এ জার্নি বাই ট্রেন টু আশিকাগা

আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক
আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক

আমন্ত্রণটা সুমি-আজাদ দম্পতির। নিতান্তই পারিবারিক উপলক্ষ, কিন্তু আয়োজনটি ব্যাপক। টোকিও থেকে অনেকেই দল বেঁধে যাচ্ছেন। কথা ছিল আমি আজাদ ভাই-রেনু আপার সঙ্গে তাঁদের গাড়িতে যাব। আগের রাতে সেভাবেই ঠিক করা ছিল। ছুটির দিন, দেরিতে ঘুম ভাঙার কারণে সব লন্ডভন্ড। আজাদ ভাইকে ‘সরি’ বলে আয়েশ করে ট্রেনেই রওনা দিলাম।

আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক
আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক

ট্রেন জার্নি অনেকের মতো আমারও প্রিয়। ধাবমান ট্রেনে বসে জানালার কাচের দেয়ালের আড়ালে প্রকৃতির নয়নাভিরাম কারুকার্য দেখতে দেখতে ছুটে চলার আনন্দ মনকে নাড়িয়ে দেয়। স্কুলে পড়া ‘এ জার্নি বাই ট্রেন’ আমার শুরু হলো জেআর আকাবানে স্টেশন থেকে। উৎসনোমিয়া লাইনের সেমি এক্সপ্রেসে উঠে পড়লাম। আশিকাগা স্টেশনের উদ্দেশে। চমৎকার রোদ ঝলমলে শীতের সকাল।

আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক
আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক

যেহেতু আশিকাগা যাচ্ছি তাই বন্ধু কমলকে ফোন করলাম। কমল দীর্ঘদিন টোকিও কাটিয়ে আশিকাগা গেছে দুই বছর আগে। কমল জানাল, সে গাড়িতে টোকিওর পথে। পাশাপাশি যে সংবাদটি দিল, তা শুনে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) জাপানের মোহ ছেড়ে চিরদিনের জন্য স্বদেশে চলে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের অসুস্থতা এবং মেয়ের সান্নিধ্যে থাকবার জন্য তার এই সিদ্ধান্ত। প্রবাসে একজন বন্ধুর সংখ্যা আমার কমে যাচ্ছে। এ জন্য যতটা কষ্ট তা কমলের প্রাপ্তির কাছে গৌণ বলে তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানালাম।

ওইয়ামা স্টেশন
ওইয়ামা স্টেশন

কথা হলো আমরা দুজন একই ট্রেনে উঠব এবং কোথাও মাঝপথে দেখা করব। গন্তব্যের দূরত্ব ৯৪ দশমিক ১ কিলোমিটার। ট্রেন এখন সাইতামা জেলার কুকি স্টেশনে। টোকিও ও সাইতামার স্টেশনগুলো এখনো নগরায়ণের মোড়কে ঢাকা। বাড়ি-ঘর, ইমারত আর নানান স্থাপনার আড়ালে প্রকৃতি খোঁজার চেষ্টা বৃথা। মনে হয় ওইয়ামা স্টেশনে ট্রেন বদলের পর গ্রাম্য ও নির্ভেজাল প্রকৃতি পাওয়া যাবে।

স্টেশনে ট্রেন
স্টেশনে ট্রেন

ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা নেই বললেই চলে। ওইয়ামাতে নেমে ট্রেন বদল। রিওমো লাইনে যেতে হবে। ট্রেন ছাড়বে ৪৫ মিনিট পর। স্টেশনের বাইরে সামান্য হেঁটে এসে প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। অনেক যাত্রী ট্রেনে। কিন্তু ট্রেনের দরজা বন্ধ। মনে পড়ল এখানে যাত্রীদের নিজেদেরই সুইচ টিপে ওঠানামা করতে হয়। শীতপ্রধান অঞ্চলে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য এই ব্যবস্থা। ট্রেনে উঠে বসলাম। ৪০ মিনিট পর গন্তব্যে পৌঁছাব। ট্রেনে প্রচুর বিদেশি। কিন্তু সে তুলনায় জাপানিদের সংখ্যা অনেক কম। ব্রাজিলিয়ানদের সংখ্যা বেশি। পাশের জেলা গুনমাতে তাদের একটা শহরই আছে। যেখানে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, এটা জাপানেরই একটা অঞ্চল।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

বিদেশিরা উচ্চ স্বরে কথা বলছেন। যা জাপানে বিরল। ভালো লাগছে। যেন নর্থবেঙ্গল মেলে কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠেছি। হ্যাঁ, বাইরে প্রকৃতির দেখা মিলছে। একদিকে দিগন্ত জুড়ে পাহাড়, অন্য দিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর।
জাপানের কান্ত এলাকা। টোকিওসহ পাশাপাশি পাঁচটি জেলার একটি তোচিগি। এই তোচিগিরই একটি শহর আশিকাগা। আশিকাগা ফ্লাওয়ার পার্ক জাপান খ্যাত। ৯ হেক্টর এলাকায় ১৪০ বছরের পুরোনো ফুল বাগানটি বিশ্ব হেরিটেজে স্থান করে নিয়েছে। তোচিগি শহর ও আশপাশে প্রায় দুই শ বাংলাদেশি প্রবাসীদের বসবাস। প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত। নিজেদের বাড়ি। নিজেদের ফ্যাক্টরির স্থাপনা নিয়ে নিজেদের ঠিকানা গড়েছেন। মূলত গাড়ি, গাড়ির পার্টস রপ্তানির ব্যবসা। ছোট ছোট কারখানাও করেছেন কয়েকজন। বেশ কয়েকজন প্রবাসী নারী জাপানিজ স্কুলে ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব পালন করছেন।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

প্রবাসে শত ব্যস্ততা ও নানা প্রতিকূলতায় হৃদয়ে বাংলাদেশ উজ্জীবিত থাকে। তাই যেকোনো ছুতোয় সবাই মিলে সমবেত হওয়ার অভিপ্রায়ে ছুটির দিনে এই আয়োজন। যথাসময়ে আশিকাগা স্টেশনে পৌঁছলাম এবং যথারীতি স্টেশনে অপেক্ষমাণ গাড়িতে করে আশিকাগা শিমিন প্লাজা হল। এখানেই একটি হলে রান্না ও খাবার আয়োজন এবং ভিন্ন হলে বিকেল থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। টোকিও, সাইতামা ও চিবাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে সবাই আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় এক শ প্রবাসীর সমাবেশ। দুপুরের খাবার, বিকেলের নাশতা। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের আলাদা আলাদা আড্ডা। শিশুদের নানান প্রতিযোগিতা। বিজয়ী শিশুদের পুরস্কার বিতরণ করলাম মুনশি আজাদ, নাসিরুল হাকিম ও আমি।

অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য

যাকে কেন্দ্র করে এই আয়োজন সেই কিশোরী আমরিনের জন্মদিনের কেক কাটা ও স্বরলিপি কালচারাল একাডেমি আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ইতিমধ্যেই কমল বড়ুয়া অনুষ্ঠানস্থলে চলে এলে তাকেও ফুল দিয়ে বিদায় জানানো হলো। কমল বড়ুয়া তার ভরাট গলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃতি করে শোনালেন। রাত হতেই এক এক করে যার যার ঘরে ফেরা। সবার মন জুড়ে প্রশান্তি আর ভালো লাগা। ট্রেন জার্নি শুরুটা ছিল ট্রেন দিয়ে কিন্তু শেষটা হলো গাড়িতে।

কাজী ইনসানুল হক: টোকিও, জাপান।