পারবেন সহজেই। প্যারাগ্লাইডিং আসলে প্যারাস্যুট নিয়ে ওড়াউড়ির প্রক্রিয়াটার নাম। আর হ্যাং-গ্লাইড ঘুড়ির মতো একটা কাঠামোর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ওড়াউড়ির প্রক্রিয়ার নাম। তবে হ্যাং-গ্লাইড যখন অনেক ওপরে উঠে যায় তখন একেকটা হ্যাং-গ্লাইডকে মনে হয় একেকটা মহাপতঙ্গ।
প্রায় এক সপ্তাহ প্ল্যান করে আমি আর রুপা বৌদি মিলে একটা রোববার ঠিক করলাম স্ট্যানওয়েল টপস দেখতে যাওয়ার জন্য। বরাবরের মতোই রুপা বৌদি ও বিজয় দা আমাদের রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গেলেন। তাঁদের গাড়িতে সঙ্গে তাঁদের মেয়ে এলভিরা আর ছেলে রেনো। বাড়তি হিসেবে আমাদের মেয়ে তাহিয়া ওদের সঙ্গে যোগ দিল যাতে করে যাত্রাপথে সে এলভিরার সঙ্গে গল্প করে সুন্দর সময় কাটাতে পারবে। আমাদের গাড়িতে আমরা দুজন আর সঙ্গে ছোট রায়ান তাঁদেরকে ফলো করে চললাম। আমাদের বাসা মিন্টো থেকে প্রায় এক ঘণ্টার ড্রাইভ। অবশ্য সিডনি থেকেও একই সময় লাগে। স্ট্যানওয়েল টপসে যাওয়ার রাস্তাটার একেবারে শেষের অংশ সাপের মতো আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু। জিপিএসে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা একটু আগের রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। কারণ দুই রাস্তার মধ্যে উচ্চতার অনেক ব্যবধান। এভাবে একসময় আমরা বলড হিল টপে পৌঁছে গেলাম। যেখান থেকে সবাই ওড়াউড়ি করছে। তবে এখানে পার্কিং পাওয়া একটু কঠিন, বিশেষ করে সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে।
গাড়ি পার্কিং করে দরজা খুলে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ঝোড়ো বাতাসের একটা ঝাপটা লাগল। আসলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আসা বাতাস বলেই হয়তো গতিবেগ একটু বেশি। আমরা বলড হিলে দল বেঁধে ঘাসের মধ্যে বসে পড়লাম। আর দুই চোখ ভরে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। এর মধ্যেই একে একে অনেক মানুষ প্যারাগ্লাইডিং ও হ্যাং-গ্লাইড নিয়ে বাতাসে ভেসে পড়ছিল এবং দেখতে দেখতে অনেক উঁচুতে চলে যাচ্ছিল। তখন আকাশের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল আকাশে বিভিন্ন রঙের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। আর আকাশের রংটাও একেবারে নীল। তাই আমার কাছে মনে হচ্ছিল আকাশও যেন একটা সমুদ্র আর একেকটা প্যারাগ্লাইড ও হ্যাং-গ্লাইড যেন একেকটা নৌকা। দুলে দুলে ভেসে বেড়াচ্ছে নীল আকাশের বুকে। এভাবে কতক্ষণ যে আমরা তাকিয়ে ছিলাম সেটা আর আমাদের মনে নেই। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেলাম বাচ্চাদের ডাকে। তারা বলচীল, তাদের সৈকতের কথা বলে নিয়ে আসা হয়েছে। তাই তাদেরকে সৈকতে নিয়ে যেতে হবে। বলড হিল টপস থেকেই নিচের সৈকতটা দেখা যাচ্ছিল।
আমরা আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। এরপর গাড়ি গড়িয়ে চলল স্ট্যানওয়েল পার্কের দিকে। গড়িয়ে চলল বলছি এই কারণে যে, আমরা বলড হিল টপস থেকে নামছিলাম প্রায় এক হাজার ফুট নিচে। স্ট্যানওয়েল পার্কে গাড়ি পার্ক করে বালির মধ্যে দিয়ে হেঁটে আমরা স্ট্যানওয়েল সৈকতে পৌঁছে গেলাম। পার্কের খোলা জায়গাটাতে একেকটা প্যারাগ্লাইড আর হ্যাং-গ্লাইড এসে ল্যান্ড করছিল ঠিক যেন এক একটা পাখি অনেক ওড়াউড়ির শেষে ক্লান্ত হয়ে এসে বসে পড়ছে বিশ্রামের জন্য। এরপর সৈকতের বালির মধ্যে মাদুর পেতে বাচ্চাদের সামান্য খাওয়া দাওয়া করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলে তারা সৈকতে তাদের স্যান্ড বাকেট নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল। আর আমরাও ওদের সঙ্গে নেমে পায়ের কবজি পর্যন্ত ভিজিয়ে নিলাম। একটু দূরেই সি ক্লিফ ব্রিজ দেখা যাচ্ছিল। বিজয় দা বললেন ওখানে পার্ক করে সমুদ্র দেখা যায়। কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেছে তাই আর আজ আমরা যাচ্ছি না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল তাই অবশেষে আমরা আমাদের খেলাঘর গুটিয়ে নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করলাম।

এক একটা প্যারাগ্লাইড এবং হ্যাং-গ্লাইড যেন এক একটি মহাপতঙ্গ
এক একটা প্যারাগ্লাইড এবং হ্যাং-গ্লাইড যেন এক একটি মহাপতঙ্গ

কিন্তু মনে দুটি আক্ষেপ থেকে গেল। একটা হলো প্যারাগ্লাইড বা হ্যাং-গ্লাইডে এবার চড়া হলো না। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে সি ক্লিফ ব্রিজের ওপরে যাওয়া হলো না। অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালোই হলো। অন্ততপক্ষে এই দুটো জিনিসের অছিলায় আমাদের আবার আসা হবে। কিন্তু আমরা জানি এই জায়গাটাতে আমরা আরও অনেকবার যাব শুধুমাত্র সাগরের বিশালতা দেখার জন্য হলেও। কারণ আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে যতই কষ্টে থাকেন না কেন সমুদ্রের সামনে গেলে আপনি সব ভুলে একজন শিশুর মতো আচরণ করবেন এবং সামান্য সময়ের জন্য হলেও জীবনের সকল জটিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন। তাই আমরা প্ল্যান করছি আবার কবে যাওয়া যায়। নগর জীবনের গতিময়তায় ক্লান্ত হয়ে গেলে আপনি যেতে পারেন যেকোনো দিন নিজের মনটাকে শান্ত করার জন্য।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।