হাহাকারের বাংলাদেশ

গৃহস্থালি ও কারখানা বর্জ্য সরাসরি গিয়ে মিশছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম, ১১ মার্চ। ছবি: সৌরভ দাশ
গৃহস্থালি ও কারখানা বর্জ্য সরাসরি গিয়ে মিশছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম, ১১ মার্চ। ছবি: সৌরভ দাশ

একটা বয়স ছিল, যা দেখতাম তাতেই মুগ্ধ হতাম। হয়তো তখন বয়সটাই ছিল মুগ্ধতার। সদ্য বিবাহিতা তরুণীরা যা দেখে, তাতেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা লাভ করে। মনে আছে, জীবনে প্রথমবার যখন বিদেশে গিয়েছিলাম, পথচারীদের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি রাস্তার আগাছা-পাথরের ছবিও অতি আগ্রহ ভরে তুলছিলাম।

কিন্তু এখন ব্যাপারটা অনেকটাই উল্টো হয়ে গিয়েছে। কোনো সুন্দর জায়গায় গেলে, বুকের ভেতরে কোথায় যেন নিজের দেশের জন্য একটা অব্যক্ত বেদনা ব্যথার মতো বাজতে থাকে। ইউরোপের দেশে গেলে এই কষ্ট হয় না, কারণ সেটা তো অন্য পৃথিবীর মতো। তবে মালয়েশিয়াতে এসে শুধু বারবার মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের কত কাছের একটি দেশ, আজ কোথায় পৌঁছে গেছে।
একই রকম জল হাওয়া, পরিবেশ হওয়ার পরেও দুই দেশের কত আসমান জমিন ফারাক। এরাও তো অন্যদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, নতুন করে একটা দেশ গড়েছে।
বাঙালিরা এসব দেখে বলবে, এদের মাহাথির মোহাম্মদের মতো একজন নেতা ছিল, তাই এত উন্নত হয়েছে। কিন্তু আমি বলব, কোনো নেতা বা সরকার কখনোই একা কিছু করতে পারবে না যদি না দেশের মানুষেরও পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও ন্যায়নীতি বোধ না থাকে। আমাদের দেশের মানুষের ভেতর স্বার্থপরতাটা মাত্রাতিরিক্ত বেশি। সবাই শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবেন। আর যে জাতি যেমন তারা তো তেমন নেতা–নেত্রীই পাবেন!
পৃথিবীর কোনো দেশই পুরোপুরি দুর্নীতি মুক্ত নয়, মালয়েশিয়াও তেমনি। কিন্তু এদের ভেতর দেশের জন্য কাজ করার সদিচ্ছা আছে। এদের মাঝে অদ্ভুত কিছু সততা ভদ্রতা এখনো বিলুপ্ত হয়নি। যা আমাদের দেশে কল্পনাও করা যাবে না।
যেমন এখানে মানুষ ওজনে কম দিয়ে অন্যকে ঠকানোর ব্যাপারটা এখনো শিখে উঠতে পারেনি। অনেক সুপারস্টোরে বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ঢুকে যেতে পারবেন। বাংলাদেশের মতো সব জায়গায় ঢোকার আগে নিজের ব্যাগ গার্ডের কাছে জমা রেখে যেতে হবে না। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে, তাদের বিল না দিয়ে বের হয়ে গেলেও মনে হয় কেউ খেয়াল করবেন না। কারণ এমন কাজ এখানে কেউ করবেন না!
প্রথম প্রথম স্বভাবজাত এই স্বাভাবিক বিষয়গুলোও আমার বাঙালি চোখে অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লেগেছে। শুধু মনে হতো, এরা এত বোকা কেন? আসলে তারা বোকা নয়, বরং ভদ্র। যেই ভদ্রতার মতো সাধারণ বিষয়ও আমার মতো বাঙালিরা ভুলে গিয়েছি ধীরে ধীরে।
এ দেশে মানুষের মতো এদের সরকারও চেষ্টা করে দেশের উন্নতি করতে। এই ব্যাপারটাও আমার অবাক লাগে। যেমন এত মজবুত করে এরা রাস্তাঘাট বানায় কেন? তাহলে তো কিছুদিন পর পর রাস্তা ভাঙবে না। রাস্তা বানানোর নামে একদল লোক কোটিপতিও হতে পারবে না। কী বোকা এরা!
Apart of joking, আসলেই এ দেশের রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার এত মজবুত করে বানানো হয়, যেন যুগের পর যুগ এসব অটুট থাকে। যেকোনো দেশের উন্নতির বিকেন্দ্রীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের একটি হচ্ছে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উন্নতি করা। শুধুমাত্র রাস্তাঘাট প্রশস্ত ও বড় থাকার ফলেই কুয়ালালামপুর ছাড়াও মালয়েশিয়ার দূরবর্তী অঞ্চলগুলোও যথেষ্ট উন্নত। একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং প্রায় সব জায়গাতেই মেইনটেন করা হয়।

নাগরিক অসচেতনতার কারণে হুমকির মুখে বুড়িগঙ্গা। নদীতে আবর্জনা। ছবিটি শ্যামবাজার থেকে সম্প্রতি তোলা। ছবি: আবদুস সালাম
নাগরিক অসচেতনতার কারণে হুমকির মুখে বুড়িগঙ্গা। নদীতে আবর্জনা। ছবিটি শ্যামবাজার থেকে সম্প্রতি তোলা। ছবি: আবদুস সালাম

এখানে যেমন গাড়ি নিয়ে বের হয়ে নির্দ্বিধায় প্রায় চার–পাঁচ শ কিলোমিটার (ঢাকা-চট্টগ্রামে দূরত্বের চেয়ে বেশি) ড্রাইভ করে, তেমন ক্লান্ত না হয়েই দূরের শহর বা পাহাড় পর্বতে ডে ট্রিপ দেওয়া যায়। অর্থাৎ দিনে গিয়ে দিনে ফেরত আসা যায়। অথচ বাংলাদেশে ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতেই দৈনিক জীবনী শক্তি অর্ধেক ফুরিয়ে যায়।
বাংলাদেশই মনে হয় বিশ্বের একমাত্র দেশ, যাদের পথঘাট ওয়ান টাইম ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। যেমন ঈদের মৌসুমে রাস্তা এমনভাবে মেরামত করা হয়, যেন ঈদের ছুটি শেষ হতে না হতেই সেই রাস্তা আবারও খানাখন্দে ভরপুর হয়ে যায়। অবশ্য এতে নিশ্চয় নির্দিষ্ট কোনো মহলের লাভ হয়, নতুবা স্বল্পকালীন মেরামতের এই ঐতিহ্য কীভাবে সৃষ্টি হলো!
উচ্চপর্যায়ের লোকেদের নিয়ে তো অনেক বললাম, এবার শেকড়ের সমস্যায় আসি। প্রথমে যেমনটা বললাম, যারা যেমন তারা তেমন লোকদের অধীনেই থাকে। আমরা জাতিগতভাবে প্রতিটা মানুষ ভয়াবহ আত্মকেন্দ্রিক। আমরা নিজের সুবিধা ছাড়া এক পাও নড়ি না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে, অনেক সময় বাবা–মায়ের দায়িত্বটাও নিতে ভুলে যাই। কারণ তখন তো আর তাদের দরকার নেই আমাদের।
বর্তমান শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন আপাতত একটি চক্রেই ঘুরপাক খায়। তা হলো, একটি ফ্ল্যাট, গাড়ি, বছর শেষে বিদেশে ট্রিপ দেওয়া, ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে পড়ানো ও পরবর্তীতে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া। ব্যাস এই পাকচক্রে পড়েই বাঙালির জীবন নিধন হয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য আমাদের কী দোষ? শৈশব থেকে শিখে আসছি, পড়ালেখা করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। অর্থাৎ পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত ঐশ্বর্যের বৃদ্ধি সাধন করা। কখনো তো শেখানো হয়নি, পড়াশোনা করে যে মানুষ হয় সে কিংবা পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান অর্জন করা! তাই আমাদের যেমন শেখানো হয়েছে আমরা তেমন আচরণই করছি। (যা হোক পচে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লম্বা আলোচনায় আরেকদিন যাব।)
আমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছি যে, আমাদের ঘরের ভেতরটা সুন্দর রাখতে, নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াতে আর শুধুমাত্র নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই এত ব্যস্ত যে, আশপাশের কারও জন্য আর ভাবি না। নিজের ঘর পরিষ্কার রাখি, কিন্তু সেই ঘরের ময়লাই গেটের সামনে নির্দ্বিধায় ফেলে দিই। বাসার সামনের রাস্তাটাও পরিষ্কার করি না। রাস্তা খানাখন্দে ভরে গেলেও এলাকাবাসী মিলে চাঁদা তুলে, কিছু ইট সুরকি কিনে নিজ দায়িত্বে চলার পথটাকে অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক করি না।
‘এখানে ময়লা ফেলুন’ লেখা সাইনবোর্ডের সামনে ছাড়া যত্রতত্র আবর্জনা ফেলাতেই আমাদের আনন্দ। বৃষ্টির মাঝে যখন পানি উঠে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তখন আমরা উচ্চস্বরে সরকারের শাপশাপান্ত করি। কিন্তু ড্রেনে উপচে পড়া নিজের ফেলা চিপসের প্যাকেটগুলোর দৃশ্য অতি সংগোপনে এড়িয়ে যাই।
পরীক্ষায় নিজের সন্তানের জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্ন খুঁজতে হন্যে হয়ে যাই, নিজের খেতের সবজিতে বিষ মেশাই, মাংস বিক্রয়ের সময় পাল্লায় পাথর লাগিয়ে ওজনে জোচ্চুরি করি, ছোটখাট কাজের জন্য ঘুষ নিই, নিজের স্বার্থ না থাকলে এক পাও নড়ি না, কারও জন্য কিছু করার আগে বা উপহার দেওয়ার আগে চিন্তা করি, বিনিময়ে কতটুকু পাব। এভাবে উদাহরণ দিতে গেলে পাহাড়সম উদাহরণ জমে যাবে।
তাই সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। আমরা নিজেরা যত দিন ব্যক্তিগতভাবে উন্নত মানসিকতার হব না, তত দিন সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নতির জন্য হা–পিত্যেশ করে লাভ হবে না। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমাদের নিজেদের স্বভাব-চরিত্র শোধরানো, পারিবারিক পর্যায় থেকে সন্তানদের ন্যায়নীতির চর্চা শেখানো, ঘরের আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা, জীবনের প্রতিটি কাজে সৎ থাকার চেষ্টা করা ও আওতার ভেতরের মানুষদের সৎ উপদেশ দেওয়া।
ভুলে গেলে চলবে না, বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে যেমন অতল সাগর তৈরি হয়, তেমনি অনেক গুলো ‘আমি’ নিয়েই সমাজ গঠিত হয়। আর শেষ বিচারের দিন আমার করমের জবাবদিহিতা আমাকেই দিতে হবে। তখন দেশ খারাপ, সমাজ খারাপ বলে কিন্তু পার পাব না।

হাসনীন চৌধুরী: মালয়েশিয়া প্রবাসী।