যেমন দেখেছি মজার ইশকুল

মজার ইশকুল
মজার ইশকুল

লেখার তেমন অভ্যাস নেই। সে কারণে মনে যত কথা গিজগিজ করে, খুব কম মানুষের কাছেই তা পৌঁছানো সম্ভব হয়। অবশ্য সবার কাছে পৌঁছানোর চেয়ে যে মানুষগুলোর আমার কথা শোনা বেশি জরুরি তারা আমার পরিবার। মনে হয় ওরা সঠিকভাবে আমাকে বুঝতে পেরেছে আর সুযোগ করে দিয়েছে বলেই আমি আমাকে বাংলাদেশে আবিষ্কার করেছি আর্তমানবতার কাজে।

প্রায় তিন বছর থেকে মজার ইশকুলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছি আর শুধু নিজে না ব্রিসবেনের ডজনকয়েক সুহৃদ মানুষকে নিয়ে পাশে আছি নানাভাবে। বিভিন্ন সময়ে আমার ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে, আমার ওপর আস্থা (অবশ্যই ভালোবাসেন বলেই) রেখে যারা মজার ইশকুলের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা পাহাড়সম। আর এই সবার আস্থার দায়ভার থেকেই অনুভব করছিলাম সবার পক্ষ থেকে সশরীরে গিয়ে আমার দেখা উচিত কীভাবে কাজ এগোচ্ছে।
সেই সঙ্গে আরেকটি কাজও হাতে নিয়েছিলাম, আর তা হলো যেহেতু মজার ইশকুল পরম মমতায় সেবা দেয় সারা বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে আসা ও পথে থাকা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের, যারা প্রথমত এসে ভিড় জমায় কমলাপুর রেলস্টেশনে বা সদরঘাট এলাকায়। এদের সঙ্গে পাশে থেকে সাহায্য করা যেমন কাজ তেমনি এদের ভিড় রোধ করার চেষ্টা করাটাও ওদের জন্য উন্নত জীবনের একটা উপায় হতে পারে। এমন ভাবনা নিয়ে আরিয়ান, আরিফ আর আমি একটা মিশন হাতে নিলাম যে আমরা ‘পথশিশু মুক্ত বাংলাদেশ গড়ো’ এমন স্লোগান নিয়ে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া সাইকেল ট্যুর দেব। আর নানা স্কুল বা সরকারি অফিসে কথা বলব যাতে স্থানীয়ভাবে তাদের প্রতি একটু খেয়াল রাখা হয়, যাতে শিশুরা ঢাকামুখী না হয়।
তো যেমন চিন্তা তেমন কাজ। কেটে ফেললাম টিকিট। মহা উল্লাসে শুরু করলাম সাইকেল চালানোর প্র্যাকটিস ও শীতের কাপড় কেনাকাটা। কিন্তু বিধি বাম! সময় যত ঘনিয়ে এল নানা সমস্যা অনুধাবন করতে শুরু করলাম। এই চিন্তার বাস্তব রূপদান প্রায় অসম্ভব ফিল করলাম দেশে এসে। অবশ্য সরেজমিনে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমি তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে যতটুকু জানি ওরা যেন তার চেয়েও একটু বেশি গুছিয়ে বসে আছে। আর সেই প্রেক্ষাপটে আমার এই কাজের চেয়েও বেশি জরুরি ওদের অন্যভাবে সাহায্য করা। ব্যস, প্ল্যান পরিবর্তন! কথায় বলে না, অদৃষ্ট তোমাকে যে দিকে পথ দেখাবে সেদিকেই এগোও বিনা বাক্যব্যয়ে।
ব্রিসবেন থেকে ঢাকায় নেমেই অস্থির ছিলাম স্কুলগুলো দেখার জন্য। সুযোগ হলো সেদিনই। শাহবাগে ওপেন স্কুলে ক্লাস ঠিক ৩টায়! পৌঁছে গেলাম সময়ের আগেই। দেখি কেউ ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউ ব্যানার টানাচ্ছে, কেউ বাচ্চাদের একত্র করছে নিবিষ্ট মনে। এরপর শুরু হলো শপথ গ্রহণ, গোল হয়ে ছোট ছোট গ্রুপে বসে গল্প-হাসির ছলে পড়া, ছবি আঁকা ও রং করা। সবশেষে ভলান্টিয়ারদের টাকায় কেনা খাবার খাওয়ানো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক নিশ্বাসে দেখলাম, শিশুরা কী যে নির্ভরশীল, আন্তরিক আর খুশি। বোঝানো যাবে না এভাবে লিখে। শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তারা দেশের নানা শহর থেকে আসা। একফাঁকে আরিফ দেখিয়ে আনল ঠিক কোথায় শুরু হয়েছিল এই স্কুল! শুনলাম কিছু রোমহর্ষক গল্প যা এই পথশিশুদের দ্বারা ঘটেছে। সব মিলিয়ে শিশুদের সঙ্গে দারুণ এক বিকেল কাটালাম।
পরদিন ছিল ক্লাস পার্টির দিন। এ দিন শিশুরা সিভিল ড্রেসে যাবে, সঙ্গে খবর পেলাম বাচ্চারা টিচারদের জন্য ড্রেসকোড দিয়েছে (শাড়ি)। ইন্সপায়ার্ড হয়ে আমিও শাড়ি পরে সেই সকালেই পৌঁছে গেলাম আগারগাঁও স্থায়ী স্কুলটিতে। যেখানে সুন্দর সাজে, পরিষ্কার পোশাকে, এক মুখ বিগলিত হাসি নিয়ে একঝাঁক শিশু বসে অপেক্ষায় আছে, কখন কেক কাটা হবে। আমার স্পনসর্ড দুজন শিশুও এখানে ছিল। মজার ইশকুল যারা চেনেন কম-বেশি সবাই হাসানকেও তাহলে চেনেন। খুব গর্ব হচ্ছে হাসানের পরিচয়ে পরিচিত হতে যে আমিই ‘হাসান’–এর মা। এই প্রথম কাছে আসা, কিন্তু কী আশ্চর্য! কত আন্তরিক আর সাবলীল ব্যবহার। কাছে বসে অনর্গল কবিতা শোনানো যেন শেষই হচ্ছিল না। এমন কনফিডেন্স যার এই বয়সেই, আমি আশাবাদী একদিন সে এই সমাজকে নিয়ে আমাদের চেয়েও ভালো উপায়ে ভাববে।
আগারগাঁও থেকে গেলাম মানিকনগর স্থায়ী স্কুলটিতে। এদের নিয়মানুবর্তিতা দেখে এক মুহূর্তে ফিরে গেলাম নিজের স্কুল জীবনে। মিল খুঁজে পেলাম অনেক কিছুতেই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এরাই কী রাস্তায় ফুল বিক্রি করত বা ভিক্ষা? পরিষ্কার পোশাকে এখানে সমস্বরে যখন জাতীয় সংগীত গাইছিল, শপথ নিচ্ছিল বা জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানাচ্ছিল, দেখে আশাবাদী হতে বাধ্য হতেই হবে যে কাউকে যে, এই শিশুরা একদিন সমাজের বোঝা তো হবেই না বরং সমাজকে আরও উন্নত করতে বদ্ধপরিকর। কয়েক বছরের অপেক্ষামাত্র, এ সমাজ পরিবর্তন দেখবেই।

লেখিকা
লেখিকা

এখানেও শুরু হলো সবার প্রতিভা দেখানোর পালা। কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। আর সে কী একজনের প্রতি আরেক জনের caring! নিয়মানুবর্তিতাতেও সেরা! মজার ইশকুলের অভিভাবকেরা (শিক্ষক ও ভলান্টিয়ার), Hats off to you Team! এমন শিক্ষা দিতে মমতা লাগে, লাগে সীমাহীন ভালোবাসা। তোমাদের আর কেউ মনে রাখুক বা না রাখুক মজার ইশকুল রিলেটেড প্রত্যেকেই মনে রাখব পরম আদরে। প্রসঙ্গত বলে রাখি এমন শিশুদের বিশ্বাস অর্জন করা আর পাথরে ফুল ফোটানো একই রকম দুঃসাধ্য কাজ!
এখানে এসে একটা জিনিস খুব টের পাচ্ছি, একঝাঁক মানসিক শক্তিতে ভরপুর মানুষ ঝরনার গতিতে নিজের মতো করে ভালো কাজ করে চলছেন দিন রাত। আরিফের কাছে প্রশ্ন ছিল, কেন করো এই কাজ? একগাল হেসে উত্তর দিল, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে, কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে! আমরাই না হয় হলাম সেই অগ্রপথিক! এখন এমন সাহসীদের দরকার একটু মানসিক সাপোর্ট, উৎসাহ, পাশে থাকার অঙ্গীকার! আমরা যারা সামাজিক দায়বদ্ধতার চিতায় জ্বলি তারা এভাবে ভাবেন তো। আমরা ভাগ্যবান যে এতগুলো তারুণ্যের শক্তি একত্রে পেয়েছি। কেবল বিশ্বাস নিয়ে পথপ্রদর্শক হয়ে সাহায্যের হাত বাড়ালেই এদের দ্বারা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থানের বিরাট পরিবর্তন সম্ভব।
এবার বলি, কী সারপ্রাইজ নিয়ে তারা বসে ছিল আমি এলে আমাকে দেবে বলে—
নাম প্রকাশে আপাতত অনিচ্ছুক এক হৃদয়বান ব্যক্তি দীর্ঘদিন মজার ইশকুলের কার্যক্রম খেয়াল করে ভালুকায় প্রায় এক একর জমি অনুদান হিসেবে দেন (কোনো শর্ত ছাড়া) চিলড্রেন ভিলেজ করার জন্য। যা কিনা মজার ইশকুলের ফেজ-৪ এ প্ল্যান ছিল আর এ জন্য তারা কিছু কিছু করে জমিও কিনেছিল মানিকগঞ্জে। কিন্তু এতটা জমি একসঙ্গে হাতে পাওয়ার পর তো আর বসে থাকা যায় না এক মুহূর্ত! কারও কারও চোখে এই চিলড্রেনস ভিলেজ মাত্র একটা বিল্ডিং হলেও ১০০০+ভলান্টিয়ারের এটা স্বপ্ন। আর এ স্বপ্ন পূরণ এখন আর যোজন দূরে নয়। কিছু আন্তরিক মানুষের সদিচ্ছাই পারে তাদের স্বপ্নের বাড়িতে নিয়ে দরজা খুলতে সাহায্য করতে।
উত্তেজনা আমারও তুঙ্গে! মহাআনন্দে ফান্ড ম্যানেজের দায়িত্ব নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছি নানা শহরে, ঢাকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায়। এই ছুটে চলার ফাঁকে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই সব সমমনা অগ্রণী মানুষগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় বড় প্রয়োজন। তাহলে যেকোনো কাজে একে অপরের পাশে থেকে টিম ওয়ার্ক করলে লক্ষ্য অর্জন কোনো অলীক স্বপ্ন নয়।
আর সেই লক্ষ্যেই আমার সকল পরিচিত, বন্ধু, আত্মীয়সহ সবাইকে অনুরোধ করব যারা সত্যিই ভালোবেসে ভালো কাজে সহায়তা দিতে চান তারা মজার ইশকুলের কার্যক্রম খেয়াল করুন, আশা করি কাজের বিশেষত্বে মুগ্ধ হতে খুব বেশি সময় নেবেন না। ‘মজার ইশকুল’–এর অফিশিয়াল পেজে সব ইনফো আছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ডোনেট করুন, আর ত্যাগের আনন্দটাও উপভোগ করুন। সেই সঙ্গে যুক্ত থাকুন একঝাঁক অদম্য মানুষের প্রাণের সঙ্গে একই সুতোয় গেঁথে।
‘জন্মের পর যে বাংলাদেশ আমি দেখিয়াছি মৃত্যুর সময় তার থেকে উন্নত বাংলাদেশ রাখিয়া মরিতে চাই...।’
গত ১০ জানুয়ারি ২০১৮ ছিল মজার ইশকুলের পঞ্চম বর্ষপূর্তি। বর্ষপূর্তিতে অভিনন্দন!

পরিকল্পিত ভিলেজের বিবরণ

চিলড্রেনস ভিলেজের তিন ধাপে আনুমানিক খরচ এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রথম ধাপে ইশকুল ও ফাউন্ডেশন বাজেট ৪০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে আবাসিক ভবন বাজেট ৩০ লাখ টাকা, আর তৃতীয় ধাপে দোতলা স্টাফ, টিচার, কমন রুম, গেস্ট রুম ও ট্রেনিং রুম বাবদ ৮০ লাখ টাকা। যা ধীরে ধীরে এগোবে প্ল্যান মাফিক। আর এতে থাকবে একটি প্রাইমারি স্কুল। মোট আসন ২১০ জন। আবাসিক ভবনটিতে বেড থাকবে ৭১টি, ডাইনিং, কিচেন, কমন রুম ইত্যাদি।

নুর তুলি: ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।