ভালোবাসার গল্পে গল্পে পনেরোটি বছর

জীবনসঙ্গীর সঙ্গে লেখিকা
জীবনসঙ্গীর সঙ্গে লেখিকা

যে বয়সে প্রেম নিয়ে অন্য সবার মাতামাতি, সে বয়সে প্রেম আমার কোনো অনুভূতিতে প্রভাব ফেলেনি। ভাবতেই পারিনি সেই প্রেম আমার জীবনেও দোলা দেবে। প্রেম নিয়ে কোনো অনুভূতি না থাকলেও, মনে মনে এটা ভেবেছি, যদি কখনো কাউকে ভালো লাগে, ফিল করি, কাউকে ভালোবাসি, তবে অবশ্যই সেই ভালো লাগা বা ভালোবাসার কথা তাকে জানাব। আমার যেমন ভালোবাসার কথা জানাবার অধিকার আছে তেমনি তারও তা গ্রহণ না করার অধিকার আছে।

২০০৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ইংরেজি পরীক্ষার জন্য গ্রুপ ওয়ার্ক করতে গিয়ে সেদিন তোর আমাকে সহজ সরলভাবে বোঝানোর ক্ষমতা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম, মাত্র এক দিনের ভাবনায় পরদিন অকপটে বলেই ফেললাম তোকে ভালোবেসে ফেলেছি। সেমিনার কক্ষের পুরোটা জুড়েই ছিল আমাদের সবার প্রাণচঞ্চল আড্ডা। কিন্তু সবার মাঝে থেকেও আমি আমার নিজেকে তোর মাঝে হারিয়ে ফেলেছি হাজারবার। সেদিন বুঝলাম এটাই বোধ হয় ভালোবাসা-প্রেম। খুব সাবলীলভাবে বলার পরও বিশ্বাস করিসনি।
ভেবেছিলে এটা হয় নাকি। ক্লাসমেটের সঙ্গে প্রেম? আমিও তাই ভেবেছিলাম। এই প্রেম কখনো সফল হবে না। কিন্তু অবশেষে হার মানলাম দুজনে ভালোবাসার কাছে।
শুরু হলো আমাদের একটু একটু করে পথ চলা। মনে পড়ে কলেজের সেই উজ্জ্বল সোনালি দিনগুলো? পুরো কলেজে যেন একটাই আদর্শ জুটি। কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র—সবাই খুব পছন্দ করত আমাদের। আজও অনেকের মুখে আমাদের ভালোবাসার গল্প। এমনকি আমাদের টিচারদের সহযোগিতাও কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। অনেকটাই বাংলা সিনেমার গল্পের মতো।
আর এই গল্পটা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। একসঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া, সারা দিন একসঙ্গে ক্লাস করা, ক্লাস বিরতিতেও একসঙ্গে আড্ডা, সেমিনার ওয়ার্ক, এমনকি একইসঙ্গে কাকতালীয়ভাবে দুজনে পাশাপাশি বসে কলেজজীবনের প্রায় সবগুলো পরীক্ষা একসঙ্গে শেষ করলাম। রেজাল্টও আমাদের ডিপার্টমেন্টে আমরা সর্বোচ্চ মার্ক নিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয়। সহপাঠীরা বলত, পরীক্ষার হলে বসে প্রেম করেও তোরা এগিয়ে। বিধাতা যেন এভাবে সব সময় ফেভার করুক। সারা দিন একইসঙ্গে থাকার পরও আবেগের বহিঃপ্রকাশের যেন কমতি নেই। আর সেই না বলা অনুভূতির প্রকাশ হতো চিঠিতে। আমাদের চিঠির সংখ্যা শুনে অনেকে আঁতকে ওঠেন। দুই হাজারেরও বেশি হবে। অবাক করার মতো। তাও আবার যে সময় এসএমএস প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেছে।
তুই থেকে তুমিতে আসতে অনেক সময় লেগেছিল। কত কষ্টই না হলো। আর চিঠিই যেন সহজ করে দিল অনেকটা।
২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সম্পর্ক প্রায় তিন বছরেরও বেশি। প্রথম তোর হাত স্পর্শ করতে চেয়েছি। বলেছিলি, থাক না আমি তো তোমারই আছি। বললাম, আমি যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সেই প্রথম হাতে হাত রাখা। সেই প্রথম স্পর্শ মনে হয় চার ঘণ্টার মতো হাতে হাত ধরেছিলাম। আজও ধরে আছি একইভাবে।
ঝগড়া, মান অভিমান, কষ্ট ভালোবাসার নৌকা চড়ে আমরা পাড়ি দিয়েছি প্রায় সাড়ে ছয় বছর প্রেমের সমুদ্র। বুলটি, মুরাদ ভাই আজ আপনাদের কথা না বললেই নয়। ভালোবাসা আর অভিমানের কত সাক্ষী যে আপনারা।
প্রেমের শেষ পরিণয় মিলন। সেই মিলনের জন্য আমাদের পালিয়ে বিয়ে করতে হয়নি। দুই পরিবারের সমঝোতায় তার নেদারল্যান্ডস আসার আগে আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল! কিন্তু এই সত্যিটা অনেকে জানে না যে, আমরা এই খুশিটাকে মেনে নিতে পারিনি। কারণ আমরা কেউ ই সে সময় বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের বিয়ে নিয়ে আমাদের যত না স্বপ্ন ছিল, আমাদের ফ্যামিলি, বন্ধুবান্ধব, টিচার, কলিগদের আরও বেশি স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মানুষ সবই তার ইচ্ছা মতো পাবে, এটা কী হয়। বিশাল পরিসরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা না হলেও, আমরা সবার দোয়া নিয়ে শুরু করেছি আমাদের ভালোবাসার ঘর। আমার শ্বশুরের একটা কথা কখনো ভুলিনি—‘অন্ধকারময় মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেও না, কারণ এরপরই দেখবে রৌদ্রময় সোনালি আকাশ।’

২০০৯ অক্টোবর থেকে ২০১৮
সাংসারিক জীবনের নতুন নতুন অধ্যায়ের সূচনা পেরিয়ে আজকের এই আমরা নতুন অন্য এক অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রথম অংশে এমন রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প পড়ে স্বাভাবিকভাবে কারও মনে জানার আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে, এখন কেমন আছি আমরা? এই দুটি মানুষের ভালোবাসা আজও কি তেমন আছে? আজও কি সেই একই অনুভূতি কাজ করে?
সেই গল্পটা না হয় আমার পরের লেখনী তুলে ধরি।
শুধু এইটুকু বলি, ভালোবাসা, ভালোবাসে শুধু তাকে, ভালোবেসে ভালোবাসা বেঁধে যে রাখে।

ফারজানা পুষ্পিতা: নেদারল্যান্ডস।