মেধা নাকি কোটা?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিসিএস ছাড়া একটি মাত্র সরকারি চাকরিতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। লিখিত পরীক্ষায় পার হলাম। ভাইভার জন্য ডাকা হলো। সে সময় প্রচণ্ড জ্বর হলো। কুমিল্লা থেকে ভাইভা দেওয়ার জন্য ঢাকা গেলাম। আব্বা সঙ্গে গেলেন। ভাইভা হলো। বোর্ডে উপস্থিত লোকগুলোর মুখে বেশ মুগ্ধতা দেখলাম। তারা বললেন, লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে করা তালিকায় আমি প্রথম কয়েকজনের একজন। আরও বললেন, যাদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের ঠিকানায় চিঠি পাঠানো হবে। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে, আমি ফোন করেছিলাম। তারা আমাকে জানালেন, কোটাধারী বেশ কয়েকজন প্রার্থী আছে। তাদের নিয়োগের জন্য আগে সুপারিশ করা হবে। আমাকে তারা রেখেছেন ওয়েটিং লিস্টে। সে ওয়েটিং আজও শেষ হয়নি আমার!

আমার খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। প্রচণ্ড দুঃখবোধ নিয়ে কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় হয়ে ছিলাম। এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার মতো কোটাহীন, অর্থহীন, পারিবারিক দাপটহীন, ক্ষমতাহীন, বিত্তবান পিতাহীন মানুষ যতই যোগ্য হোক, তাদের জন্য লড়াইটা আরও কঠিন। কঠিন থেকে কঠিনতর! বহুগুণ প্রচেষ্টায় বিদেশের বহু জায়গায় আবেদন শুরু করি। সে বছরই আমি স্টকহোমে যাই। জ্ঞান-গবেষণার উর্বরতম ভূমিতে যখন আবাদ শুরু করি, তখন বরং সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম। এ জন্য করেছিলাম যে, সেদিন যদি কোটার অজুহাতে আমাকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা না হতো, তাহলে পৃথিবীর এত সুন্দরতম পরিবেশ আমি হয়তো দেখতাম না। সৃষ্টির যে আনন্দ, সেটা কোনো দিনই উপভোগ করতে পারতাম না। পৃথিবীর এত আলোকিত প্রতিষ্ঠান, মানুষ ও জ্ঞানীদের কাছে পাওয়ার সুযোগ হতো না। একজন মানুষ যে পৃথিবীর সন্তান হতে পারে, সে বিষয়টাই ধারণার মধ্যে থাকত না। আমার জন্য আজকে এত বড় পৃথিবীটা একটা আবাসস্থল হতো না।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মানুষ যখন কর্ম বিশ্বাসী হয়, তার জন্য একটি দরজা বন্দ হলে, বহু দরজা খুলে যায়। কর্মপ্রেমী কোনো মানুষকে একটি সমাজের অব‍্যবস্থাপনা রুখে দিতে পারে না। আমি যখন ইউরোপ-আমেরিকায় কিংবা প্রাচ্যের দেশগুলোতে কোনো আবেদন করি, কেউ আমার ধর্ম জিজ্ঞেস করেন না। আমার ভাষা, আমার বাবা-মায়ের পরিচয়, আমার বংশগত ঐতিহ্য, আমার জাত ও বর্ণ কেউই জিজ্ঞেস করেন না। তারা শুধু জানতে চান আমি কী কাজ করেছি। কীসে আমার দক্ষতা আছে। আমি কী করতে আগ্রহী ও কী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ! আমার জন্য কোথাও কোনো কোটা নেই কিংবা কোনো কোটাধারীর জন্য আমাকে ওয়েটিং লিস্টে রাখা হয়নি। উন্নত দেশগুলো মানুষের জন্মসূত্রকে গুরুত্ব দেয় না। কর্মই সেখানে পূজ‍্য! এ জন্যই তারা উন্নত।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে শেখেনি। মেধাবীরা এখনো সেখানে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক বিবেচনা, কোটা ইত্যাদির জাঁতাকলে মেধাবীরা ছুটছে দিগ্‌বিদিক। আমাদের এখনো কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। এখনো কোনো কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেই। সমাজের পশ্চাৎপদ এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে তুলে আনার জন্য কোটার প্রয়োজন আছে। কিন্তু কোটা ব্যবস্থার জন্য থাকতে হয় সুস্পষ্ট নীতি। নির্দিষ্ট একটা মেয়াদ। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মানুষদের তুলে আনতে সুশিক্ষা দিতে হয়। সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে যোগ্য করে তুলতে হয়। যোগ্যের লড়াইয়ে কোনো কোটা রাখা যায় না। যেখানে মেধা অপরিহার্য সেখানে কোটা ভিত্তিক নিয়োগ হলো সমগ্র জাতির জন্য অমঙ্গলজনক। ক্ষতিকর! তা ছাড়া সকল চাকরিতে কোটা রাখা যায় না। কোটাভিত্তিক একজন কেরানি নিয়োগ দেওয়া যায়, শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা গবেষক নিয়োগ দেওয়া যায় না। একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যায় না। কারণ সমাজে সবার কাজের ভূমিকা থাকলেও, সবার কাজের ইমপ্যাক্ট সমান নয়। অপরিকল্পিত কোটার কারণে যদি একজন মেধাবীও বঞ্চিত হয়, তাহলে পুরু সমাজই বঞ্চিত হয়।
জেলা কোটা, পোষ্য কোটা, মাইনরিটি কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা এমন বহু কোটার শিকার হচ্ছে দেশের অসংখ্য মেধাবী ছেলেমেয়ে। আমি যে কুমিল্লা জেলায় জন্মেছিলাম, তাতে আমার হাত নেই। আমি যে কোনো সরকারি চাকরিজীবীর সন্তান (পোষ্য) নই, সেটাতে আমার হাত নেই। আমি যে কোনো মাইনরিটি গ্রুপে জন্ম নিইনি, সেখানে আমার হাত নেই। আমি যে কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নই, সেখানেও আমার হাত নেই। যেখানে মানুষকে শুধু জন্মসূত্র ধরে বঞ্চিত হতে হয়, সেখানে প্রকৃতির অভিশাপ নেমে আসে। জন্মকে যখন কর্ম থেকে বড় করে দেখা হয়, সেখানে কর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা কমতে থাকে। কর্মস্পৃহ মানুষের সংখ্যা হ্রাস পায়। সমাজের নেট প্রোডাকটিভিটি কমে যায়!
কোটা নাকি মেধা? জন্ম নাকি কর্ম?-এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই!

ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>