প্রসঙ্গ: রুপা হত্যা মামলার রায়

রূপা খাতুন। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
রূপা খাতুন। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রুপা খাতুনকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে আদালত গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ চার আসামির মৃত্যুদণ্ড ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। নানা কারণে এই রায় একটি যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক রায় হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি অপরাধ সম্পাদনের পর উপলব্ধি করতে পারে অপরাধের গভীরতা ও আর পরিণতি। আর তখনই সে ভিকটিম নারীকে হত্যা করতে উদ্যত হয় নিজের অপরাধকে ঢাকার জন্য। সংগত কারণেই দুটি জঘন্য অপরাধের বিচার হয়েছে একসঙ্গে। আর তা হলো ধর্ষণ ও খুন।

এই বর্বরোচিত পাষণ্ডকর্মের পরিণতি ভয়াবহ তা অপরাধীরা জানে এবং জানে বলেই অপরাধ ঢেকে ফেলার পাঁয়তারা চালিয়েছিল। এই যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ জগতের গুরুদের কঠিনভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো যে সমাজ তথা রাষ্ট্র এ বর্বরোচিত পাষণ্ড কর্মকাণ্ড কোনোক্রমেই সহ্য করবে না। আমাদের দেশের নারীরা যদিও প্রতিনিয়ত ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ মুখ বুজে সহ্য করে আসছেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে। স্বামীদের কাছ থেকে স্ত্রীরা কীভাবে ধর্ষিত হচ্ছেন তা হয়তো অনেকের অজানা। এ প্রসঙ্গে আজ যাচ্ছি না।

আমাদের দেশে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। এই নারী জাতি যদি পিছিয়ে থাকে পুরুষ নামক পাষণ্ডদের ভয়ে তবে এ জাতির উন্নতি কল্পনাই করা যায় না। একজন নারী যদি বাসে চড়ে রাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে না পারেন তাহলে কীভাবে একজন নারী নির্ভয়ে কলেজ, ইউনিভার্সিটি কিংবা কাজে যাবেন। যদি আমাদের দেশের নারীরা বাস চড়তে ভয় পান তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা ঘরের বাইরে তথা কাজে যেতে ভয় পাবেন। আর সব সময় তো তারা তাদের পরিবারের লোকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে পারবেন না।

একবিংশ শতাব্দীতে কি তাহলে নারীরা ঘরে বসে থাকবেন! যে সমাজের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী, সে সমাজের উন্নতিতে শুধু পুরুষের পরিশ্রম কী যথেষ্ট হবে! আমাদের এই সমাজের উন্নতির জন্য নারী-পুরুষ সবাই মিলে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে হবে একমাত্র কঠিনভাবে আইন প্রয়োগ করে এবং আইনের প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে।

একজন নারী যে বাসে করে বাড়ি ফিরবেন স্বাভাবিকভাবেই সেই নির্দিষ্ট বাসের চালকসহ সকল কর্মচারীদের দায়িত্ব হবে তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। এই দায়িত্ববোধ আইন থেকে আসে না। মানবতাবোধ সেই দায়িত্ববোধ একজন মানুষের ওপর আরোপ করে। যেদিন রুপা বাড়ি ফিরছিল সেদিন সেই বাসের একজন মানুষেরও কি সে মানবতাবোধ জাগ্রত হলো না? বাসের মতো গণপরিবহন যদি একজন নারীর নিরাপত্তা না দিতে পারে তবে কোনো বিবেকবান লোকই সন্ধ্যার পর তাদের মা-বোনদেরকে ঘরের বাইরে যেতে দেবেন না।

অনেক সময় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যায় কিংবা কর্মক্ষেত্রে দেরি হয়ে গেলে কোনো নারী কী আর ঘরে ফিরে আসতে পারবেন না নিরাপদে? এটা কি জীবনের হারানো সুযোগ? আর এ নিরাপত্তা ভবিষ্যতে নিশ্চিত করতে এই রায়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি। আজ যদি আমরা আমাদের মেয়ে ও বোনদের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসতে না পারি তাহলে এই সমাজ তিলে তিলে ক্ষয়ে যাবে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। নারীরা তাদের মূল্যায়ন কোনো সময়ও আর পাবেন না। আমাদের সমাজের নারীরা স্বনির্ভর হতে পারবেন না। তারা নিচমনা স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির লোকদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে থাকবেন। একজন নিজেকে তখনই নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারবেন যখন তিনি নিজে শিক্ষাদীক্ষায় স্বনির্ভর হবেন। তিনি অন্যের ওপর নির্ভর না হয়েই চলতে পারবেন এবং তার সন্তানদের লালন পালন করতে পারবেন। আমাদের দেশে যদিও নারী নেতৃত্ব কিন্তু নারী অধিকার এখানে অনেকাংশেই সীমিত।

লেখক
লেখক

নারী অধিকার মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। যা জাতিসংঘ কর্তৃক প্রায় ৭০ বছর আগে নিশ্চিত হয়েছিল। এই অধিকার নারীদের সহিংসতা, দাসত্ব ও বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকার অধিকার। এই অধিকার নারীদের শিক্ষিত হওয়া, সম্পত্তির মালিক হওয়া; ভোট দেওয়ার অধিকার এবং ন্যায্য ও সমান মজুরি উপার্জন করার অধিকার নিশ্চিত করে। এই অধিকার তাদের রাতে কিংবা দিনে নিরাপদে চলাফেরা করার নিশ্চয়তা দেয়।

আমাদের দেশে নারীরা যেমন চলাফেরায় নিরাপদ নন তেমনই কর্মক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পুরুষ আর নারীদের বেতন বৈষম্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে নিশ্চিত করতে হবে যেন নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন। বিশেষ করে আমাদের মননশীলতা পরিবর্তন করতে হবে যে, নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন।

এখন সময়ের দাবি যে, তারা যেন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারেন তাদের শরীরের নিরাপত্তা বজায় রেখে। বিশ্বজুড়ে বিশেষভাবে তৃতীয় বিশ্বে প্রায় সর্বত্রই নারী ও মেয়ে শিশুদের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করা হয়। প্রায়ই তাদের যৌন নির্যাতনের স্বীকার হতে লক্ষ্য করা যায়। এমনই একটি ভাব যে, তাদের শরীর যেন পণ্য সামগ্রীর মতো। তাই আইন ও নীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের মননশীলতাও পরিবর্তন করতে হবে। আইনের প্রয়োগ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আমি প্রায়ই শুনি শিক্ষিত মেয়েদের পর্যন্ত তাদের স্বামীরা ঘরে রাখতে পছন্দ করেন। এ ধরনের মনমানসিকতা অত্যন্ত দুঃখজনক। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একটি শক্তিশালী নারী সমাজ গড়ে না তুলতে পারলে এ সমাজের উন্নতি হবে সুদূর পরাহত।

সর্বোপরি পাপীদের প্রতি আমার উপদেশ থাকবে, তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে। বিধাতার কাছে তারা যদি মাফ চায়, তাহলে এই দুনিয়ার বিচারের কারণে হয়তো তাদের বিধাতা মাফ করে দিতে পারেন। তাই তাদের এই বিচার মেনে নেওয়া হবে সমীচীন। একজন রুপার বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। সে অধিকার তার কাছ থেকে নির্মমভাবে হনন করা হয়েছে। যারা তাকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সকলেরই কাম্য। অপরাধীদের অবশ্যই উচ্চআদালতে যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু কোনো আদালত কিংবা পরিশেষে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ভিক্ষা এসব কোনো কিছুই যদি এই অপরাধের শাস্তি লঘু করে তবে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করার চমৎকার সুযোগ চিরতরে পরিত্যাগ করার নামান্তর হবে। ভুল সংকেত প্রদান করা হবে অপরাধ জগতের প্রভাবসম্পন্ন অপরাধীদের কাছে। নিতান্ত সমান অপরাধে অপরাধীদের নিরুৎসাহিত করতে এ রায় বহাল রাখা হবে অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

লেখক: ব্যারিস্টার। ইংল্যান্ডে আইন পেশায় কর্মরত। ফেসবুক: শহীদ শতাব্দী