প্রথম কুঁড়ি

প্রথম কুঁড়ি গ্রন্থের প্রচ্ছদ
প্রথম কুঁড়ি গ্রন্থের প্রচ্ছদ

শুরুটা প্রায় বছর পাঁচেক আগে। কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে তখনো ফেরেনি। বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন। এই জীবনের তিনটা ধাপ আছে। প্রথম ধাপ হলো ‘স্বাধীন পুরুষ’। অফিস থেকে বাসায় ফিরে শার্ট চেয়ারে, প্যান্ট সোফায় ছুড়ে ফেলি। খাবার খেয়ে প্লেট ধুই না অনেকক্ষণ। কেউ ‘জংলি’ বলে গালি দেয় না। টিভির রিমোটের ক্ষমতা শুধুই আমার হাতে। রাত জেগে হ‌ুমায়ূনের ‘দেয়াল’ ১০ পৃষ্ঠা পড়ে তিলোত্তমা মজুমদারের বসুধারা পড়ি ৩০ পাতা। ‘এইটা বাসা, হোটেল না’ হিম শীতল কণ্ঠে কেউ মনে করিয়ে দেয় না। আহ কী জীবন।

সমস্যা হলো এই ধাপ খুব স্বল্পস্থায়ী। খুব দ্রুতই ‘বিরহী পুরুষ’ ধাপে যেতে হয়। ডিপ ফ্রিজে রাখা খাবার গরম করে খেতে গিয়ে মনে হয় ঘাস চিবাচ্ছি। ভাত রান্না করি। খেতে কেমন বিচ্ছিরি লাগে। ভাবি বউ মনে হয় অন্য চাল দিয়ে রান্না করে। আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। নাহ অন্য কোনো চাল তো বাসায় নেই। মনোযোগ দিয়ে পানির পরিমাণ ঠিক করে আবার রাইস কুকারে চাল দিই। ফলাফল চাল ভাজা আর ভাতের মাঝখানের এক বস্তু। ছোট একটা শ্বাস ফেলে সেটাই খেয়ে নিই। টিভির রিমোট ছুঁয়েও দেখি না। যে জিনিস পাওয়ার জন্য কোনো যুদ্ধ নেই অবহেলা তার প্রাপ্যই। রিমোট হেলায় পড়ে থাকে। এমনকি প্রিয় বইয়ের দুই পৃষ্ঠা পড়ার পরই ভালো লাগে না। টেলিফোনটা নিয়ে ফোন করি।

—এই না দশ মিনিট আগেই ফোন করলে।
আশপাশের গাড়ির হর্ন, চিৎকার ছাপিয়ে প্রিয় কণ্ঠ ভেসে আসে।
—নাহ মানে ছেলেমেয়েকে বাইরের খাবার খাওয়াইয়ো না।
—সেটা তোমাকে বলতে হবে! আমি বুঝি না।
হায়রে ধাতানিও দেখি মধুর লাগে।
—বললাম আর কি। মিনমিন করে বলি।
—দুই সপ্তাহ পরেই তো ফিরছি। শরীরের যত্ন নিয়ো।
ইস এই সামান্য দুইটা নরম কথা না বললেই তো হতো...কোথায় কী যেন ভিজে যায়।

এর পরের ধাপ আরও ভয়াবহ। ‘এতিম পুরুষ’ ধাপ। অফিস থেকে ফিরলেই ছোট ছেলেটা গলা ধরে ঝুলে পড়ত। এর জন্য কত বকাবকি করেছি। প্রতিজ্ঞা করি এবার থেকে আর বকাবকি করব না। থাকুক গলা ধরে ঝুলে। যতক্ষণ খুশি। মেয়েটা খাবার টেবিলে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিত। আহারে কেন যে তখন থামিয়ে দিতাম।
সেবার এই অবস্থা আর সহ্য হচ্ছিল না। হঠাৎ কী মনে করে একদিন ল্যাপটপে হাবিজাবি একটা কিছু লিখলাম। ফেসবুকে পোস্টও দিলাম।
সেই শুরু হলো। বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন শেষ হলো। কিন্তু মাঝে মাঝেই হাবিজাবি লেখা চলতে থাকল। বেশির ভাগ হঠাৎ মনে হওয়া চটুল টাইপ লেখা। শ্যাম্পুর বদলে কন্ডিশনার কেনার পরে যে ধাতানি খাইলাম তার ফল দাঁড়াল নিচের এই স্ট্যাটাস—
তত্ত্বীয় জ্ঞান ও সাংসারিক প্রয়োগ।
ছাত্রাবস্থায় মনে হতো পাঠ্যপুস্তক সব অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান দিয়ে পূর্ণ। ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে’—তাতে আমার কী? আমাকে তো বনবন করে ঘুরতে হবে না। সেই মহান বিজ্ঞানীর মাথায় আপেল পড়ল। আপনার তো কপাল ভালো। মাথায় আপেল পড়েছে। খেয়ে ফেলুন। ঝামেলা শেষ। কিন্তু না। জগতের বহু লোকের যন্ত্রণার কারণ হতে হবে না? মধ্যাকর্ষণ শক্তি শিখতে হলো। এ রকম আরও কত অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান দিয়ে মগজ বোঝাই করলাম তার ইয়ত্তা নাই।
কালে কালে বয়স বাড়ল। বুড়িগঙ্গার ডিস্টিল্ড ওয়াটার মবিল ওয়াটারে রূপান্তরিত হয়ে গেল। অবশেষে আমিও বুঝলাম আসলে কোনো জ্ঞানই অপ্রয়োজনীয় না। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
তত্ত্বীয় জ্ঞান ১
সকল ক্ষারই ক্ষারক কিন্তু সকল ক্ষারকই ক্ষার না।
সাংসারিক প্রয়োগ
সকল স্বামীই গাধা কিন্তু সকল গাধাই স্বামী না।
তত্ত্বীয় জ্ঞান ২
সারা দিন বলপ্রয়োগ করলেও বস্তুর সরণ না হলে কাজ হবে না।
সাংসারিক প্রয়োগ
সারা দিন অফিস করলেও রাতের খাবারের পর থালা বাটি না ধুলে কিংবা ডিম না ভাজলে আপনি আসলে কোনো কাজ করেননি।
তত্ত্বীয় জ্ঞান ৩
শক্তির ক্ষয় নাই রূপান্তর আছে।
সাংসারিক প্রয়োগ
গাড়ি যেমন পেট্রলে চলে তেমনি সংসার চলে শব্দ শক্তিতে। উদাহরণ—‘শাফিন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।’ কথাটা আপনি আস্তে বললে শাফিন এক ঘণ্টা সময় নেবে। চিৎকারের জোর যত বাড়াবেন শাফিন তত দ্রুত খাওয়া শেষ করবে।
তত্ত্বীয় জ্ঞান ৪
পদার্থের তিন অবস্থা তরল, বায়বীয় ও কঠিন।
সাংসারিক প্রয়োগ
মানুষেরও তিন অবস্থা—বাল্য অবস্থা (তরল), বিবাহপূর্ব অবস্থা (বায়বীয়) ও বিবাহ পরবর্তী অবস্থা (কঠিন)।
তত্ত্বীয় জ্ঞান ৫
ত্রিভুজের দুই বাহুর যোগফল তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর।
সাংসারিক প্রয়োগ
সংসারের খরচ আর শখের খরচের যোগফল আয়ের চাইতে সব সময়ই বড়।
এভাবেই চলছিল। বন্ধুরা কেউ কেউ মজা পায়, বেশির ভাগই পড়ে না। এর মাঝেই একদিন এক আড্ডায় এক জ্ঞানী লোকের সঙ্গে কথা। টুকটাক আলাপের পর বললেন—আপনিও নাকি লেখেন?
—আরে নাহ। এমনিতেই একটু ফাইজলামি করি। আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
—আপনাকে তো বন্ধু হিসেবে নিতে পারব না। কারণ অনেক আগেই আমার বন্ধু পাঁচ হাজার হয়ে গেছে। আমি অবশ্য কোথাও কোনো লাইক কমেন্ট করি না। নিজেও কোনো পোস্ট দেই না। তবে ফেসবুকে থাকি অনেক।
—নিজে কিছু করেন না। তাহলে ফেসবুকে থাকেন কেন? কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করি।
—আরে আমি হলাম ফেসবুক ঈশ্বর। ঈশ্বর যেমন সবকিছু দেখেন শোনেন। কিন্তু কোথাও কোনো ছাপ রাখেন না। আমিও সেরকম সবকিছু দেখি বুঝি। কিন্তু কোথাও ছাপ রাখি না।
আমি একটু চমকে গেলাম। বাপরে একজন ঈশ্বরের সঙ্গেও দেখা হলো শেষ পর্যন্ত। মজার ব্যাপার হলো এরপরে বহু ফেসবুক ঈশ্বরের সঙ্গেই দেখা হয়েছে।
‘মনের মাঝে তুমি-তাই
তোমার টিনের চালে ঢিল মারি।’
দেখেন দেখেন এক ফেসবুক কবির কবিতা। ভদ্রলোক নিজের মোবাইল এগিয়ে দিয়ে দেখান। আমি কোনো মন্তব্য করি না।
—ভাই এই সব আজাইরা সময় নষ্ট কইরেন না। আমি বইলা দিলাম একটা ভালো মানের ছোট গল্পও আপনি ফেসবুকে কোনো দিন পাবেন না।
ভদ্রলোক বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলেন।
এরপর এই ফেসবুক ঈশ্বরের সাথে আমার আর কোনো দিন দেখা হয়নি। কিন্তু তার কথাটা মনে গেঁথে গেল। একটার পর একটা ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করে গেলাম। হয় কী হয় না, জানি না। আবার লিখি। কিছু পাঠকের ভালোও লাগে। অন্তত লাইক কমেন্ট থেকে তাই মনে হয়। প্রথম আলোর দূর পরবাসেও বেশ কিছু গল্প ছাপা হয়। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু গত বইমেলার আগেই কিছু পাঠক বইয়ের কথা বলা শুরু করল। আমি হেসে উড়িয়ে দিই। বন্ধুরা আবার বলে, কেউ কেউ বইয়ের জন্য টাকাও দিতে চায়। আমি ঠাট্টা করে বলি—এখন থেকে যেই বইয়ের কথা বলবে তার নামেই বিশ কপি অগ্রিম বুকিং দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গেই দেখি কয়েকজন রাজি হয়ে যান।
পাঠক, (আমার মতে পাঠকের কোনো লিঙ্গভেদ নাই) আপনাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। আপনাদের কারণেই শেষ পর্যন্ত একটা ছোট গল্পের বই বের করার সিদ্ধান্ত নিই। কুড়িটা গল্প বাছাই করি। বইয়ের নাম দেই ‘প্রথম কুঁড়ি’। প্রকাশক রাজিব ভাই চন্দ্রবিন্দুটা দিয়েছেন। (আমার মনে হয় পাঠককে একটু বিভ্রান্ত করার জন্য...হা–হা)।
বইটা পাওয়া যাচ্ছে চৈতন্য প্রকাশনীর স্টলে। স্টল নম্বর ৬০৪-৬০৫। রকমারিতেও পাওয়া যাচ্ছে।

মোস্তাফিজুর রহমান: ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।