সুন্দরের মাপকাঠি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গায়ের রং কালো নিয়ে আমার কখনো জটিলতা হয়নি শৈশবে-কৈশোরে। বরং প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। জানতাম না এটা একটা সামাজিক ট্যাবু। ১১ বছর বয়স থেকে পশ্চিমা রঙের অপর্ণা সেন সম্পাদিত সানন্দা পত্রিকায় বিউটিশিয়ান শেহনাজের কলাম পড়তাম। সেখান থেকে জানলাম রং না স্কিন কোয়ালিটিই আসল। শ্যামা মেয়ের মুখের ত্বক যদি মসৃণ থাকে, সে অনেক আকর্ষণীয়। সাবান ব্যবহার করা যাবে না। পরিবর্তে ডাল বাটা, বেসন বাটা দিয়ে মুখ ধুতাম। পোলাপান ধুমধাম পছন্দ করতে শুরু করল। সেটা ত্বকের জন্য না। আমার পাগলামির কারণে। আমার রুচি ছিল বাজে। রাস্তাঘাটের পোলাপান পছন্দ হতো।

আমার মেজো বোনের বান্ধবীর রং ছিল কালো, চোখ ছোট। স্কুল-কলেজে তাকে ডাকত সবাই কালি। সেই আপা খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। হালকা সাজতেন। অপূর্ব গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তার বাবার মৃত্যু হলো। তার বড় ভাই মেডিকেলের ছাত্র। সব ভাইবোনেরা পড়াশোনা করছে। আপা বাংলাদেশ বিমানে চাকরির জন্য আবেদন করলেন। তিনি হাজার হাজার ফরসা মেয়েকে টপকে কেবিন ক্রু হয়ে গেলেন। পুরা সংসারের দায়িত্ব মাথায় নিলেন। বিয়ে করলেন বুয়েট থেকে পাশ করা সুদর্শন এক ইঞ্জিনিয়ারকে। কালো রং তার জীবনকে থামিয়ে রাখেনি। এখন আছেন কানাডাতে।

লেখিকা
লেখিকা

রং নিয়ে প্রথম বিরূপ মন্তব্য শুনি, শাশুড়ি আর ননদের কাছ থেকে। তুমি দেখতে ভালো না। টিং টিংয়ে লম্বা। স্বামী বলেন, ও ক্যাটওয়াকের মডেলদের মতন। শাশুড়ি বলেন, সংসারে মডেল দিয়ে করবি কি? এক ব্রিগেডিয়ারের ছেলের বউকে দেখিয়ে বলেন, দেখ তোর করিম আঙ্কেলের ছেলের বউ ফরসা গোলগাল। কত সুন্দর। সত্যি বলতে, এই সব কথা আমার গায়ে লাগেনি। ভাবতাম, তিনি যেভাবে সমাজকে দেখেছেন, তাই বলছেন। নাথিং পারসোনাল।
ইংল্যান্ডে এসে দেখলাম গায়ের রং নয়, উচ্চতা, ব্যক্তিত্ব, ফিটনেস সুন্দরের মাপকাঠি। আমরা কথায় কথায় পশ্চিমাদের রেসিস্ট বলি, নিজেরা যে কত রেসিস্ট সেটা টের পাই না। শুধু গায়ের রং ফরসা খুঁজি। বিদেশে এসে বহু কালো ছেলেমেয়ের প্রতি মুগ্ধ হয়েছি। হই। সেদিন পড়লাম কালো রঙা ছায়াপথের রহস্যের মতন ইথিওপিয়ার এক মডেল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রোজগারি মডেল। তার কাছে শেতাঙ্গিনি মডেলরা অনেক পিছিয়ে আছে।
কালো, সাদা, তামাটে, বাদামি—এই রং যদি মানুষের সুখ ও পরিতুষ্টি (satisfaction) এনে দিত, তাহলে পৃথিবীর সুন্দরী চিত্রতারকারা ডিভোর্সের শিকার হতেন না। তাদের স্বামীরা অন্য নারী খুঁজতেন না। নিজের দেহ, আশা ও মনের যত্ন নেওয়া জরুরি। বেঁচে থাকার কারনটা জানা দরকার। সমাজ ও মানবতায় নিজের ভূমিকাটা কী? সেই প্রশ্নটা নিজেরে করা যেতে পারে। বেশির ভাগ মানুষই বই আঁকড়ে পরকাল খোঁজেন। নিয়মে এটা করলে, পরকালে চির সুখ পাব। আমার মনে হয়, নিজের দায়িত্ব, কাজ, নিয়ত সৎ রেখে, সব সম্পাদন করলে বিশ্বাসীদের চিন্তা নাই। বাকিটা প্রকৃতি, আল্লাহ বা স্রষ্টা করবেন। আর পরকাল নিয়ে যাদের মাথাব্যথা নেই তারা জীবন, কাজ নিয়ে এগোতে থাকুক। সব দলেরই এক আলাদা গতিপথ থাকে। সেই পথটা যদি সুন্দর আর ট্রুথ ফুল হয়, চিন্তা কী? আমি কোনো বিশেষ দলের, বিশেষ আইডলজির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। পথ বেঁধে দিল গ্রন্থি—শুধু চলাটা চলুক উপদ্রবহীন।

তাহমিনা আমির: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।