ভাষা ও সংস্কৃতি

গাঁদা ফুলের গয়না ও বাসন্তী রঙের শাড়িতে উচ্ছ্বসিত তরণীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত উৎসব। ছবি: সাজিদ হোসেন
গাঁদা ফুলের গয়না ও বাসন্তী রঙের শাড়িতে উচ্ছ্বসিত তরণীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত উৎসব। ছবি: সাজিদ হোসেন

একুশ কেন আমাদের কাছে এত তাৎপর্যপূর্ণ? এটা নিয়ে নিশ্চয় বিশদ আলোচনার দরকার নেই। ভাষা আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ। মানুষের যতগুলো আত্মপরিচয় থাকে, তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। তার দেশ, জাতি, ধর্ম, পরিবার যেমন তার আত্মপরিচয়, তেমনি ভাষাও। আর নিজের আত্মপরিচয় প্রতিটা মানুষের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। একুশ আমাদের সেই আত্মপরিচয়ের অধিকার অর্জনের মাইলফলক। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর।

দুঃখের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম এই উপলব্ধিটা থেকে ধীরে ধীরে দুরে সরে যাচ্ছে। নিজেদের আসল পরিচয় কী এটা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ভাষা পরিবর্তনশীল। কালের প্রবাহে এর পরিবর্তন হবে। নতুন শব্দ যোগ হবে, এটাই স্বাভাবিক। এমনকি শব্দের ব্যবহারও পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তন আসে বানানে। কিন্তু বাংলা ভাষা বলা, লেখা, পড়া অর্থাৎ ভাষার সার্বিক চর্চায় প্রবল অনীহা চলে এসেছে। ভুল উচ্চারণে বাংলা বলা, বাংলার সঙ্গে প্রচুর ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ অথবা আদৌ বাংলা না বলাকে আধুনিকতার পরিচয় হিসেবে দেখা হয়। দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। পৃথিবী সম্পর্কে জানার দরকার আছে। কিন্তু মাধ্যম কেন ইংরেজি হতে হবে? মানছি ইংরেজি শিক্ষার দরকার আছে, শুধু লেখা নয়, বলাটাও। ইন্টারনেট এমনিতেই সেই সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। জগৎ সম্পর্কে জানার সুযোগও করে দিয়েছে অবারিত। তারপর নিজেদের বাড়িঘর, স্কুল, পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কেন ইংরেজিতে কথা বলতে হবে? কেন পুরোপুরি বাংলায় নয়?

লেখিকা
লেখিকা

ভাষার ব্যবহার কিন্তু শুধু বলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লেখাতেও নয়। মানুষ কী ভাষার গান শোনে, রেডিও শোনে, টিভি দেখে, চলচ্চিত্র দেখে, বই পড়ে বা ইদানীং বলা যায় টেক্সট মেসেজ করে, ফেসবুকের পোস্ট লেখে; এগুলোর সঙ্গেও জড়িত। সেদিক দিয়েও বলা যায়, আমরা বাংলাকে হারাচ্ছি, আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজস্ব অস্তিত্ব। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি গান বাংলা গানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি জনপ্রিয়। চলচ্চিত্র বা টিভি দুটো মাধ্যম অনেক আগেই দখল করে নিয়েছিল হিন্দি, সেই সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ইংরেজিও। এই দুটো মাধ্যম ভীষণ শক্তিশালী মাধ্যম। যেকোনো জাতির চিন্তাধারায়, আদর্শে, জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে এ দুটো মাধ্যমের কোনো তুলনা নেই। আমাদের দেশের মানুষের পোশাক আশাকে, উৎসবে, সংস্কৃতির সবগুলো অঙ্গনে সর্বোপরি তাদের আদর্শে, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিতে, চরিত্রে, পারস্পরিক সম্পর্কে সবকিছুতে, সবকিছুতেই এগুলোর প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। শাড়ি জিনিসটা উৎসব ছাড়া দেখা যায় না। ঈদের বা পূজার আনন্দকে ছাপিয়ে যদি ভ্যালেন্টাইন ডের উদ্‌যাপন বড় হয়ে যায়, সেটা বাঙালি সংস্কৃতির জন্য একটা ধাক্কা বৈকি। একেকটা বিয়ের দশটা করে অনুষ্ঠানের আয়োজন হিন্দি সিনেমার অনুকরণে। পোশাক আশাক সাজসজ্জাও হতে হবে সেই রকম। আর অনুষ্ঠান মানেই হিন্দি গানের সঙ্গে নাচ, হিন্দি সিনেমার অনুকরণে নাচ। বাঙালি নাচ কই? বাঙালি গান কই?
ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরে এই আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হলে মুক্তির পথ আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। এখনই চেষ্টা না করলে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে। নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে নিজেদের গর্বিত হতে হবে। নিজের অস্তিত্বকে ভালোবাসতে হবে। আমাদের সন্তানদের আমাদের শেকড়ের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমরা যদি আমাদের আত্মপরিচয়ে গর্বিত না হই, তাহলে আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? আসুন বাংলাকে ভালোবাসি, বাংলা চর্চা করি দৈনন্দিন জীবনে। শুধু একটি দিনে ভালোবাসা দেখিয়ে, বাকি তিন শ চৌষট্টি দিন তাকে ভুলে গেলে হবে না। বছরের প্রতিদিন চলুন ভালোবেসে বাংলা বলি, বাংলা গান শুনি, নাটক দেখি, চলচ্চিত্র দেখি, বই পড়ি, মন থেকে ভালোবাসি আমাদের নিজেদের পরিচয়।

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।