জিয়র ঘুরছে একুশে বইমেলার চারপাশে

নতুন বই নেড়েচেড়ে দেখাতেও আনন্দ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা, ৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
নতুন বই নেড়েচেড়ে দেখাতেও আনন্দ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা, ৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

লেখার কৌশলে হুবহু জীবনকে সাহিত্যে রূপ দেওয়া গেলেও একে কুড়িয়ে নেওয়া দূরান্তর। দুঃখগুলোকে সহজে নিলেও আজ সামান্যেই অপরাগের কৌশল খুঁজে বের করি। কত কী অভিজ্ঞতায় বেলা ফুরাল, শেষের মধ্যেও রইলাম আমি অশেষ। অনেক লেখকই জীবন বৃত্তান্তে সাহিত্য রচনা করেন। কেউ আবার প্রাধান্য দেন কাল্পনিক বিষয়বস্তুর ওপর। কল্পদর্শন গুণে যাই লেখেন, কিছু সত্য গল্পান্তরে জাদুকরের মতোই লুকিয়ে রাখেন। স্বীয় দৃষ্টান্তে কখনো হয়ে ওঠেন খ্যাতিমান। যা হয়ে গেলে তাঁর প্রতি সাধারণের আগ্রহ বেশ বাড়ে। বাড়াবাড়ির ভালো ও মন্দ দুটি দিকই থাকে। শৈশবে কোথাও পড়েছিলাম—‘অত্যধিক খ্যাতি যার জীবনকে অন্ধ করে দেয় শিগগিরই তার মৃত্যু ঘটে।’ স্মরণশক্তি লোপে বিজ্ঞ লোকটির নাম মনে না থাকলেও বাক্যটি হৃদয়ে গেঁথে আছে। অন্তর্দৃষ্টি গোচরে এ কথার প্রমাণও প্রায় মিলেছে। জন্ম ও মৃত্যু একান্তই প্রাকৃতিক, মৃত্যুতে পরিণামই বড়। তবুও বিখ্যাতরা যখন নিজ অনুকরণে কুখ্যাতকে অর্জন করে সমালোচিত হন, আমার বিবেচনায় তা মৃত্যুর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

সবাই জনপ্রিয় হন না, হতে পারেন না, সেই মানুষগুলিও জীবন নিয়ে থেমে থাকেন না। জীবনগল্প রচিলেও তার বাস্তব চাহিদা মিটে যায় না। অবশ্য পাঠকেরা কারও চাহিদা পূরণে বইমেলায় আসেন না। নিজের ভালো লাগা থেকেই তারা বই কেনেন। ফাঁকে কারও জমে ওঠে পাঠক রাজকীয় বাণিজ্য। যে ধারার লেখায় সব লেখকই উপযোগী নন। উপযোগী না হয়েও মানুষ ভালো লাগার জায়গায় বিনা মূল্যে নিজেকে বিকায়। এতে পূর্ণতা সায় দিলে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হয়। জীবন হয় অবকাশময়।
সহজ সফলতা দুরূহ বলে নিজ প্রাণের ইচ্ছাশক্তি, চেতনাবোধ ও প্রতিভাকে অন্যের তুলনায় নগণ্য মেনে আপন সর্বস্বকে হত্যা করা অনুচিত। জীবনলীলার গান কেউ কেউ লেখেন। আপন লীলার গান সবাই গান। আমার সমস্যা হলো ভুল লিখতেও ভুল করি। এমনতর ভুলের কূল নেই। কেউ এসে তা শুধাবে সেও অনুমেয় না। তাই কূলহীন গুণে ভুল ছড়াই! লোকে সমালোচনা করুক, শোধন এসে হাতছানি দিক। আমি কাউকে কিছু দিই না, কেউ এসে আমায় সবই দিয়ে যাবে সেও ভরসাময় না। কাঁচা হাতের লেখায় কারও দায়ভার নেই, থাকতেও পারে না। আমাকে কেউ লিখতে বলেনি, আমিও কাউকে জিজ্ঞেস করিনি, করতে যাইনি। অতএব, বাণিজ্যের কৈফিয়তে অর্থ জোগান দিই। স্বেচ্ছায় বিধিবিধানের ধার্যকে মানি, দুর্বিপাকেও তাই করণীয়। মানুষ চাইলে দুঃখকে সাদর গ্রহণে পছন্দের মূল্য দেয়। এখানে গ্লানির ফলাফল শূন্য, কিছুই করার নেই। আলাদিনের প্রদীপ হাতে পেলে ভিন্ন কথা কিংবা রূপকথা, সে ক্ষেত্রে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
বইমেলা আসে বইমেলা যায়। এই প্রাণের মেলায় না থাকতে পারা বিরহের! মানুষ জানে না আগামী দিন কোথায়, কখন এবং কী নিয়ে তাঁকে দুঃখ করতে হবে। জীবন এমনিই হয়। নিমজ্জিত দুঃখেও ঢেউয়ের আঘাত মাত্রা জানার উপায় থাকে না। নিরুৎসাহকে মঙ্গল দিতে কিছু লিখি বা লিখতে চাই। সে লেখাও অপরিহার্য না। তাই শখের তোলা আশি টাকা দরে লেখা প্রকাশ করি। প্রকাশকের হাতে তুলে দিই উপার্জিত অর্থ। যে অর্থের কেন্দ্রীভূত বিধানে পেয়েছি প্রবাস জীবন। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো টাকার পেছনেই বিলিয়ে দিয়েছি। অর্থ অনর্থের মূল, এই সত্য মেনে বসে থাকলে তো জীবন চলে না। সাধু বাবার জীবনও তো অর্থ ছাড়া চলে না, চলতে দেখি না। তবে সাধু বাবা শুয়ে-বসে পয়সা কামানোর কৌশল জানেন। প্রবাসীর বেলায় ঠিক তার উল্টো। সঙ্গে থাকে অক্লান্ত পরিশ্রম। প্রবাসীকে শুধুই শুনতে হয়, শোনাতে হয় না। মানতে হয়, মানাতে হয় না। হুকুম পালন করার অপর নাম প্রবাস। ব্যতিক্রমে থাকে দণ্ড।

লেখক
লেখক

দণ্ডার্থ জীবনে অনেক টাকায় পকেট ভর্তি করতে পারিনি দুঃখ সে জায়গাতে নয়। সময়, কাল ও স্থান পেরিয়ে গেলে অতীত স্মৃতিই দুঃখ দেয়। মায়ার শৈশব, মায়ের বকুনি, পুতুল খেলার সকিনা, নাড়িভুঁড়িতে লেগে থাকা পল্লির কাদামাটি, জীবন উৎপত্তির শুরুগুলোকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে মোছা যায় না। মা-মাটির মমতা মহাকাশ পেরিয়ে গেলেও মোছা সম্ভব না। প্রবাসে থাকি বলে এর প্রভাব আরও পীড়া দেয়। অনেক সয়ে ও বিসর্জন দিয়েও যখন দেখি ঈদের দিনে প্রিয় সন্তান জুনায়েদ ও শামীর নতুন কাপড়ে সেলফি পাঠিয়েছে, নিমেষেই সব দুঃখ ভুলে যাই। ভুলে যাই এই পৃথিবী নশ্বর। উদ্বিগ্ন ছোঁয়ায় বলি, পুনর্জন্মের অধিকার থাকলে এখানেই আসব! ভূস্বর্গের অচেনা অজানা কোনো দেশে নয়। মায়ার বাঁধন আমার এখানেই শান্তির নীড় খুঁজে পেয়েছে। এ দেশ এ মাটির মঙ্গলেই মিশে গেছে আমার প্রাণ। তার উজ্জ্বল মুখের হাসিই আমার চির সুখ বাসনা। এ নারীর সর্বময়ী সাথিই আমার মুগ্ধতা। এত সবের পরেও সত্যি যে, আমি এই ভুবন-মোহনার কোথাও খুব বেশি দিন থাকি না। আমি গড়ার চেয়ে অধিকতর ভাঙি। আমাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। আমি ছুটছি আমার কর্মের প্রেরণময় গন্তব্যে...।
পরস্পর সুখের আশে প্রবাসে থাকি। কখনো বুঝতে চাই না জগৎ সংসার সুখের রণক্ষেত্র। সুখের ঠিকানা চাই কেউ দেয় না, দিতে পারে না। পারলেও আজব মানুষগুলো নিজ সুখেই ব্যস্ত, বিলিয়ে দিতে নয়! এদিকে শিল্পী তরুণের গানে শুনলাম, ভোরের আলোতে ঈশ্বরের রূপ দেখার পাশাপাশি কষ্টও বেঁচে খেতে শুরু করেছে। ভালোই হয়েছে, খরিদ্দার পেলে আমিও কিছু কষ্ট বেঁচব। সেই কষ্ট না খেয়ে জমিয়ে রাখব। যেদিন কেউ সুখ বেচবে সুযোগে কিনে নেব। কৃপা হলে বসে বসে সুখ খাব। আপাতত মনের মানুষ চাই, কিন্তু মন ছাড়াতো মনের মানুষ পাওয়া যায় না। সামান্যে তো আর তাঁকে মিলে না।
আসলে আমার কোনো গতিই হলো না। নিরুপায়েও আশা হারাই না। বাধাহীন কল্পনায় আশার নায়ক সৃষ্টি করে নাম দিই জিয়র, আমাদের জিয়র...। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র। অর্থ, আভিজাত্য ও বাড়ি-গাড়ির প্রতি তার কোনো মোহ নেই। তার বেশ কিছু এলোমেলো দিক আছে। স্রষ্টার সৃষ্টি হয়েও সে তার পাশে বসে থাকে না। সমস্ত বাধাবিঘ্নকেই সে অনায়াসসাধ্যে এড়িয়ে চলে। বিশ্ব প্রকৃতির রহস্যে তাঁর প্রবল আকর্ষণ বিরাজিত। পৃথিবীর কোনো কিছুকেই সে নিজ থেকে আলাদা দেখে না। কেননা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুকেই মানুষের সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে। স্বভাবত কারণেই সে জিয়র। মানুষের তত্ত্বে গাথা গহিনের কিছু কথা কুড়িয়ে সে সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। একত্ববোধ মনের মণিকোঠায় আত্মশুদ্ধির কৌশল খুঁজে। দুর্লভ ক্ষমতার আশে অযথাই বলে, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মতো যেকোনো সময় জিয়র এসে আপনার দরজায় এসে জিজ্ঞাসা করতে পারে, সুস্থ আছেন তো? মানব-মানবীর আধ্যাত্মিকতায় তাঁর কৌতূহলের সীমা নেই। সে মনে করে জীবনের প্রতি তাঁর অস্তিত্ব ছিল, আছে এবং থাকবে। কর্মের প্রতিফল স্বরূপ বিচারাধীনে পুনঃআবিষ্কৃত হবে। জন্মান্তর যদি নাই থাকত কবি তাঁর বৃন্দাবনের হিসাব-নিকাশ কোথা থেকে মিলাতেন। কল্যাণের কবি সৃষ্টিতে দায়বদ্ধ, তাঁকে সেখান থেকেই লিখতে হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’ স্মরণ করায়—
‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!’

কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ বেষ্টিত করে—

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।’

সর্বার্থেই মানুষ প্রকৃতির রহস্যভেদে অজ্ঞ। জিয়র অজ্ঞে সান্নিধ্য দর্শন চায়। প্রভুর মহিমায় তাকে চিনতে ও জানতে চায়। জীবনের সর্বোপরি শূন্যতায় বাবার অনুগ্রহই তার একমাত্র পথ ছায়া। আমি জিয়রকে অনেক দূরে কোথাও এগিয়ে নিতে চাই। দেশের মাটির মতো একুশে বইমেলা তার খুবই পছন্দের। দেশের প্রতি মায়া মমতা ও ভালোবাসার রাজনীতিতে সে ব্যর্থ। মাতৃভূমির মাটির মায়ায় জিয়র মুগ্ধ! মুগ্ধ মানুষেরা আকাশকুসুমে জড়ায় না। মুগ্ধকর সৌন্দর্যের অদ্ভুত কোনো কারণ মাথায় রেখেই সে বইমেলার চারপাশে ঘুরছে। সংগ্রহ করছে নিজের পছন্দের বই। বাস্তবায়ন প্রচেষ্টায় আছে স্রষ্টার প্রকৃত বিধান।

মো. জিয়াউদ্দিন শাহ: জেদ্দা, সৌদি আরব।