একুইটাস

প্রশিক্ষণার্থীদের দলগত ছবি
প্রশিক্ষণার্থীদের দলগত ছবি

‘হাই, বোঁজোঁ।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
নাক বোঁচা মেয়েটি আবার বলে, হ্যালো।
এবার কিছুটা বুঝতে পারি। সাহস করে বলি, ইয়েস।
এরপরই মেয়েটি গড়গড় করে কয়েকটি দীর্ঘ বাক্য বলে যায়। যা বোঝার মতো অনুভূতি আমার শ্রবণেন্দ্রিয় তৈরি করতে পারেনি। আমি অনেক কষ্টে একটা পুরো বাক্য মনে মনে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ শেষ করেছি। বলব বলব, এর জন্য যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করছি। মেয়েটি তখন দ্বিতীয়বার পূর্বের কথার পুনরাবৃত্তি করে। আমি নার্ভাস স্বরে বলেই ফেলি—মিস, তুমি কি দয়া করে কথাগুলো একটু ধীরে ধীরে বলবে?
মেয়েটির চোখে চট করে তাচ্ছিল্য-দৃষ্টি খেলে। ইংরেজি না বুঝি, চোখের দৃষ্টিতো বুঝি। ওর ভাব দেখে মনে হয়, আমি দক্ষিণ আমেরিকার গহিন আমাজন থেকে উড়ে এসেছি। আদতে আমার ইংরেজির দৌড় মিয়ার ব্যাটার চেয়ে খারাপ না। আইইএলটিএস দিয়ে নয়ের মধ্যে পেয়েছি সাড়ে সাত। লিসেনিংয়ে আবার একটু বেশিও, মানে আট। তাই আমাকে ওরাংওটাং ভাবাটা কী ঠিক হচ্ছে? আসলে চাইনিজ মেয়েটির ক্যান্টোনিজ উচ্চারণে ইংরেজি এই বেকায়দার জন্য দায়ী।
এবার মেয়েটি আস্তে আস্তে বলে—তুমি এখানে কেন এসেছ?
দীর্ঘ বাক্য বলার কষ্টকর চেষ্টা বাদ দিয়ে বলি, ট্রেনিং।
—কীসের ট্রেনিং?
—একুইটাস।

এডার সঙ্গে লেখক
এডার সঙ্গে লেখক

মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে আমন্ত্রণপত্র দেখে। পাসপোর্ট উল্টে পাল্টে ভিসার পৃষ্ঠা ঘষেমেজে টেবিলের ওপর রাখে। আমার তৎক্ষণাৎ মনে হয় এই বুঝি বলবে, তোমার কাগজপত্রে গন্ডগোল আছে। তুমি ফিরতি প্লেনে দেশে ফেরত যাও। সঙ্গে সঙ্গেই পা অসাড় হয়ে যায়। আবার এতক্ষণ প্লেনে বসে থাকতে হবে! অবশ্য মেয়েটি আবার তার মাতৃভাষার টানে বলে, তোমার কাছে দশ হাজার ডলারের বেশি আছে?
এই পোড়ামুখী বলে কী? দশ হাজার ডলার থাকলে এই মরার দেশে কেউ আসে। মাথা নেড়ে বলি, না।
স্ট্যাম্প দিয়ে ঠাস করে সিল মেরে বলে, ওয়েলকাম টু মন্ট্রিয়েল।
আমি লাগেজের ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যারাইভালের দিকে এগোই। একটা খচখচ অনুভূতি থেকেই যায়। মেয়েটিকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। আমার কী দোষ। দেশে থ্যাংক ইউ, ধন্যবাদ—এসব কী চালু আছে। মনে হচ্ছে ফিরে গিয়ে ধন্যবাদটা বলে আসি। তবে পেছনে তাকিয়ে সে সম্ভাবনার আগুনে পানি ঢেলে দিই। বিশাল বিমানবন্দরের যে জায়গা ছেড়ে এসেছি সে জায়গায় খুঁজে পৌঁছানো আমার পক্ষে সম্ভব না।
মন্ট্রিয়েল নেমেছি বিকেলের দিকে। পিয়েরে এলিওট ট্রুডো এয়ারপোর্টটা বেশ বড়। নেমেই কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম। ইংরেজি লেখা কিছু বোঝা গেলেও ফ্রেঞ্চ বিন্দু-বিসর্গও জানি না। দুই-একটা ফ্রেঞ্চ শব্দ যে শিখে আসব তারও সময় ছিল না। হঠাৎ করেই সব হয়ে গেল। দুপুরে ঢাকার বাসায় বসে আছি একদিন। সুদূর কানাডা থেকে ফোন, তোমার দরখাস্ত আমরা পেয়েছি। তোমাকে একটা আমন্ত্রণপত্র পাঠাব। তুমি এত অল্প সময়ে ভিসা করতে পারবে?
আমি বহু কষ্টে ইংরেজিতে বলি, আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।
—ওকে, ডু ইওর বেস্ট।

এডার সঙ্গে লেখক
এডার সঙ্গে লেখক

সরকারি চাকরি করি, মহাঝক্কি। দেশের বাইরে যাব, কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। ডিজি মহোদয় দরখাস্ত দেখে বলেন, তুমি কানাডা গেলেতো ফিরে আসবে না। কয়েক দিন আগেই সহকর্মী আকরাম একই কাজ করেছে। ডিজির পিএস ছিল সে। কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে কানাডা ছুট।
—স্যার, আমি চলে আসব। কথা দিচ্ছি।
মন্ত্রণালয়ের রেজাউল ভাই কী এক অজানা কারণে দারুণ পছন্দ করেন আমাকে। চা-নাশতা খাওয়ান। এরপর নিজে ফাইল বগলদাবা করে সচিবের সই নিয়ে আসেন। আর ট্রাভেল এজেন্ট রাজা ভাই চটজলদি গালফ এয়ারের একখান টিকিট কেটে দেন। বাহ! সব রেডি। ঢাকা এয়ারপোর্টে গিয়ে পুরাই বিষম, আপনি বিজনেস ক্লাসে চেক-ইন করেন। আহারে! স্যুট-টাই পড়া সেই লোকটাকেও ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। ওই যে, কালচারে নেই। অবশ্য লোকটার ধন্যবাদ না, তার চেয়ে বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল। প্লেনের মধ্যে সোফা-জাতীয় সিটে বসেছি এই প্রথম। মেনুর দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকি, কী অর্ডার করব?
মোনালিসার হাসি দিয়ে এয়ার হোস্টেস বলে, ড্রিংকস লাগবে?
—পানি। কোনোমতে ঢোক গিলে বলি।
মানামা সিটিতে ১২ ঘণ্টার স্টপ ওভার। একটু ঘুরে ফিরে দেখব। হোটেলের অটোমেটিক গ্লাসডোর থেকে বের হয়েছি। উনপঞ্চাশ ডিগ্রির গরম তাওয়া ছ্যাঁৎ করে গায়ে লাগল। দৌড় দিয়ে সেই যে রুমে ঢুকেছি, এয়ারপোর্ট শাটলের আগে দরজাই খুলিনি। অত্যধিক গরমের কারণে হতে পারে। আমার বিখ্যাত ভুলো মনের কারণেও হতে পারে। সমস্যা একটা করে ফেলেছি। হোটেলের ক্লোজেটে বন্ধু সাব্বিরের দেওয়া চমৎকার জ্যাকেটটা রেখেই এয়ারপোর্টে চলে এসেছি। এয়ারপোর্টের ইনফরমেশন ডেস্কে গিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, ভেজাল হয়ে গেছে একটা।
ওরা ফোনটা হাতে দিয়ে বলে, এখন তো নিয়ে আসার সময় নেই। তুমি ফোন করে দাও। হোটেল যত্ন করে রেখে দেবে।
আমি টেলিফোন হাতে নিয়ে কাঁপি। ওপাশ থেকে বলেই চলেছে, হ্যালো, হ্যালো।
জগাখিচুড়ি করে কী বলেছিলাম আল্লাহপাকই জানেন। তবে মাসখানিক পরে দেশে ফেরত আসার পথে জ্যাকেটটা ঠিকই ফেরত পেয়েছিলাম।
বাহরাইন থেকে লন্ডন হয়ে মন্ট্রিয়েল নেমেছি কিছুক্ষণ আগে। ইমিগ্রেশন-কাস্টমস পার হয়ে এগোতে থাকি। অ্যারাভাইলের কাচের দরজা খুলে যায় আপনাআপনি। কত লোক দাঁড়িয়ে আছে স্বজনের জন্য। আমি চোখ বুলিয়ে আবার ট্রলি ঠেলে এগোতে থাকি। হঠাৎ করেই মনে হয়, আরে! নিজের নাম লেখা দেখলাম কোথাও। এয়ারপোর্টে কেউ আমার নাম বোর্ডে লিখে দাঁড়িয়ে থাকবে? এটা কী আমি স্বপ্নেও ভেবেছি? আবার চোখ বুলাই দর্শনার্থী সারিতে। তাইতো, একটা বোর্ডে লেখা আছে ‘মি. আবু সাইদ’। এয়ার কানাডার লন্ডন-মন্ট্রিয়েল ফ্লাইটে আমার গতরের অনেকেই আছে। সুতরাং যে প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে বেশ পাজেলড মনে হলো। এর মধ্যে কেউ কেউ নিজের নাম দেখে হাত তুলে মিলে যাচ্ছে ওদের সঙ্গে। আমার কেন যেন সন্দেহ হয়, এটা আবু সাইদ নামের অন্য কেউ। তাই হাত তুলে হাই বলার সাহস হয় না আর।

ইরাকের ফিরাজ লাইকের সঙ্গে লেখক
ইরাকের ফিরাজ লাইকের সঙ্গে লেখক

দর্শনার্থী সারি পার হয়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এক কোনায় গিয়ে বসি। কী করব বুঝতে পারছি না। যাও বা সাহস করে হাত তুলে হাই বলতাম। কিন্তু প্লাকার্ড ধরা মেয়েটির ঝলসানো রূপ দেখে পয়লাতেই চুপসে গেছি। সব যাত্রীরা হাসিমুখে যে যার মতো চলে যাচ্ছে। আমি কেবলার মতো বসে বসে ভাবছি, কী করব। প্লাকার্ড ধরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। আমি পুরো বাক্যটা কয়েকবার আওড়ে মুখস্থ-মতন করে ফেললাম। এরপর সাহস করে মেয়েটির কাছে গিয়ে গড়গড় করে বলে ফেলি, তুমি কি আবু সাইদ নামের কাউকে খুঁজছ?
মেয়েটি কী বুঝল কে জানে। মিষ্টি হাসি দিয়ে যা বলল তার তরজমা, আমিতো ধরেই নিয়েছিলাম তুমিই সে। নাম দেখে হাত তোলোনি কেন? শুধু শুধু কতগুলো সময় নষ্ট হলো।
—দুঃখিত মিস। এরপর বলতে ইচ্ছে করছিল, আমার সাহস হয়নি তাই হাত তুলিনি। কিন্তু ইংরেজিতে এটা বলার ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নাই।
হালকা সোনালি রঙের ফোর্ড টেরিটরিতে উঠতে উঠতে মেয়েটি বলে, মি. সাইদ তুমি কি ফ্রাঙ্কোফোন না অ্যাংলোফোন?
আমার আবার সেই বিখ্যাত ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি।
মানে তুমি ইংরেজি না ফ্রেঞ্চ স্পিকিং?
—বাংলা।
মেয়েটি হাসে। আহারে! কী সুন্দর হাসি। মনে মনে একটা বাক্য তৈরি করছি। মেয়েটিকে বলব, তোমার হাসি জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের চেয়েও সুন্দর। তখনই সে বলে উঠে, মন্ট্রিয়েল আগে এসেছ?
—নো।
—তাহলে তো তোমার জন্য ভালোই। নতুন একটা শহর দেখবে।
—ইয়েস মিস।
এক শব্দের ঘেরাটোপে পড়ে কথা আর এগোয় না। আধা ঘণ্টা মতন গাড়ি চালিয়ে আমাকে হোস্টেল টাইপের দালানের সামনে নিয়ে আসে। মি. সাইদ, তুমি লাগেজ নিয়ে ভেতরে যাও। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে।
মেয়েটি ভুস করে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। বোধ হয় পরবর্তী যাত্রী আসছে। আর আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখি। বিদেশ দেখে নাক সিটকানো মানুষ আমি না। সুন্দরকে সুন্দর বলতে বাধা নেই আমার। ঢাকা শহরের কংক্রিট-জঙ্গল ছেড়ে এ কোথায় এসে পড়লাম। চারদিকে ঘন সবুজ, সারি সারি গাছ। কার্পেটের মতো ঘাসের মাঠ। কাছেই সেন্ট লরেন্স নদী বইছে কুল কুল করে। মন্ট্রিয়েল মূল শহর থেকে অনেকখানি দূরে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির জন অ্যাবোট কলেজ ক্যাম্পাস এটা। এত সুন্দর সব! বছরের ছয় মাস বরফে ঢাকা থাকে এদের। তারপরও এত সবুজ কোথায় পায়?
আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতর থেকে একজন বেড়িয়ে আসে, কাম ইন ম্যান।
আশ্চর্য! এটাও মেয়ে। কামরূপ কামাখ্যায় এসে পড়লাম নাকি।
মেয়েটি লাগেজ ঠেলে একটা রুমে ঢুকিয়ে দিল, কাল থেকে প্রশিক্ষণ শুরু। সকাল আটটায় রেজিস্ট্রেশন। ক্যাম্পাসের একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিয়ে বলে, সকালে এখানে চলে আসবে। তোমাদের খাবার এই ডরমিটরিতে আছে। সময়মতো ডাইনিংয়ে গেলেই পাবে।

বাংলাদেশি রাকিবের সঙ্গে লেখক
বাংলাদেশি রাকিবের সঙ্গে লেখক

আমি রুমের সৌন্দর্যেও মুগ্ধ। আমার আসলে মুগ্ধ হওয়ার বাতিক আছে। যা দেখি তাতেই বিস্মিত হই। এই যে মেয়েটি আমাকে রুমে রেখে গেল ওকে দেখেও মুগ্ধ। ওর সারা মুখে সাদা চামড়ার ওপর বাদামি ফোটা ফোটা, বিশাল শরীর-অথচ আমি তাতেও মুগ্ধ। রুমে মাঝারি সাইজের একটা খাট, টেবিল চেয়ার, এটাচড বাথরুম। আমার একার জন্য আর কী লাগে? আহ!
কাপড় ছেড়ে ডাইনিংয়ে খেতে গেছি। ওয়াক থু করতে করতে গলা ব্যথা হয়ে গেল। ঝাল-মরিচ-লবণবিহীন কী সব খাবার। বউয়ের কথা মনে হলো, বউ তুমি কই? পরানটা হু হু করে ওঠে। মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে বউয়ের রান্না করা পাতলা ডালে হাত চুবিয়ে ভাত খাব।
প্রচণ্ড খিদে পেটে। আসার সময় বউ বুদ্ধি করে চাল-ডাল দিয়ে দিয়েছে। আরও অনেক কিছু আছে, চানাচুর মুড়িও আছে। লক্ষ্মী বউ জানে, এই লোকটার খাওয়া নিয়ে মহা ঝামেলা। ডরমেটরির ছয়টি রুমের জন্য একটা করে কমন কিচেন আছে। আমি ডাইনিং থেকে ধার করা পেঁয়াজ দিয়ে চাল-ডাল-মসলাপাতি মিশিয়ে চুলায় সাজিয়ে দিয়েছি। হাঁড়িও ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছি। কাঁচা মরিচের অভাবে জিহ্বা আড়ষ্ট। আহারে! এই জিনিস তল্লাটের আশপাশেও নেই। মোজাম্বিক থেকে আসা জর্জ ওর কালো মুখের লাল চোখে অবাক হয়ে দেখে।
আমি গলে যাওয়া খিচুড়ি গলায় দিই আর বউয়ের জন্য কাঁদি। ছেলেমেয়ে দুটো কী করছে কে জানে? ঘুমাতে গিয়ে আরেক সমস্যা। রাত ভোর হয় প্রায়, ঘুমের দেখা নেই। ভোরের দিকে হালকা চোখ লাগলেও অ্যালার্মের সঙ্গে ধড়ফড় করে উঠি। একুশ দিনের প্রশিক্ষণে এসেছি। মানবাধিকারের ওপর বিরাট প্রশিক্ষণ। মন্ট্রিয়েলের একুইটাস নামের প্রতিষ্ঠান এর আয়োজক। সারা পৃথিবী থেকে এক শ বিশ জনের একটা দল আনে এরা প্রতি বছর। ধুন্ধুমার কাণ্ড! ষাটটির মতো দেশ থেকে প্রশিক্ষণার্থী আসে, বাংলাদেশ থেকেও দুজন। কেমনে কেমনে যেন আমি এর একজন। বাকি জন রাকিব, এশিয়া ফাউন্ডেশনে চাকরি করে। প্রচণ্ড ক্যারিয়ারিস্ট ছেলে—উঠতে উঠতে পারলে আকাশে উঠে যাবে। আর আমি হচ্ছি তার উল্টো-পাতালে আছি? ঠিক আছে, ভালোই তো আছি।
প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে যথারীতি সকাল আটটায়। দশটা নাগাদ আমার ঘুমের সময় হয়ে গেছে। সারাহ নামের বুড়িটি কী বলছে না বলছে, তা কে শোনে। একেতো ভাষার সমস্যা, তার ওপর ঘুম। এই রসকষহীন বক্তৃতা পাঁচ মিলিগ্রামের জলপিডেমের কাজ করে। এত মহা ঝামেলা দেখছি। আল্লারে ডাকি, বউরে ডাকি। কোনো কাজ হয় না। সবার ওপরে ঘুম সত্য, তার ওপরে নাই। অথচ রাত হলে চোখে ঘুম নেই এক বিন্দু। বিরক্তির চোটে মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে ঢাকা চলে যাই।
কে যেন চোখে সুপার গ্লু লাগিয়ে দিয়েছে। দিনের বেলা দুই চোখের পাতা খোলা রাখতে পারি না কোনোভাবেই। ঘুম ঘুম চোখেই মেয়েটিকে লক্ষ্য করেছি প্রথম দিনই। আমাদের সেকশনে সে। মোট আটটি সেকশনে ভাগ করা হয়েছে এক শ বিশ জনকে। ছটি ইংরেজি ভাষাভাষীর আর দুটি ফ্রেঞ্চ। এডলিরা জনি, এডা বলেই ডাকে সবাই মেয়েটিকে। আমি কিছু বলি না, তাকিয়ে থাকি শুধু। পরি দেখি। এত সুন্দর মেয়েও হয়! গ্রিক দেবীরাও যে লজ্জা পাবে। আবার ঘুমে ঢলে পরি। আলবেনিয়া থেকে এসেছে সে। ছয় ছয়টি ভাষায় অনর্গল কথা বলে।
মেয়েটির দয়া হয় কিনা কে জানে। পরের দিন আমার পাশে এসে বসে। টুকটাক কথা বলে, মানবাধিকার-প্রশিক্ষণ-দেশ-পরিবার। এরপর পাশেই বসে প্রতিদিন, কথা বলে আর বলে। আমার ঘুমের আর দেখা নেই। প্রশিক্ষণকে মনে হয় ফুলের বাগান। সারাহ যা বলে তাই করি, প্রচণ্ড উৎসাহে করি। এডাকে দেখাতে হবে না? একটা নাটক করতে হয় প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে। মেয়ে শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এ রকম বিষয় নিয়ে। নাটকে এডা আমার স্ত্রী। সন্তান জন্ম দেয় সে, মেয়ে শিশু। সেই শিশুর নানা সমস্যা নিয়ে নাটক। সকলে অভিভূত অভিনয়ে। নাটক শেষে এডাকে বলি, আমরা এখানে এসেছি পনেরো দিন হলো, রাইট? খুবই সিরিয়াস আমার বলার ভঙ্গি।
এডা হরিণি চোখ তুলে বলে, তো কী?
এত তাড়াতাড়ি তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে?
হাতের ফোল্ডারটা সজোরে পিঠে মেরে বলে, ইউ নটি বয়।
বাদবাকি দিনগুলো উড়তে উড়তে চলে যায়। প্রশিক্ষণ কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়ায়, ডাইনিং হলে কত কথা। প্রশিক্ষণ শেষে নদীর পারে বসে বসে ঘাস ছেঁড়া আর কথা বলা। দুই ভিন্ন সংস্কৃতির ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। সুখের কথা বলে সে। বলে দুঃখের কথাও। আলবেনিয়ার কথা, তার শহর তিরানার কথা। রেখে আসা বয়ফ্রেন্ডের কথা। গালা নাইটে মিউজিকের তালে তালে দুজনের নাচ। নাচতে জানি না তাই বসে পরি মাঝে মধ্যেই। সে কি উৎসাহ মেয়েটির, এখান থেকে নড়বে না। আমার হাতটা ধরো। এখানে, হ্যাঁ, কোমরের কাছটা ধরো। আহ! লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমরা বন্ধু না। আমি বাঙাল, কী বলব?
পরের দিন একে একে সব বিদায় নিতে থাকে। প্রথম দিনের রূপে ঝলসানো সেই সুন্দরী বিকেলে আসবে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে। সকাল থেকেই ডরমিটরিতে মনমরা হয়ে বসে আছি। ইরাকের ফিরাজ লাইক ভবনটির নাম দিয়েছে আবু গারাইব কারাগার। শেষ দিনটা সত্যিই বন্দী কারাগারের মতো লাগছে।
এডাকে বলেছিলাম দুপুরে বাংলাদেশি খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াব। কিন্তু সে আসেনি। বিদায়ের সময় মেইন গেটের কাছে তাঁর সঙ্গে দেখা। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখ ছলছল, কেঁদে ফেলবে নাকি। ইউরোপের মেয়েরা কাঁদতেও জানে?
সাইদ, আমি ইচ্ছে করেই তোমার খাবার খেতে যাইনি। একটু পরেই তুমি চলে যাবে তা সহ্য করতে পারছিলাম না। তুমি ভালো থেকো। তোমার স্ত্রীকে আমার শুভেচ্ছা দিয়ো। সে ভাগ্যবান, তোমার মতো একটা স্বামী পেয়েছে।
জগতের সব কষ্ট সঙ্গে নিয়ে প্লেনে উঠি আবার। দুনিয়াটা বড় রহস্যময়। কোথায় কখন কতটুকু কষ্ট লুকিয়ে আছে তা শুধু বিধাতাই জানেন।
বুক ভরা কষ্ট নিয়ে মানামার সেই হোটেলে রেখে যাওয়া জ্যাকেটখানা নিয়ে ঢাকায় ফিরি।

আবু সাইদ লিপু: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।