পৃথিবীতে ভালোবাসার তুল্য আর কিছুই নেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আমি মায়ের বুকের ওমে বড় হয়েছি। বাবাকে খুব একটা কাছে পাইনি। শুনেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই সরকারি চাকরি ছেড়ে জীবিকার তাগিদে বাবা বিদেশে পাড়ি জমান। আমার জন্মের সময় বাবা বিদেশে থাকায় জন্মের অনেক পরে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। কেউ যখন তাঁর বাবাকে ‘আব্বা-আব্বু-পাপা-ড্যাডি ’ এসব বলে ডাকেন, তখন আমি রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাদের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। কারণ ‘আব্বা’ বলে ডাক শব্দটির সঙ্গে আমি তেমন অভ্যস্ত নই। আমি বড়ই দুর্ভাগা, আব্বা যখন চাকরি ছেড়ে বিদেশ থেকে দেশে আসেন, ঠিক তার কয়েক বছর পরেই আমি জীবনের তাগিদে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে আসি। আব্বাকে যে তিন-চার বছর দেশে পেয়েছিলাম, তখন পড়াশোনার জন্য আমি বাড়ির বাইরে হোস্টেলে ছিলাম বলে সে সময়টাতেও তাঁকে তেমন ডাকা হয়নি সামনাসামনি, যা ডেকেছি প্রাণ ভরে বাবাকে তাও টেলিফোনে।

আমার চোখে দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী দম্পতি ছিলেন আমার বাবা-মা। আম্মার কোনো অভিযোগ ছিল না আব্বার প্রতি। আব্বা-আম্মার মাঝে কখনো ঝগড়া বা মনোমালিন্য হতে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। যতটুকু যা কথা-কাটাকাটি করতে দেখেছি আব্বা-আম্মাকে, তাও শুধুই আমাদের ভাইবোনদের জন্য করতেন। মনে আছে একদিন বিকেলে আম্মা কেঁদে বলেছিলেন, তোর বাবার সঙ্গে কোনো দিন উচ্চ স্বরে কথা বলিনি, আজ শুধু তোদের অপরাধ ঢাকার জন্য মানুষটার সঙ্গে আমি উচ্চবাচ্যে কথা বলেছি।

শুনেছি একবার ঈদে আব্বার কাছে টাকা ছিল না বলে আম্মার জন্য ভালো কাপড় কিনে আনতে পারেননি। ঈদের দিন সকালে সব কাজ শেষে আম্মা গোসল করে ওনার পুরোনো একটা শাড়ি পরে আব্বার সামনে আসার পরে আব্বা আম্মাকে বলেছিলেন, ‘স্বর্ণ ছাইয়ের মধ্যে রাখলেও ঝকঝক করে।’ আম্মা নাকি উত্তরে আব্বাকে বলেছিলেন, তোমার ভালোবাসায় আমি আলোকিত, তোমার ভালোবাসার কাছে জগতের সবকিছু ম্লান, তুলনাহীন। ঘর ও গৃহস্থালির সব কাজ একা সামাল দিতে গিয়ে আম্মার বেশির ভাগ দিনেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। আব্বা কোনো দিন আম্মাকে ছেড়ে খাবার খেতেন না একা। আম্মা অনুরোধ করে আব্বাকে বলেছিলেন, তোমার মেয়েরা বড় হয়েছে। এখন ওদের সঙ্গে দুপুরের খাবারটা সময়মতো খেয়ে নিয়ো। অবাক হয়ে দেখতাম দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতো, আব্বা উপোস পেটে অপেক্ষা করতেন আম্মার সংসারের কাজ শেষ হওয়ার জন্য তবুও আম্মাকে ফেলে খাবার খেতেন না একা।

আমার আম্মারা পাঁচ বোন। আম্মা সবার বড়। বাপের বাড়ি বা বোনদের বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে একদিন বেড়াতে দেখিনি। আম্মার সর্বোচ্চ বিচরণ ক্ষেত্র ছিল বাড়ির আঙিনা আর ডাক্তারের চেম্বার। আব্বা চাইতেন না বলে আম্মা খুব জরুরি দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতেন না। আব্বা নাকি আম্মাকে বলতেন, তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করো তবুও বাড়ির বাইরে যেও না।

লেখিকা
লেখিকা

আব্বা মারা যাওয়ার পরেই আমার চিরসবুজ, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা আম্মা কেমন যেন একদিনেই বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। চোখে ভারী কাচের চশমা পরতে শুরু করেন। আম্মার শূন্য দৃষ্টির গভীরে, মুখের প্রতিটি ভাঁজ জুড়ে আমি দেখতাম আব্বার নিখাদ ভালোবাসার গল্প যা সাগরতলের মণি-মুক্তোর ছেয়েও মূল্যবান। আম্মা স্বল্পভাষী ছিলেন। আব্বা মারা যাওয়ার পরে আম্মা একেবারেই চুপচাপ নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন।
আম্মা আমাদের কাছে বিদেশে এসে থাকতে চাইতেন না বলে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, কেন বিদেশে থাকতে চান না? উত্তরে আম্মা বলেছিলেন, জীবিত থাকতে তোর আব্বা পছন্দ করতেন না বাড়ির বাইরে থাকি আমি, আমাকে ছেড়ে সে একা থাকতে চাইত না। আজ সে নেই কিন্তু তাঁর আত্মা দেখে আমাকে। কেমন করে তাঁকে কবরে একা রেখে আমি বাড়ির বাইরে বিদেশে থাকি?! উত্তর শুনে মায়ের মুখের দিকে নীরব চোখে তাকিয়ে অশ্রু স্রোতে ভেসে গিয়েছিলাম সেদিন আমি।
আজকালকার বেশির ভাগ দম্পতিদের মতো আগেকার সময়ের দম্পতিরা (আমাদের বাবা-মায়েরা) কথায় কথায়, ‘জান, বেবি, ডার্লিং, হানি, সুইটহার্ট’ এসব বস্তাপচা সস্তা কথা বলে হয়তো মুখে আজাইরা ফেনা তুলতেন না। কিন্তু তাঁদের গভীর মমতায় ভরা ভালোবাসা ছিল। তাঁরা একে অন্যের চোখের, মনের ভাষা বুঝতেন মুখ দেখেই। এ যুগের বেশির ভাগ দম্পতিদের মতো আগের সময়ের দম্পতিদের মধ্যে দামি গাড়ি, শাড়ি, গয়নার প্রতিযোগিতা ছিল না। নিয়ম বেঁধে প্রতি সপ্তাহ, মাসে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার তাড়া ছিল না বৈকি। কিন্তু তাঁদের নিষ্পাপ, নির্ভেজাল ভালোবাসার কাছে দুনিয়ার সব চাওয়া-পাওয়া, রং ফিকে হয়ে যেত। আমার আম্মাকে কখনো বিষণ্নতায় ভুগতে দেখিনি। আব্বার ভালোবাসায় আম্মা সব সময় হাসি খুশি থাকতেন। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ইহকালের মতো পরকালের জীবনেও আম্মা আব্বার পাশেই মাটির ঘরে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছেন।
ছোটবেলায় অন্ধকার ভয় পেলেও জীবনের বড়বেলায় এসে অন্ধকার আমার খুব প্রিয় জিনিস। নিয়নবাতির এই শহরে যদিও অন্ধকারের দেখা পাওয়া খুব কঠিন কাজ। রাত যত গভীর হয় অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় ডুব দিয়ে আমি হারিয়ে যাই বাবা-মায়ের বুকের স্নেহ-আদরে। অন্ধকার যত গাঢ় হয় আমার মনের দেয়ালে ঝোলানো বাবা-মায়ের মুখচ্ছবি, স্মৃতিরা ঠিক ততটাই স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে ফুটে ওঠে। রাত গভীরে আমি স্পষ্ট শুনতে পাই বাবার সাইকেলের হর্ন, মায়ের সুপারি কাটার শব্দ। প্রবল মুগ্ধতায় আমি হারিয়ে যাই বাবা-মায়ের সেই অনন্ত ভালোবাসার ঘরে। ভাবতে থাকি এই মধুর সম্পর্কের রহস্য কি? উত্তরে পাই শুধুই ভালোবাসা।
সম্পর্কগুলো হোক আকাশের মতো উদার, সাগরের মতো বিশাল। জগতের সব সম্পর্করা বেঁচে থাকুক ভালোবাসার আদরে। পৃথিবীর সব সুখ ছুঁয়ে থাকুক সম্পর্কদের ঠিক আমার বাবা-মায়ের মতন...।

পলি শাহীনা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।