পরবাসীর জীবন

বাজার শেষে ট্রলি ঠেলে বাসায় ফেরা
বাজার শেষে ট্রলি ঠেলে বাসায় ফেরা

মায়ার সকল বাঁধন ছিন্ন করে বিমানবন্দরে সকল শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ১৩ মার্চ ২০১৫ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটা বিমানে চড়ে বসা। সিঙ্গাপুরে শুধু বিমান বদলানোর সময়টুকু হেঁটে পার হওয়া। এরপর দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তিকর যাত্রা শেষ করে সিডনি বিমানবন্দরে আমরা পৌঁছালাম সন্ধ্যার কিছু আগে। তারপর বিমানবন্দরের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে বাইরে এসে মেজবার ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা। তিনি আমাদের নিতে আসবেন। তাঁর মোবাইল নম্বর আগে থেকেই আমার মোবাইলে সেভ করা ছিল।

এদিকে আমার মোবাইলে তখনো বাংলাদেশের মোবাইলের সিম আর বিমানবন্দর থেকে কীভাবে সিম কিনতে হয় তাও জানি না। তাই মেজবার ভাইয়া এসেছেন কিনা সেই সন্ধানে আমি এদিক-ওদিক ঘুরে দেখছিলাম। আমার চলাফেরা দেখে পরিপাটি পোশাক পরিহিত এক ভদ্রলোক এসে গায়ে পড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কাউকে খুঁজছ? আমি উত্তরে জানালাম আমরা একটু আগেই বিমান থেকে নেমেছি। যিনি আমাদের নিতে আসবেন তাঁকে খুঁজছি। তিনি বললেন তার মোবাইল নম্বর বলো। আমি মোবাইল নম্বর বলার পর তিনি নিজেই ডায়াল করে একটু পরে রিং হচ্ছে বলে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি মেজবার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম তিনি চলে এসেছেন। গাড়ি পার্ক করছেন।
বিদেশবিভুঁইয়ে কীভাবে থাকব সেটার প্রথম ধাক্কাটা ভালোভাবেই কেটে গেল। একটা সুন্দর অনুভূতি তৈরি হলো মনের মধ্যে। সেই মানুষটাকে ধন্যবাদ দিলাম। উত্তরে তিনি বললেন, এটা কোনো ব্যাপারই না। তোমরা ভালো থেক। আসলে বিমানবন্দর হচ্ছে যেকোনো একটা দেশে ঢোকার দরজার মতো। তাই দরজা দিয়ে ঢুকতেই যদি আপনার মনে সুন্দর অনুভূতি হয় তাহলে বাকি সময়টা পার করা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়।

রায়ান ও তাহিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ
রায়ান ও তাহিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ

দেশে থাকতেই মেয়েকে সাঁতারে ভর্তি করে দেওয়া থেকে শুরু করে সাইকেল কিনে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েও অর্থের অভাবে সেগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখানকার বাচ্চাদের সাঁতার ও সাইকেল চালানো একেবারেই মামুলি ব্যাপার। সেই সঙ্গে তারা স্কুটার, স্কেটিং ও কারাতেও শেখে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে। তাই অস্ট্রেলিয়াতে আসার এক সপ্তাহের মাথাতেই মেয়েকে সাইকেল ও স্কুটার কিনে দিলাম এবং সাঁতারে ভর্তি করে দিলাম। আর অনেক খুঁজে কিছুদিন পর স্কেটিং সুও কিনে দিলাম।
এখানে প্রায় প্রত্যেকটা পাড়াতেই একাধিক খেলার মাঠ। ভাগ্যগুণে আমাদের বাসার ঠিক সামনেই একটা খেলার মাঠ পেয়ে গেলাম। আমরা প্রতিদিন বিকেলে একেবারে রুটিন করে সেখানে খেলাধুলা শুরু করলাম। সেখানে খেলতে আসা অন্য বাচ্চারাও অনেক মিশুক। তাই দেখতে দেখতে আমার মেয়েটার অনেক বন্ধু তৈরি হয়ে গেল। আসলে অস্ট্রেলিয়াতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাচ্চাদের মানুষ করা হয়। তাদের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি বিনোদনের ওপর থাকে সরকারের কড়া নজরদারি। বাচ্চাদের সময়মতো টিকা না দিলে স্কুলে ভর্তি করবে না। এমনকি দুই সপ্তাহ পর যে ভাতা মা-বাবাকে দেওয়া হয় সেটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই সুষ্ঠুভাবে বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে স্বর্গরাজ্যই বলা চলে। আমার কাছে মনে হয় যে দেশের বাচ্চারা যত বেশি আনন্দময় পরিবেশে বড় হয় সেই দেশের ভবিষ্যৎ তত বেশি উজ্জ্বল।
অস্ট্রেলিয়াতে এসে আমরা সিডনি শহর থেকে বেশ কিছুটা পশ্চিমের সাবার্ব মিন্টোতে বাসা নিলাম। কারণ আমরা এসে উঠেছিলাম পাশের সাবার্ব ইঙ্গেলবার্নে মেজবার ভাইদের বাসায়। তিনিই খুঁজে দিয়েছিলেন আমাদের প্রথম বাসা। তাই প্রথম বাসা পাওয়ার ঝক্কি আমাদের তেমন একটা পোহাতে হয়নি। মিন্টোকে আমি বলি সিডনির গ্রাম এবং আমার শৈশবের বেড়ে ওঠা গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে সব সময়ই তুলনা চলে আসত মনে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছপালা আর তাতে হরেকরকমের পাখপাখালি। তবে কাক ও কাকাতুয়ার সংখ্যায় বেশি। মিন্টোর প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে মিন্টো শপিং সেন্টার। সেখানে দরকারি সব জিনিসেরই দোকান রয়েছে। মুদি জিনিসপত্র থেকে শুরু করে বাড়িঘরের আসবাব, এমনকি মাছ-মাংসেরও দোকান রয়েছে।
বাংলাদেশের গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে যাওয়ার মতো করে আমরা সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে বাপ-বেটি মিলে বাজার করে সেই বাজারের ট্রলি ঠেলে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসি। কারণ গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে আমাদের প্রায় বছরখানেক লেগে গিয়েছিল। তত দিন এভাবেই আমরা আমাদের বাজার-সদাই করেছি আর তাহিয়া ট্রলিতে চড়ে বেড়িয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামের সবকিছু এখানে পেলেও মনে মনে শুধুই গ্রামীণ একান্নবর্তী পরিবারের বন্ধনটা অনুভূত হতো। আর সেই অনুভূতিগুলো প্রকাশের জন্য ফেসবুকে চলল লেখালেখি। বন্ধুদের উৎসাহে একদিন একটা লেখা ‘প্রিয়জনের ওম’ প্রথম আলোতে পাঠাই। তারপর থেকে লেখালেখি চলছে অবিরাম। আসলে মানুষ যেমন প্রেমে পড়লে কবি হয়ে যায় তেমনি ছ্যাঁকা খাওয়ার পরও অনেকে কবি হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে হলো দ্বিতীয়টা।
প্রবাসজীবনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন আমার ছেলে রায়ান। তবে এটা ওর মায়ের জন্য ছিল খুবই কঠিন সময়। রায়ানকে গর্ভে নিয়েই পায়ে হেঁটে তাহিয়াকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং আসা দুটোই করতে হতো। হাসপাতালে নিয়মিত চেকআপগুলোও করতে যেতে হতো বাসে করে। আধা ঘণ্টার ওপরে ভ্রমণ করে। এমনই একদিন তাহিয়াকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে মাথা ঘুরে রাস্তায় বসে পড়ে। পরে এক প্রতিবেশী তার বাড়ি নিয়ে অনেক সেবা শুশ্রূষা করে বাসায় দিয়ে গিয়েছিলেন।
আমি এগুলোর কিছুই জানতাম না, কারণ আমি সারা দিন অফিসে থাকতাম। তখন আরও প্রকটভাবে দেশের কথা মনে পড়ত। বিশেষ করে ও অনেক কান্নাকাটি করত। এই প্রথম বাবা-মায়ের আদর ছেড়ে দূর দেশে পড়ে আছে। আর বিপদের সময়েও কেউ পাশে নেই। তখন পাশের বাসার বাংলাদেশি এক প্রতিবেশী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাহিয়াকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও আসার কাজটা থেকে অন্তত অবসর পেল সে। তবে বাসা থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে হাসপাতালে নিয়মিত আসা যাওয়া চলতেই থাকল।

ইঙ্গেলবার্ন লাইভ অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফুটপাতে একটু জিরিয়ে নেওয়া
ইঙ্গেলবার্ন লাইভ অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফুটপাতে একটু জিরিয়ে নেওয়া

আমার এখনো মনে আছে রায়ান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনও আমরা সবাই বাসে করে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন তাহিয়ার ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষণের মুহূর্তগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল বারবার। আমি সেন্ট্রাল হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে কত পরিচিত মুখ। সবাই সান্ত্বনার ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে আছে দেখেই মনে অনেক সাহস পেয়েছিলাম। কারণ তাহিয়ার মায়ের রক্তস্বল্পতা রোগ ছিল। তাই সি সেকশনে ঝুঁকি ছিলই। যদিও ডোনার তৈরিই ছিল।
কিন্তু এখানে শুধু আমি আর তাহিয়া অপেক্ষা করছি। অবশেষে একসময় ডাকা হলো আমাদের। আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা নাদুসনুদুস ফরসা বাচ্চা আমাদের সামনে চোখমুখ শক্ত করে ঘুমিয়ে আছে। তাহিয়ার চিৎকারে কিছুটা চোখ মেলে আমাদের দিকে এক পলক দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। তাহিয়ার খুশি ওর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছিল। এত দিনে একজন স্থায়ী খেলার সাথি পেল। আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ সি সেকশনের ইনজেকশন দিতে গিয়ে মেরুদণ্ডের নিউরনে তিনটা ছিদ্র করে ফেলেছিল এখানকার ডাক্তার। তাহিয়ার মা নিজেই গাইনির ডাক্তার তাই আমাকে বলল, এটা শতকরা একজনের ক্ষেত্রে ঘটে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা আমি। একেবারে টানা তিন দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। কারণ নড়াচড়া করলে যেকোনো মারাত্মক কিছু ঘটার সমূহ সুযোগ ছিল। যা হোক অবশেষে সে ধীরে ধীরে সেরে উঠেছিল।
রায়ানের গায়ের রং অনেক ফরসা হওয়াতে আমি এখনো প্রায়ই আমার গিন্নির সঙ্গে মজা করে বলি, এই ছেলেটা আসলেই আমার তো? তবে ও যতই বড় হচ্ছে আর স্বভাবচরিত্রে ততই ও যে আমার ছেলে সেই প্রমাণ দিয়ে চলেছে। আমি আমার এই ছোট জীবনে এত কম বয়সী বাচ্চার এত দুষ্টুমি দেখিনি। আমি যেখানেই যাই দ্রুতই সেখানকার বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলি, তাই বিভিন্ন বয়সী অনেক বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলছি। এখন ওর বয়স প্রায় আড়াই বছর। সে সবকিছুই বোঝে, এমনকি গলার স্বরের সামান্য রুক্ষতাও ওর কাছে ধরা পড়ে এবং মন খারাপ করে। তবে এখন পর্যন্ত কোনোই কথা বলে না। যেখানে বাংলাদেশে এই বয়সী বাচ্চারা প্রায় সব কথায় বলতে পারে। কিন্তু ও যেহেতু কম শোনে এবং বিভিন্ন রকমের ভাষা শুনে তাই আমার মনে হয় ওর কোমল মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়ে কোনোটাই নিতে পারছে না। বাংলাদেশে বাবা-মা ভাই-বোনের বাইরেও ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেক মানুষ থাকে। তাই আমার মনে হয় তারা দ্রুতই কথা বলা শেখে ফেলে কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নেই। তাই হয়তো ওর কথা বলতে দেরি হচ্ছে। এ কারণে আমি আবার নতুন করে একান্নবর্তী পরিবারের অভাব অনুভব করছি। জানি না কবে নাগাদ ও কথা শিখবে।
এবার সারমর্মে আসি। প্রবাসজীবন সামাজিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে জীবিকার নিশ্চয়তা, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তাও অনেক ক্ষেত্রে নিশ্চিত করলেও জীবন থেকে প্রিয়জনের আদর স্নেহ ব্যাপারগুলো কেড়ে নিয়েছে। আমি এখন জানি জীবনের সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি এই অদৃশ্য জিনিসগুলোও কতটা দরকারি। কারণ আমার গিন্নি তার ডাক্তারি পড়াশোনা করতে গিয়ে একদিন বলল, এই সকল উন্নত দেশে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। আমি মনে মনে ভাবি এত নিশ্চয়তার পরও এরা কেন আত্মহত্যা করে। এর কারণ এখানকার পারিবারিক বন্ধনগুলো বোধ হয় বাংলাদেশের মতো অতটা জোরালো নয়।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি এখানকার বেশির ভাগ বাচ্চাই কথায় কথায় বলে, আই অ্যাম বোরড। আর এই প্রবণতাটা বাংলাদেশি বাচ্চাদের মধ্যে বেশি দেখেছি। জানি না এর সঠিক কারণ কোনটা। তাই আমি তাহিয়া ও রায়ানকে সারাক্ষণই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টায় আছি যাতে ওদের শৈশব বোরড না হয়ে আনন্দময় হয়। কতখানি সফল হতে পারব সেটা সময়ই বলে দেবে।
বিগত তিন বছর অনেক ভালো অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে খারাপ অভিজ্ঞতার ঝুড়িও একেবারে হালকা নয়। কিন্তু আমি ভালো স্মৃতিগুলো মনে রেখেই সামনের দিনে পথ চলতে চাই। আমার আচার আচরণে যেন এখানকার ভিনদেশি লোকেরা ভাবতে পারে যে, বাংলাদেশ একটা অনেক বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ দেশ। গ্রামীণ বাংলার পরিবেশে এখনো এই বৈশিষ্ট্য বেশ প্রকটভাবেই বিদ্যমান যদিও শহুরে বাঙালি বেশ কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। কিন্তু অন্য দেশের মানুষদের কাছে অন্তত আমরা আমাদের ভালো গুণগুলোকেই হাইলাইট করব।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>