ভালোবাসায় ভালোবাসা নাকি দিবসে ভালোবাসা

লেখিকা
লেখিকা

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। জেনে কিংবা না জেনে, কখনো বা হুজুগে মেতে আমরা কম বেশি ভালোবাসা দিবস পালন করি। আমার মতে ভালোবাসার জন্য কোনো একক দিবসের দরকার হয় না। ভালোবাসা ছাড়া কি কোনো দিবস-কোনো রজনী পাড়ি দেওয়া সম্ভব? মা-বাবা সন্তানকে-সন্তান মা-বাবাকে, প্রেমিক প্রেমিকাকে-প্রেমিকা প্রেমিককে, স্বামী স্ত্রীকে-স্ত্রী স্বামীকে, সহোদর সহোদরকে, বন্ধু বন্ধুকে, স্বজন স্বজনকে, প্রিয় প্রিয়কে ভালোবাসবে, ভালোবাসবে ক্ষণে ক্ষণে প্রতিক্ষণে-এটাই স্বাভাবিক। তারপরেও মানবজীবনে এই স্বাভাবিকতা স্বাভাবিক থাকে না। তাই ভালোবাসার ছন্দপতন হয়। তবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আকারে, ইঙ্গিতে, নিঃশব্দে কিংবা শব্দমালায় মানবজীবনে ভালোবাসার ছন্দমালা খুবই জরুরি। সংস্কৃতি-ভেদে ভালোবাসা প্রকাশে, ছন্দে ভিন্নতা রয়েছে-তবে ভালোবাসা শূন্য সংস্কৃতি নেই, ভালোবাসা ছাড়া কোনো দিবসও নেই, তাহলে কেন এ একক ভালোবাসা দিবস?

ভালোবাসা দিবসের যাত্রা নিয়ে অনেক তত্ত্ব রয়েছে। একটি তত্ত্ব মতে ভালোবাসা দিবসের জন্ম প্রাচীন রোমান উৎসব ‘লোপারকেলিয়া’-কে কেন্দ্র করে যা ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে উদ্‌যাপন করা হতো। রোমানরা নারী ও বিবাহের দেবতা যোনোর সম্মানে এ উৎসব পালন করত। এ দিনে অবিবাহিত নারীরা চিরকুটে ভালোবাসার নোট লিখে কলসের মতো একটা জারে রাখত যাকে বলা হতো বিলেটস। তারপর অবিবাহিত ছেলেরা সে জার থেকে চিরকুট তুলত। সে চিরকুটে যে মেয়ের নাম থাকত ছেলেটি তার সন্ধানে বের হতো। ছেলেটি ওই নাম তার শার্টে এক সপ্তাহ লিখে রাখত এবং লোকজনকে তার ভালোবাসার মানুষের নাম জানান দিত। কারণ রোমানরা মনে করত নিজের অনুভূতিকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে কোনো লজ্জা নেই।
ভালোবাসা দিবস নিয়ে আরেকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে যা রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস-দুই ও ভ্যালেন্টাইন নামক একজন পুরোহিতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস-দুই সকল বিবাহ নিষিদ্ধ করেছেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন অবিবাহিত পুরুষেরা সৈনিক হিসেবে উত্তম। তার ধারণা মতে সংসার না থাকার কারণে অবিবাহিত পুরুষেরা যুদ্ধে মনোযোগ দিতে পারবে এবং পিছুটান না থাকায় সহজে জীবন উৎসর্গ করতে পারবে। ভ্যালেন্টাইন নামক একজন পুরোহিত সে নিয়ম ভঙ্গ করে গোপনে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে এক জুটির বিবাহ সম্পন্ন করেছিলেন। আর এ কারণেই ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ভ্যালেন্টাইন দিবস নিয়ে অন্য আরেকটি ধারণা প্রচলিত আছে যা শিশুদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। খ্রিষ্টীয় প্রথম দিকে শিশুদের দেখা হতো শয়তানের প্রতিচ্ছবি হিসেবে। সে সময়ে মনে করা হতো মানুষ পাপ করে বলে শিশু হয়ে জন্ম নেয়। আর এ কারণে সে সময়ে শিশুদের সঙ্গে খুব নির্মম ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন নামক একজন পুরোহিত শিশুদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ ছিলেন আর এ কারণে রোমানরা তাকে কারাগারে অবরুদ্ধ করে। ভ্যালেন্টাইনের এক শিশু বন্ধু সে সময়ে তাকে কারাগারের জানালা দিয়ে চিঠি আর নোট প্রদান করে। ভ্যালেন্টাইন ডেতে কার্ড প্রদানের যে প্রচলিত রীতি তার কিছুটা ব্যাখ্যা এ তত্ত্ব থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ খ্রিষ্টীয় গল্প অনুযায়ী রোমানরা ভ্যালেন্টাইনকে মেরে ফেলেছিল ২৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে। আর এ কারণেই ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আঠারো শতকের আগে ভ্যালেন্টাইন ডেতে হাতে হাতে কার্ড বিনিময় করা হতো কারণ সে সময়ে চিঠি পোস্ট করা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারনে অনেক কম খরচে চিঠি পোস্ট সম্ভব হয় এবং ভ্যালেন্টাইন ডের কার্ড বিনিময়ের তখন বাণিজ্যিক প্রসারতা পায়। তবে এ সময়ে কিছু কিছু দেশ ধর্মীয় ও সামাজিক শোভনীয়তার কারণে ভ্যালেন্টাইন ডে কার্ড বিনিময় নিষিদ্ধ করে। সে সময়ে আমেরিকার শিকাগো পোস্ট অফিস ২৫ হাজারেরও বেশি কার্ড প্রত্যাখ্যান করেছিল কারণ ওই কার্ডগুলো অশোভনীয় ছিল এবং তা আমেরিকার চিঠি বহনকারী বাহনে নেবার মতো মাপসই ছিল না।
১৮৩০ সালে ম্যাসাচুসেটসের ওরচেস্টার নামক শহরে এস্টার এ হাওল্যান্ড নামক এক আমেরিকান ব্যবসায়ী প্রথম ভ্যালেন্টাইন ডেকে বাণিজ্যিকভাবে উদ্‌যাপন করেন। ভ্যালেন্টাইন ডেকে কেন্দ্র করে তার এ ব্যবসায় লাভ হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে আমেরিকায় দুই হাজারেরও বেশি প্রকাশনা থেকে ভেলেন্টাইন ডে কার্ড ছাপানো হয়। তবে অবাক হয়েছি শুধুমাত্র হলমার্কের এক হাজার ৩৩০ ধরনের ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে প্রকাশিত কার্ড আছে জেনে। প্রতিবছর গড়ে এক বিলিয়ন ভ্যালেন্টাইন ডে কার্ড বিনিময় হয় যা ভ্যালেন্টাইন ডেকে দিয়েছে বড় দিনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তর উৎসবের মর্যাদা।
২০১৭ সালে গুগল প্রদত্ত তথ্যমতে ১৫ শতাংশ আমেরিকান নারী ভ্যালেন্টাইন ডেতে নিজেরা নিজেকে ফুল পাঠায়। ভ্যালেন্টাইন ডেতে যারা ফুল কেনেন তাদের ৭৩ শতাংশ পুরুষ আর ২৭ শতাংশ নারী। যাদের পোষা প্রাণী আছে তাদের ৩ শতাংশ ভ্যালেন্টাইন ডেতে তাদের পোষা প্রাণীকে উপহার দেয়।
ভ্যালেন্টাইন ডেতে ফুল হচ্ছে খুব জনপ্রিয় উপহার। ফুলকে বিবেচনা করা হয় ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। রং ভেদে ফুলের রয়েছে ভিন্ন মানে। লাল ফুলকে দেখা হয় গভীর আবেগের প্রতীক হিসেবে আর হলুদকে দেখা হয় ঈর্ষার প্রতীক হিসেবে। আবার বিভিন্ন ফুলেরও রয়েছে বিভিন্ন মানে। যেমন—ফরগেট মি নট ফুল গভীর ভালোবাসাকে প্রতিনিধিত্ব করে, পার্ভিঙ্গল (Periwinkle) ফুল নীল হলে বন্ধুত্বের শুরু এবং সাদা হলে ভালোবাসার সুখময় স্মৃতি বহন করে।
তবে ভ্যালেন্টাইন ডের উপহার হিসেবে গোলাপের কদর অনেক বেশি। ক্যালিফোর্নিয়াতে আমেরিকার ৬০ শতাংশ গোলাপ উৎপন্ন হলেও ভ্যালেন্টাইন ডেতে যে গোলাপ বিক্রয় হয় তার অধিকাংশ আসে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। যার পরিমাণ প্রায় ১১০ মিলিয়ন। যদিও আমেরিকায় যেকোনো উৎসবের আগে উপহার সামগ্রীর দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভ্যালেন্টাইন ডেতে গোলাপের দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি করে দেওয়া হয়। আমার স্বামীকে তার এক ভারতীয় বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন ভ্যালেন্টাইন ডেতে গোলাপ না কিনে তার পরদিন গোলাপ কিনতে। কারণ সেদিন গোলাপের মূল্য আবার ৭৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই বন্ধুর মতে একদিন এদিক সেদিক-তাতে কিবা আসে যায়। তা ছাড়া ভুলে গেছি বলে স্ত্রীকেও মানিয়ে নেওয়া যায়। পকেটের পয়সাও রক্ষা পায়, সেইসঙ্গে রক্ষা পায় স্ত্রীর মন। অবশ্য আমার স্বামী ভ্যালেন্টাইন দিবসের আগে পরে কিংবা মধ্যে কখনো ফুল কেনেন না, তাই তার পকেটের পয়সা পুরোটাই রক্ষা পায়।
ভালোবাসা বাণিজ্য নয়। লোক দেখানো চাটুকারিতাও নয়। ভালোবাসার জন্ম অন্তরে। আর এর প্রকাশ মেলে প্রতিদিনের চলনে বলেনে-আচার আচরণে-আর পরশে। ভালোবাসার প্রয়োজন কোনো এক দিবসের জন্য নয়, প্রতিটি দিবস, প্রতিটি রজনী, প্রতিটি ক্ষণ ভালোবাসার দাবি রাখে। ভালোবাসায় প্রকাশ হতে পারে ভিন্ন, তবে ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তায় কোনো ভিন্নতা নেই। মানুষ মানুষকে ভালোবাসুক, ভালোবাসুক পশুপাখি, গাছ লতা, প্রকৃতি আর পৃথিবীকে। প্রতিটি দিবস হোক ভালোবাসা দিবস। ভালোবেসে ভালো রাখুক সবাইকে সবাই।

ড. নূরুন বেগম: সহযোগী অধ্যাপক, East Stroudsburg University, Pennsylvania, USA