পরবাসী অন্তরের আনন্দ-বেদনার কাব্য

লেখিকা
লেখিকা

বিশটা বছর পরবাসী। কম তো নয়! বিষয়টিতে আবার ‘কাব্য’ শব্দটি আছে। কাব্য কী কখনো ছোট হয়? এখানে সরল মনে ডাল-চালের খিচুড়ি বানাতে বসলেও সুজি, মুড়ি, পাঁচফোড়ন যোগ হয়ে আপনাআপনিই এক অদ্ভুত ঘোঁট পাকানো বস্তু তৈরি হবে। যা আর গিলতে হবে না, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে হবে। তবু ইচ্ছে হলো ছোট্ট করে একটু সত্য বয়ান জানাই।

মাত্রই নির্মল আনন্দ শেষে দেশ থেকে ফিরে বিরস মনে দিন কাটছে। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এক শ ভাগ প্রবাসীর প্রধান কষ্ট পরিবার-আত্মীয় থেকে দূরে থাকা। হালের তরুণ সমাজের কেউ কেউ যদিও ব্যাপারটিকে আপাতত গুরুত্ব দিচ্ছেন না জানি। ভাবেন শান্তির জায়গায় এসে বেঁচে গেছি। আমার মতো দুই দশক কাটুক, বেঁচে থাকলে সাক্ষাৎকার নেব জানতে—‘কত ধানে কত চাল’ গুনল।
নানা বয়সে নানা কারণেই মানুষ প্রবাসী হয় বা হতে বাধ্য হয়। অমোঘ সত্যটা হচ্ছে মানুষ যত কারণেই প্রবাসী হন না কেন অর্থ ও নিরাপত্তা বিষয় দুটি সবার জন্যই প্রধান কারণ। এটা মানুষ স্বীকার করলেও সত্য, এড়িয়ে গেলেও সত্য। তো যা বলছিলাম, এই দিল্লি কা লাড্ডু প্রবাস জীবনে পা দেওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে আসা ৩০ কেজি লাগেজ নিয়েই প্রথম শুরু করে জীবনযুদ্ধ। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, স্বজন ছাড়া হয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্নের পথে পা বাড়ায়। হাঁটে না, দৌড়ায়। মাঝে মাঝে আবার যোগ হয় প্রতিযোগিতা। ফিরে তাকানোর সময় নেই, নিজেকে সময় দেওয়ার সময় কই? নিজেকে তৈরি করতে আর ছুটতে ছুটতে বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। মধ্যবয়স পেরিয়ে গেলে একদিন থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ হয়। হিসাব কষতে বসে কী করলাম, কী পেলাম, কী পেলাম না। প্রবাসে না এলে কী করতে পারতাম, এসে এত ত্যাগের বিনিময়ে যা পেয়েছি, তা দেশে থাকলে যা করতাম তার চেয়ে কম না বেশি। ইত্যাদি ইত্যাদি...।
সে যাই হোক, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা সব মানুষেরই জীবনের অংশ। সে স্বদেশেই থাকুক বা বিদেশে। তবে আমি বলব, এই অনুভূতিগুলো একটু ভিন্ন রূপে আসে প্রবাসীদের জীবনে। বাংলাদেশের জীবন ব্যবস্থায় বেশির ভাগ মানুষ আনন্দ করতে পারছেন তাদের নিজেদের মতো করে। কিন্তু আমাদের আনন্দ করতে একটি নির্দিষ্ট সরল রেখায় হাঁটতে হয়। একটু বেশিই নিয়মতান্ত্রিক গতিতে আগানো যাকে বলে। ৫–৬টা রোবোটিক কার্যদিবস কাটিয়ে ছুটির দিনে আলো ঝলমল পোশাকে দাওয়াত খাওয়া বা পরিবার–পরিজন নিয়ে একটু ইতিউতি ঘুরতে যাওয়া, ব্যাস।
আজকাল তো আবার ফেসবুকের বদৌলতে আমাদের আনন্দ পরিমাপটা সর্বজনীন হয় সহজেই। দেশবাসী দেখে আমরা বিদেশে কতই না আনন্দে দিন কাটাই। সত্যিই তো। আনন্দ হয় তখন যখন যে অর্থের জন্য প্রবাসী হওয়া, সেই অর্থ দিয়ে পরিবার পরিজনের প্রয়োজন মেটানোর পর তাদের মুখে হাসি দেখলে। বা কিছু বছরের তিলে তিলে জমানো সঞ্চয় দিয়ে দেশে শেকড়ের একটু পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হলে আনন্দটা অশ্রু হয়ে ঝরে দেয় সুখ।
এখানে বেদনা কোথায়? আছে। দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না তখন। যখন হঠাৎ কোনো সুশীল, বিদ্বান সমাজসেবককে টিভির পর্দায় বলতে শুনি সকল স্থায়ী প্রবাসীদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট রাখার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হোক, কারণ তারা দেশের টাকায় লেখাপড়া করে বিদেশে গিয়ে সুখী জীবন কাটায়, দেশের কোনো উপকারে আসে না। তারা যখন বিদেশে অনুষ্ঠান করতে আসেন (শনি-রোববারেই তো হয়) তখন দেখেন সুন্দর সাজসজ্জায় তাকে ঘিরে আনন্দ করছি! তারা কখনো দেখেন না আমাদের সপ্তাহের কর্মদিবসগুলো কীভাবে যায়। এমনটা ভাবা দোষের নয়। কিন্তু অমন কথায় প্রতিবাদের আগেই অভিমানে চোখ ভিজে ওঠে—কোন টাকায় তবে দেশের মুদ্রা সমতা স্থিতিশীল থাকছে?
লাখ লাখ প্রবাসী যে তাদের গরিব আত্মীয় বা দুস্থদের দেখে রাখছেন, সেটা কী দেশকে সাহায্য করা নয়? আবার যে প্রবাসীরা উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে গবেষণা করে পৃথিবী চমকে দিচ্ছেন নতুন কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে, তারা দেশে থাকলে কী দেশ সমানভাবে সুযোগ করে দিত এমন কাজের পরিবেশ? আমরা সবাই উত্তর জানি, সব ক্ষেত্রে নয়। প্রবাসীরা এই সম্মান নিজে নেওয়ার আগে দেশকে দেন। সগর্বে নামের আগে পরিচয় দেন বাংলাদেশি হিসেবে। ভাববেন না খুব সহজে স্বীকৃতি উড়ে এসে হাতে ধরা দেয়। উন্নত জাতির কাছে নিজেদের চামড়ার রং বাজি রেখে ঢেঁকি কল খেলতে খেলতে অধিক যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে ছিনিয়ে আনতে হয়।
যাকগে, দুঃখের ঝুড়ির ঝাপিটা না হয় এয়ার টাইট হয়ে বন্ধই থাক। এবার বলি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের জীবনগাথা।
জীবন মধুময় মনে হয় যখন একটা বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা স্কুল ব্যাগে কেবল টিফিন বক্স ভরে স্কুলে যায়। যাবতীয় পড়ার চাপ ওখানেই শেষ করে আসে। স্বস্তির চাপা হাসি দিই যখন স্কুল বন্ধের সময় ছেলেমেয়েরা মুখ ভার করে বলে, স্কুল বন্ধ কেন? It’s so boring staying at home!’ দিন-রাত ছেলেমেয়েদের জীবন গড়ার চিন্তায় নাজেহাল হতে হয় না আমাদের। লাখ লাখ টাকা খরচ না করেও তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা অপার। এক কথায় আমাদের সুনজরে থেকে তারা জীবনকে উপলব্ধি করে স্বশিক্ষায় বেড়ে ওঠে। তারা কর্মজীবনে যা হতে চায় পর্যাপ্ত অনুশীলনের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হয়। আমরা আশাবাদী এই প্রজন্মও কোনো না কোনোভাবে আমাদের দেশের জন্য কাজে আসছে বা ভবিষ্যতেও আসবে। কারণ আমরা মা-বাবারা পরম যত্নে শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ শেখাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
এবার কিছুক্ষণ ত্যানা প্যাচাই সামাজিক জীবনের যোগ-বিয়োগ নিয়ে। যেহেতু বেশির ভাগ প্রবাসীই দেশে তাদের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন রেখে বিদেশে থাকেন, তার মানে তাদের সবারই অন্তর খুঁজে ফেরে একটু নির্ভরতা, আস্থা বা স্নেহ ভালোবাসা। স্বভাবতই তারা তখন সমগোত্রীয় মানুষকেই বেশি বিশ্বাস করে কাছে যান। তার শূন্যস্থানটা পূরণের টানে। নিজেকে উজাড় করে সাহায্যের হাত বাড়ান। কেউ কেউ সেটা সুযোগ ভেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রতিদান দেন না। তারা আত্মীয় পরিজনের সমান স্থানে বসাতে হয়তো ঠিক বিশ্বাস পান না, সময় লাগে। তত দিনে মানুষ আঘাত পেতে পেতে মনকে নিজের মতো শক্ত করে আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর হয়ে যায়। এবার শুরু হয় অলিখিত প্রতিযোগিতা। হোক সে বৈষয়িক বিষয়, পোশাক, ফার্নিচার, টিভি, গাড়ি বা স্বপ্নের বাড়ি। অস্থির ছুটোছুটি। যদিও বলছি, এই প্রতিযোগিতা আমরা অন্যের সঙ্গে করি কিন্তু আমার পর্যালোচন হলো আসলে এটা আমরা নিজের সঙ্গে নিজেই করি। সুখে থাকলে ভূতে কিলায় দশা আর কী!
এমন মনস্তত্ত্বের বাজী খেলায় আমাদের ছেলেমেয়েরাও বলির পাঠা হয় বৈকি। কার ছেলেমেয়ে কোথায় চান্স পেল, আমারটাকে তেমন বলার মতো জায়গায় যেতেই হবে। তাই ঝাঁপিয়ে পড়া কী কী করলে হবে সিদ্ধি লাভ। রেহাই নেই গোলাম হোসেন। বাছারা চাও বা না চাও পিতা-মাতার তালে ঘোড় দৌড়ে বলি হও। হবে নাই বা কেন? এক জীবনে কার জন্য এত স্বপ্ন-আশা নিয়ে ভাসা?
সবকিছুতে টপই যদি না হব, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু যদি না–ই করতে পারব তো পরবাসী হলাম কেন? যুক্তিযুক্ত কথা বটে। চলুক তবে আমাদের এই টক-মিষ্টি-ঝালের আচার বানানো আর বয়ামে ভরা।
জীবন তো চলমান...এর দুঃখ-আনন্দের হিসাব লিখে কখনো শেষ করা যাবে না। তাই দিন শেষে ভাবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন উদাস করা পঙ্‌ক্তি কটাই সত্যি—
‘হে পাখি চলেছ ছাড়ি
তব এ পারের বাসা
ও পারে দিয়েছ পাড়ি
কোন্ সে নীড়ের আশা?’

নূর তুলি: ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।