নারী বনাম নারী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কয়েক দিন আগে (৮ মার্চ) পালিত হলো বিশ্ব নারী দিবস। একজন নারী হিসেবে দিনটিতে বিশেষ ভেবে খুশি খুশি পার করার কথা। কিন্তু আশ্চর্য! বরং উল্টোটা অনুভব করেছি। ভীষণ অপারগ, দুঃখিত, অসহায়, বিদ্রোহী এক নারী আমি শতভাগ জানি, আজকের দিনেও বাংলাদেশের শত শত পুরুষরূপী হায়েনা মেয়েদের নির্যাতন করছেন নানাভাবে। শুধু বাংলাদেশে কেন বিশ্বের নানা দেশের পুরুষ জাতি আজ কোথাও না কোথাও নারীদের ওপর হামলে পড়ছেন, গায়ের জোরের পরখ করছেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এখানে কোনো মাঠ বা ক্রীকের ধার ঘেঁষে কোনো নারী এখনো সন্ধ্যায় একা হেঁটে যেতে ভয় পান। এ ভয় সাপ বা কুকুরের নয়, মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ারের!

নারীর মুক্তি, নারীর অধিকার বলে যতই গলা ফাটিয়ে চেঁচাই না কেন, সমস্যার মূলে এখানে দুটো বিষয় নিয়ে ভাবছি আপাতত। প্রথমত আমরা নারীরা নারীদের কতটা সম্মান দিই, কতটা বুঝি সেটা দেখা। কথায় আছে, ‘মেয়েরাই মেয়েদের প্রধান শত্রু!’ যেকোনো সংসার জীবন, বিয়েত, অফিস বা বন্ধুমহলে দেখবেন একজন নারীকে নিয়ে এক নারীই খাটাচ্ছেন, রটাচ্ছেন বা কাঁদাচ্ছেন! দেখেন, শাশুড়ি-জামাই বা শ্বশুর-বউয়ের সম্পর্ক সব সময়ই যত্নের, ভালোবাসার। আর শাশুড়ি-বউ? ওরে বাবা! সব দেশে সব ঘরে দা-কুড়াল সম্পর্ক।। আর এ সম্পর্কের বিশ্ববিদিত সত্যতা যাচাইয়ে উদাহরণ দিই। এক ধরনের খাঁড়া দেখতে ফণীমনসা গাছের ইংলিশ নামই হলো—‘mother in law’s tongue!’
একই মা-নারী, বউ নারীকে মেয়ে নারী ভাবে না, বউ নারী শাশুড়ি নারীকে মা ভাবতে পারে না, ননদ-নারী ভাবি-নারীকে বোন ভাবতে পারে না বা তার বিপরীত!
পাশের বাড়ির নারী কীভাবে শাড়ি পরল, কেমন করে হাঁটল, ক্ষ্যাত না অতি চালাক তার গোলবৈঠক বসাই আমরা মেয়েরাই চা-শিঙাড়ার আয়োজন করে। দিন শেষে চাকরি থেকে ফেরা ক্লান্ত-শ্রান্ত পুরুষটির কাছে নিজেদের একগাদা নালিশ নিয়ে লাইন দিই বাড়ির সকল মেয়েমানুষগুলো। অফিসে কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি পেলে হিংসায় জ্বলে দল পাকাতে থাকি আমরা নারীই। রাস্তায় কোনো মেয়েকে বিপদে দেখলে সবার আগে নিজের অবস্থান নিরাপদ করি। মেয়ে হয়েও ভাবি না কাল আমারও আসতে পারে এই দিন।
আমার পুরো জীবনকে দুভাগ করলে মোটামুটি প্রায় সমানই হবে স্বদেশ আর প্রবাসজীবন। দেশে থাকতে গড়পড়তা আর দশটা মেয়ের মতোই আমার জীবনটা কেটেছে। ছেলে-মেয়ের পার্থক্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈষম্যের স্বীকার মেনেই জীবনযুদ্ধে এগিয়েছি। ছুটিছাটাতে দাদাবাড়ি গেলে, মুরগির রানটা বা গাছের কলার কাদির একটা পাকলেও সেটা চাচাতো ভাইয়ের (তিনি সব সময় বাড়িতেই থাকেন আর আমরা বেড়াতে যাওয়া যদিও) জন্য তুলে রাখতেন কিন্তু আমার দাদি নামের নারীই। একান্নবর্তী পরিবারে সারা দিন রেঁধে, সংসার সামলে পড়ন্ত বিকেলে চাচিরা খেতে বসলে কিন্তু তলানিটুকুই ভাগ্যে জুটতো অহর্নিশ! কে বানাল এই প্রথা? সেই নারীই!
৩০ বছর সংসার করা মেয়েরা এসে বাবার বাড়ির পারিবারিক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু চার কদম পাশের ঘরে বসে থাকা ছেলের বউটার উপস্থিত থাকার যোগ্যতা হয় না। কে করল এই নিয়ম? ওই নারীই! এমন হাজারো গল্প জমা আছে বাংলার ঘরে ঘরে।
নারীদের এই দুর্গতি যে কেবল বাংলাদেশেই তা নয়, হলে তো আর ‘বিশ্ব নারী দিবস’ ঘোষিত হতো না। বাকি অর্ধেক প্রবাস জীবনেও ঢের নারী সমস্যা জানলাম। এখানেও চার নারী একত্র হলে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ‘শাশুড়ি’ হতেই দেখলাম। অফিসে মেয়েদের সঙ্গে কূটনামিতে নারীরা সেইরকম পারদর্শী।
আইনের শাসন বাড়াবাড়ি রকম কড়া সত্ত্বেও যত ঘটনা ঘটে মেয়েদের সঙ্গে, মাঝে মাঝে ভাবি এমন না থাকলে বাংলাদেশের চেয়েও না জানি খারাপ হতো পরিস্থিতি।
দ্বিতীয়ত পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতন—আবহকাল ধরে এই প্রথা চলছে বিশ্বময়! বাংলাদেশের পত্রিকা খুললেই শত শত খবর এ নিয়ে। দিনকে দিন বেড়েই চলছে এর ভয়াবহতা।
একটা প্রশ্নের উত্তর ভেবে পাই না। নারীর গর্ভ ছাড়া যখন পুরুষেরা পৃথিবীর আলো দেখতে পারে না, তখন সেই পুরুষেরা জেনে বুঝেও কবে থেকে তাদের সৃষ্টির আঁধারকে সম্মান না দেখিয়ে বরং উল্টো কৃপা করতে শুরু করল? হতে পারে নারীর দুর্বলতা ‘মায়া’—যা উসকে দিয়েছে তাদের, ভ্রষ্ট হতে সাহায্য করেছে। এখানেও আমরাই দায়ী! নারীরা অনেক পরে বুঝতে পেরেছে মানুষ ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’! যত দিনে এই বোধ হয়েছে তত দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। অভ্যাস কী সহজে যায়? তাই এই অধিকার অর্জনে মেয়েদের এখন কত দিবস, ক্লাব, সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদির আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
‘কানা গরুর ভিন্ন পথ’—আমি এর সমাধান খুঁজি আমার মতো করে। আর তা হলো, এই পুরুষেরা যেহেতু নারীর হাতেই বড় হয়, কাজেই তাদের ভালোবাসা, মানবিকতা, সততা, নিষ্ঠা—এসব শিক্ষার পাশাপাশি ধরে ধরে নারী জাতির প্রতি সম্মানবোধের বীজটা আমরাই পারি ছেলেদের মধ্যে রোপণ করতে। যখন তারা এই দীক্ষা রক্তে মিশিয়ে নিয়ে বড় হবে তখন চাইলেও একটা মেয়ের দিকে খারাপ দৃষ্টি ফেলতে পারবে না বা আঘাত করার মানসিকতাই আসবে না।
এখনো সমাজে তাদের সংখ্যাই বেশি যাদের ছেলেরা অপরাধ করে ফিরলে মায়েদের কাছেই প্রথম আশ্রয়-প্রশ্রয়টা পায়। আর তাই তো তারা আবার এমন অপকর্ম করার সাহস পায়। কী বাংলাদেশে কী বিদেশে এখনো পুরুষেরা মাকে খুশি করতেই বউকে শাসন করে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তাই চলুন আমরা নারী কূলের বৃহৎ স্বার্থে, কী শিক্ষিত, কী স্বল্পশিক্ষিত, কী অশিক্ষিত সব নারীদের মাঝে এক মধুর ও সংক্রমক বার্তা পৌঁছে দিই যাতে তারা তাদের ছেলেদের নারী জাতির প্রতি সম্মানবোধ নিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন। শুধু তাই নয়, ছেলেরা ভুল করলে মায়েদেরও যে তাতে অপরাধবোধ জাগা উচিত তা আমরা আশপাশের মেয়েরা যেন বিশেষ যত্নে মনে করিয়ে দিই!
‘ভালোবাসার নৌকা পাহাড় বইয়ে যায়।’
মা–বোন–মেয়ে—সবাইকে বলি, র‍্যালি করে, নারী দিবসে চিৎকার করে কিচ্ছু হবে না।
নীরব বিপ্লব ঘটানোর শপথ নাও। ছেলেদের ভালোবাসা শেখাও—এই পুরুষেরাই নদ-নদী-পাহাড় বইয়ে এক সুখী নারীর বাগান বানিয়ে দেবে!

নূর তুলি: ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।