একজন অনুপ্রেরণাদায়িনীর গল্প

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

কলেজজীবনের দুই বছর আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় ও ঘটনাবহুল সময়। স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিল দুটি বছর এবং পরবর্তী জীবনে আমার যত অর্জন সবকিছুই এই কলেজজীবনের বিদ্যা বেঁচে। স্বপ্নে যেমন অভাবিত সবকিছুই অনেক দ্রুত ঘটে যায়, কিন্তু স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেও সেই ঘটনাগুলোর রেষ রয়ে যায়, ঠিক তেমনি কলেজজীবনের ঘটনা ও অর্জনগুলোই এখনো আমার জীবনে চলার পথে সবচেয়ে বড় পাথেয়। কলেজজীবনের পড়াশোনার গল্প অন্য আরেকদিন করব। আজ শোনাই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেমের গল্প।

বাংলা ও হিন্দি সিনেমা দেখে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম সবকিছুই করতে চাইত সিনেমার স্টাইলে। আর যেহেতু সিনেমাতে দেখায় সব নায়ক-নায়িকার কলেজজীবনে প্রেম হয়, তাই আমিও পণ করেছিলাম প্রেম এবার একটা করতেই হবে। না হলে কীসের কলেজজীবন। তাই মনে মনে পাত্রী সন্ধান শুরু করে দিলাম। ভর্তির দিন প্রথমে মনে ধরল যমজ দুই বোনকে। মনে মনে ভাবলাম আরে দুইটা আছে, একটা না একটা কুপোকাত হবেই। কিন্তু তেমন মনের মতো পছন্দ হলো না। তাই মনে মনে ঠিক পছন্দের মানুষটাকে খুঁজে ফিরছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ কবে কোথায় তা আজ আর মনে পড়ছে না। তবে তাঁর হাঁটা-চলা, পোশাক-পরিচ্ছদ এখনো আমার চোখে ভাসে। এমনকি তাঁর চশমার রিমটা পর্যন্ত আমার মনে আছে।
তাঁকে দেখার পর থেকে থ্রি ইডিয়টসের র‍্যাঞ্চোর ভাষায় দুনিয়ার সবকিছুই আমার চোখের সামনে স্লোমোশনে ঘটতে থাকল। প্রথমে আসি তাঁর পোশাকের বর্ণনায়। আমার যত দুর মনে পড়ে সে গোটা কলেজজীবনে দুটি পোশাকই একটা একদিন তো অন্যটা পরদিন পরে আসত। একটা ছিল পুরো নীল আকাশের জমিনে শরতের শুভ্র মেঘের মেলা। পুরো পোশাকটাতেই এই কারুকাজ করা ছিল। ওই পোশাকে তাঁকে আমার মনে হতো সে যেন এই মর্ত্যলোকের কেউ না। এইমাত্র আকাশ থেকে টুপ করে একটা পরি খসে পড়েছে আমার চোখের সামনে। আর বাতাসে যখন তাঁর ওড়না উড়ত তখন মনে হতো যেন আমি হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছি। আমি এখনো দিব্য চোখে দেখতে পাই সে ছেলেদের কমনরুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর তাঁর ওড়না বাতাসে উড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে উড়ছি আমিও। তাঁর অন্য পোশাকটা ছিল একটু আলাদা রকমের। পুরো সাদা জমিন, এর মাঝে লাল চারকোনা আকৃতির একটা বাক্স আঁকা ছিল। আর তার দুই কোণায় ছিল দুটি সাদা ফুটকি। এই পোশাকটাতেও তাঁকেই এত মানাত আমার মনে হতো, এই পোশাকগুলো তৈরিই হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর জন্য। অন্য কেউ পরলে এই পোশাকটা তার সৌন্দর্য হারাত।
এই পোশাকগুলোর সঙ্গে সে পরে আসত সানগ্লাস। ডাক্তার আমাকে সেই অষ্টম শ্রেণিতেই বলেছিলেন, যেহেতু রোদে গেলে তোমার চোখ ব্যথা করে এবং তুমি তাকাতে পারো না, তাই তুমি ফটো সানগ্লাস ব্যবহার করো। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে আমার আর সানগ্লাস পরা হয়ে ওঠেনি। আর একটা ভয়ও ছিল, আমাকে সানগ্লাসটাতে যদি না মানায়। আমার গায়ের যে পাকা রং, সানগ্লাস আমার সৌন্দর্য বর্ধন না করে আমার নামটা ডাকাতের খাতায় তুলে দিয়েছে। কিন্তু সানগ্লাসও যে মানুষের সৌন্দর্য এতখানি বৃদ্ধি করতে পারে তাঁকে দেখার আগ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি। তাঁর শ্বেতশুভ্র মুখের উপরিভাগে সানগ্লাসটাকে আমার মনে হতো কোনো পরির মাথায় মুকুটের মতো। ফ্রেমটা ছিল সোনালি রঙের। সেটার কারণেই হয়তো আরও বেশি মানিয়ে যেত। তবে তাঁর গায়ের রঙের সঙ্গে অন্য কোনো রংই মনে হয় যেত না, তাই সোনালি রংটা যতটা না তাঁর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত তার চেয়ে বেশি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করত। সানগ্লাস পরার কারণে তাঁর চুলের দুই পাশে কানের উপরিভাগ বরাবর প্রায়ই সানগ্লাসের হাতলের দাগ বসে যেত। মনে হতো এখনই বুঝি রক্ত ফুটে বেরিয়ে পড়বে। এই দাগটা দেখে আমার খুবই মায়া লাগত। আহারে বেচারি সব সময় সানগ্লাসটা পরে থাকার কী দরকার। মাঝে মাঝে খুলে রাখলেইতো আর দাগ পড়ে না। আমার খুব ইচ্ছা করত তাঁর কাছে গিয়ে এই কথাটা বলি, কিন্তু সাহসে কুলাত না।
কলেজে ঢুকেই আমার দুই চোখ শুধুই তাঁকে খুঁজে ফিরত। তাঁকে পেয়ে গেলাম তো ব্যস, সেই দিনের কলেজ যাওয়া সার্থক হয়ে যেত। সারা কলেজ কম্পাউন্ডে আমি তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম। সে যেখানে যেখানে যেত আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু পিছু সেখানে যেতাম। শুধু একটা জায়গায় গেলে আমি আর তাঁকে অনুসরণ করতে পারতাম না। সেটা হলো মেয়েদের কমনরুম। তখন আমি কলেজের মূল ফটকের রাস্তায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করতাম—কখন সে বের হবে? আর আমি আবার তাঁর পিছু নিব। এ ছাড়া কলেজ থেকে বের হয়ে সে রিকশা নিয়ে নিলে আমি আমার হোন্ডা (আমার সাইকেলের নাম) নিয়ে তাঁর রিকশার পিছু নিতাম। যাতে তাঁর বাড়িটা চিনতে পারি। এভাবে অনেক দিন পিছু নেওয়ার পর তাঁর বাড়ির সন্ধান পেয়েছিলাম। যখন দুই সেকশন এক করে আতিয়ার স্যার ক্লাস নিতেন, আমি সব সময়ই চেষ্টা করতাম সবার আগে উত্তরটা দিতে, যাতে অন্তত তাঁর নজরে আসতে পারি। এভাবে একদিন জৈব রসায়নের একটা ক্লাসে সবার আগে উত্তরটা দিলাম। স্যার আমাকে বললেন বোর্ডে গিয়ে বিক্রিয়াটা লিখে দিতে। আমাকে আর পায় কে? আমি তখন আকাশে উড়ছি। উড়তে উড়তে গিয়ে বিক্রিয়াটা লিখে আবার উড়তে উড়তে এসে নিজের সিটে বসলাম। আর যাওয়া আসার পথে চোখের কোণা দিয়ে তাঁকে মেয়েদের বসার জায়গাগুলোতে খুঁজছিলাম।
এভাবে খুব দ্রুতই কলেজজীবনের দুই বছর শেষ হয়ে আসছিল। শেষের দিকে এসে শুরু হলো প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। তখন গ্রুপ গ্রুপ করে আমাদের ক্লাস হতে লাগল। ভাগ্যক্রমে আমার আর তাঁর গ্রুপ ছিল একই। বন্ধুরা সবাই বলছিল কি করলি ইয়াকুব, কলেজজীবন শেষ হয়ে আসল আর তুই এখনো ওকে তোর মনের কথাটা বলতে পারলি না? এইটা কিছু হইল, তুই না বললে আমরা গিয়ে ওকে বলে আসি। আমি বললাম না, যা করার আমাকেই করতে হবে। কথা বলার সুযোগ এসে গেল ফিজিকস ল্যাবে। আমি তখন পর্যন্ত ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতাম না, কারণ আমার ক্যালকুলেটর লাগত না। আর সত্যি কথা বলতে কী, ক্যালকুলেটর কেনার সামর্থ্যও আমার ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষায় অন্য একজনের ক্যালকুলেটর ধার করে নিয়ে গিয়ে কী ভোগান্তিতেই না পড়েছিলাম, সে গল্প অন্য কোনো দিন।
স্লাইড ক্যালিপার্সের প্র্যাকটিক্যালটা শেষ করে উত্তর মিলিয়ে বসে আছি। বন্ধুরা বলল, এই মোক্ষম সুযোগরে ইয়াকুব, তুইতো ক্যালকুলেটর আনিস নাই, তুই ওর কাছে গিয়ে ক্যালকুলেটর চেয়ে নিয়ে আয়। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম যাব। ওরা বলল যাবি না মানে আর কয়দিন পর কলেজজীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন হায় হায় করবি কিন্তু। আমি বললাম তাইতো, কিন্তু ও যদি না দেয়? ওরা বলল, সেটা পরের ব্যাপার। আমি বললাম ঠিক আছে। জীবনের প্রথম ও একমাত্র সাহসের কাজ করার জন্য এগিয়ে গেলাম। কথাটা ঠিক কী বলেছিলাম তা আজ আর ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার যত দুর মনে পড়ে কথাটা ছিল, আপনার ক্যালকুলেটরটা একটু দেওয়া যাবে? সে বলল, না। এরপরের কথোপকথন আর আমার মাথায় ঢুকছিল না। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। তারপরও সাহস সঞ্চয় করে বললাম, কেন? সে বোধ হয় বলেছিল আমার ক্যালকুলেশন শেষ হয় নাই। আমি বললাম এই ক্যালকুলেশন করতে ক্যালকুলেটর লাগবে? সে বলল, আমার লাগবে না, ওনার লাগবে? আমি বললাম আমার ক্যালকুলেশন শেষ, শুধু চেক করব। সে বলল, না দেওয়া যাবে না। আমার অবস্থা তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি, ভিক্ষা চাই না মা তোমার কুত্তা খেদাও। যা হোক প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসলাম। এরপর আর তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার রিস্ক নিইনি।
কিন্তু টিনএজ বয়সের ভূত এত সহজে কী মাথা থেকে নামে? পরবর্তী কিছুদিন মুষড়ে পড়লেও আমি পুনরায় আবার মানসিক শক্তি ফিরে পেলাম। বিশেষ করে টেস্ট পরীক্ষায় আমার অচিন্তনীয় সাফল্য আমাকে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি কখনই চিন্তা করিনি আমি প্লেস করতে পারি। তাই যখন নোটিশ বোর্ডে আমার নাম দেখলাম, আমি আনুকে বললাম কুষ্টিয়ার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে দিছে। তা না হলে কীভাবে আমার মতো অধমের নাম নোটিশ বোর্ডে জায়গা করে নেয়। এরপর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সবাই ঢাকা চলে গেল কোচিং করতে। কিন্তু সংগত কারণেই আমার ঢাকায় কোচিং করতে যাওয়া হলো না। বাল্যবন্ধু আনুও কোচিং করতে গেল না। তখন আমাকে আর পায় কে? আমি আর আনু সারা দিন সাইকেল নিয়ে সারা কুষ্টিয়া শহর চষে বেড়াতে লাগলাম। এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমি ওর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাইনি। আর যতবার ওর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে গেছি ততবারই উঁকিঝুঁকি দিয়ে বাড়ির ভেতরে-ছাদে ওকে খুঁজে ফিরতাম। এটা আসলে কলেজ চলার সময়েও ছিল।
যা হোক, একবার খবর পেলাম সে ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। ব্যস কাউকে না জানিয়ে প্ল্যান করে ফেললাম। আমি সাইকেল চালিয়ে ওদের বাসার সামনে গিয়ে দুরুদুরু বুকে কলিং বেলে হাত রাখলাম। ওদিকে আমার বুক কামারের হাপড়ের মতো ওঠানামা করছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। কলিং বেলে বাজা ও দরজা খোলার মধ্যের সময়টুকু যেন আর শেষ হতে চাইছিল না। কাজের মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করল কাকে চান? আমি ওর নাম বললাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন আমার সামনে। চেহারা দেখেই বুঝলাম ওর মা। তিনি বললেন ও তো বাড়িতে নেই, ওর খালার বাসায় গেছে। কেন এসেছ বল, ওকে জানিয়ে দেব? কারণতো আর বলা যায় না। তখন বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম, আমিতো কোচিং করতে যায়নি, তাই ওর কাছে এসেছিলাম নোট নেওয়ার জন্য। আমি এখনো আমার ওই মুহূর্তের বুদ্ধিটাকে আমার সেরা বুদ্ধি মনে করি। বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। দ্বিতীয়বার ক্লিন বোল্ড হলাম। এরপর আর তৃতীয়বার চেষ্টা করার সাহস ও সুযোগ কোনোটাই ছিল না। কারণ সে পড়া শুরু করল অন্য এক শহরে আর আমি ঢাকা এসে আমার বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম শুরু করলাম। বাংলা সিনেমায় একটা খুব বিখ্যাত ডায়ালগ আছে—‘অভাব যখন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে, প্রেম-ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়।’ আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। জীবন তার আপন মহিমায় ও গতিতে এগিয়ে চলেছে। আমার পড়াশোনা কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে শেষ হলো। সৎ থাকার বিলাসিতায় বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে বিসিএস না দিয়ে বেশি টাকা বেতনের এক বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি নিলাম। তারপর সেখান থেকে আরও ভালো একটা মোবাইল অপারেটর কোম্পানিতে যোগ দিলাম। দিন চলে যায় নিশ্বাস নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না। সারা সপ্তাহ, মাস জুড়ে থাকি ঢাকার বাইরে। আজ এ জেলায় তো কাল অন্য জেলায়।
এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে একদিন বন্ধু হিটু ফোন দিয়ে বলল, আজ কার সঙ্গে আলাপ হলো জানিস? আমি জিজ্ঞেস করলাম কার সঙ্গে? হিটু বলল ওই মেয়েটার সঙ্গে, যাকে তুই কলেজজীবনে পছন্দ করতি। আমি বললাম তাই? সঙ্গে সঙ্গে কত স্মৃতি মাথার মধ্যে ভিড় করছিল। আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ভালো। আমার বন্ধু যা বলল তাতে আমার মেয়েটার প্রতি যে রাগ ছিল, তা অনেকাংশে কমে গেল। কারণ হিটু আমার এমন একজন বন্ধু যার কথা আমার কাছে বেদবাক্যের মতো। হিটু বলল, মেয়েটা আসলেই অনেক ভালো আর বন্ধুবৎসল। আমি বললাম বলিস কি? হিটু বলল, হয়তো পরিস্থিতির কারণে মেয়েটার সঙ্গে তোর একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সে আসলেই ভালো মেয়ে।
অনেক ভালো লাগছিল হিটুর কথাগুলো শুনতে আর নিজের মনের ওপর থেকে অনেক বোঝা কমে যাচ্ছিল, যা এত দিন ধরে আমার অবচেতন মন বয়ে বেড়াচ্ছিল। এরপর আমার আশ্চর্য হওয়ার আরও বাকি ছিল। একদিন অফিশিয়াল ট্যুর শেষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছি, হঠাৎ অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। আমি বললাম, হ্যালো। অপর প্রান্ত থেকে জবাব এল, আমি অমুক। আমি তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে প্রথমেই তাঁকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু ভাব ধরলাম আমি তাঁকে চিনতে পারিনি। আমার মনে একটা রাগ ছিল। সে আমার ওই বন্ধুটাকে একবারে প্রথমবারে চিনতে পারেনি। সেই কারণে এই অভিনয়টুকু করলাম। সে বলল সরকারি কলেজের আমাদের ব্যাচের। আমি তখন বললাম, ও আচ্ছা। এরপর আমার জন্য আরও বেশি আশ্চর্য ঘটনা অপেক্ষা করছিল। সে কথার শুরুতেই বলল, আমি ওই দিনের জন্য সরি। আমিতো অবাক। আমি বললাম, কোন দিন, কি ব্যাপার?
যা হোক অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে আলাপ হলো এবং হিটুর মতো আমিও বলতে বাধ্য হলাম আসলেই মেয়েটা অনেক ভালো। ওর কাছ থেকে ওই দিন আমি যে শিক্ষাটা পেলাম সেটা হলো ভুল যারই হোক সেটা নিজের ঘাড়ে নেওয়া। সে সরি বলে আমাকে একেবারে পরাজিত করে ফেলল। হারা জেতা মনে হয় একেই বলে। এরপর থেকে ওর সম্বন্ধে আমার মনে সম্মানের ও শ্রদ্ধার অন্যরকম একটা জায়গা তৈরি হলো, যা এখনো আছে এবং থাকবে আমরণ। আমি এখন সব সময়ই ওর আর ওর পরিবারে মঙ্গল কামনা করি সৃষ্টিকর্তার কাছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ও থাকুক, পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকুক।
সে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার নাম। সবচেয়ে বড় উৎসাহের নাম। সবচেয়ে বড় অধ্যবসায়ের নাম। সবচেয়ে বড় আগ্রহের নাম। তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো আমি কখনই এত দুর আসতে পারতাম না। আর সে না থাকলে আমি কখনই লেখালেখি করতে পারতাম না। লেখালেখির আইডিয়াটা আমার মাথায় সর্বপ্রথম আসে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করার পর। কত দিন ভেবেছি আমাদের ঝগড়ার কাহিনিটা প্রথম আলোর ছুটিন দিনের ‘ঘর মন জানালা’ বিভাগে লিখে পাঠাই, কিন্তু শেষপর্যন্ত আর সময় করে উঠতে পারি নাই। এই লেখাটাই ছিল আমার জীবনের সর্বপ্রথম লেখা। তাই আমার লেখালেখিরও অনুপ্রেরণা সে।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>