সাস্কাতুনে বাসন্তীর সাজে এক টুকরো বাংলাদেশ

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী নৃত্য শিল্পীরা
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী নৃত্য শিল্পীরা

কানাডার সাস্কাচেওয়ান প্রদেশের সাস্কাতুনে উদ্‌যাপিত হলো বর্ণাঢ্য বসন্তবরণ ও পিঠা উৎসব। প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিয়ে প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত কিছুদিন আগেই। ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক বসন্তের এই আমেজে শুধু কী প্রকৃতি, সেই সঙ্গে রাঙিয়ে আছে সবার মনও। চিরচেনা প্রচণ্ড ঠান্ডার এই শহরের রূপ এই মুহূর্তে বসন্তের আবির্ভাবে হঠাৎ পাল্টে না গেলেও এখানে বসবাসরত প্রায় চার হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি বাঙালির মন কিছুদিন আগে থেকেই বসন্তের রঙে রাঙিয়ে আছে। শুধুই ছিল আনুষ্ঠানিকতার বাকি। চারদিকে শুধুই শুভ্র বরফের সমাহার, তাতে কী। মনকে বসন্তের রঙে রাঙাতে বাধা দেবে এমন শক্তি কার? আর তাই সাস্কাতুনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা উদ্‌যাপন করলেন জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে বসন্তবরণ ও পিঠা উৎসব ২০১৮। 

কণ্ঠশিল্পী মুনমুন ও অন্যান্য
কণ্ঠশিল্পী মুনমুন ও অন্যান্য

১৩ মার্চ শনিবার স্থানীয় বেথলেহেম ক্যাথলিক স্কুলের সুবিশাল অডিটোরিয়ামে নেমেছে বাসন্তী রঙের ঢল। ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করতে সাস্কাতুনে বসবাসরত বাঙালিরা বসন্তের সাজে সমবেত হতে শুরু করেন বিকেল থেকেই। সাস্কাতুনে এবারই প্রথম বসন্তবরণ ও পিঠা মেলার এমন বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়। বিশাল অডিটোরিয়ামের ভেতরে চারধারে ছিল বিভিন্ন পিঠা ও রকমারি বাংলাদেশি পণ্যের স্টল। মেলায় সর্বমোট ১৮টি স্টল ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠার প্রদর্শনী ও সুলভ মূল্যে সেই সব পিঠা বিক্রি করা হয়। আয়োজকেরা প্রত্যেকটি স্টলের একটি করে ভিন্নধর্মী ও কাব্যিক নাম দেন। নামগুলোর মধ্যে উজান ভাটি, ফাগুন হাওয়া, হিজল বন, শিশির ভেজা, বর্ষা মুখর, কদম ফুল, পুবাল হাওয়া, কাজল দিঘি, পরান প্রিয়, হিয়ার মাঝে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সারি সারি পিঠার দোকান, বাংলাদেশি পসরার সমাহার সবাইকে অনবদ্য এক বাংলাদেশি মেলার ভিন্নধর্মী অনুভূতি দেয়।

উৎসবে সমাগত দর্শকদের একাংশ
উৎসবে সমাগত দর্শকদের একাংশ

উন্মুক্ত অডিটোরিয়ামের মঞ্চটিকে বসন্তবরণের বিশেষ সজ্জায় সাজানো হয়। এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেন মির্জা গালিব ও তার স্ত্রী হোসনেয়ারা খানম আঁখি। তাঁরা খুব যত্ন সহকারে সুন্দরভাবে মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ড সাজিয়ে দেন। এ ছাড়াও প্রতিটি স্টলকেও বিশেষভাবে সাজানো। স্টল ও মঞ্চের অন্যান্য অংশ সাজানোর ক্ষেত্রে ফাতিমা শাহিন ও কবির বকুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পুরো জায়গাটি অপরূপ এক রূপ লাভ করে। মনে হয়েছে বাসন্তীর সাজে সাস্কাতুনে এক টুকরো ক্ষুদ্র বাংলাদেশ।

ফ্যাশন শোয়ে অংশগ্রহণকারীরা
ফ্যাশন শোয়ে অংশগ্রহণকারীরা

বিকেল চারটায় হলের প্রবেশদ্বার উন্মোচন করা হয়। দলে দলে বাসন্তী সাজে সজ্জিত বাংলাদেশি নারী-পুরুষেরা সমবেত হতে শুরু করেন। তারা দলে দলে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন স্বাদের পিঠা উপভোগ করেন। যেসব পিঠা মেলায় উপস্থাপন করা হয় তার মধ্যে পান্তোয়া পিঠা, চিতই পিঠা, জামাই পিঠা, ঝিলমিল পিঠা, ঝুনা পুলি, দুধ ঝুলি পিঠা, নকশি পিঠা, নারিকেলের পুলি পিঠা, পাকন পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, বিন্নি পুলি, কোলা পিঠা, ভাপা পুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, মালাই পিঠা, মনোলোভা পিঠা, রস চিতই পিঠা, রসফুল পিঠা, শাহি পিঠা ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য খাবারের মধ্যে ছিল বিরিয়ানি, শাহি হালিম, ফুচকা, ঝালমুড়ি, শিঙারা, সমুচা, ডালপুরি, ভেজিটেবল রোল, চটপটি, ছোলা, পেঁয়াজি ইত্যাদি। মিষ্টির মধ্যে জিলাপি, রসগোল্লা, সন্দেশ, রস কদম, রসমালাই, কালোজাম, চমচম ইত্যাদি। এর পাশাপাশি চা ও কফির স্টলও ছিল।
সবাই বিভিন্ন রকম খাবার খাচ্ছেন, এর মধ্যেই শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নুরুল হুদা পলাশের তত্ত্বাবধানে রহমত মুনশি, খালেদা পারভিন লাভলি, ফাহমিদ ইসলাম, শারমিন সুমি ও আফসানা অমির অনবদ্য সঞ্চালনায় স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ক্যালগেরি থেকে আগত মুনমুন আহমেদের সংগীত পরিবেশনা।

আয়োজকদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন
আয়োজকদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন

বাংলাদেশ ও কানাডার জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় পরিবেশিত সাংস্কৃতিক পর্বটি ছিল বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সাজানো। অনুষ্ঠানে রহমত মুনশির ধারা বর্ণনায় দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন সংগীতশিল্পী ফাহমিদা হোসেন তন্দ্রা, যূথী, পুতুল, রিফাত, লাভলি ও রিজওয়ানা। সংগীত পরিচালনায় ও তবলায় ছিলেন মুশারফ হোসেন। মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশন করেন লামিসা, মাইমুনা, সিয়াম, অর্থী, অর্পা, তাসনুভা ও ঈশিতা। ত্রিশার কোরিওগ্রাফিতে অনবদ্য একটি ফ্যাশন শো পরিবেশিত হয়। ফ্যাশন শোতে যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন অনন্যা, অমিয়া, আনাস, আফিয়া, টুম্পা, সারা, ফারিয়া, মাইমুনা, মাহির, রাইয়ান, রাহা, ত্রিশা, লাভলি, লামিসা, সুকন্যা ও সিয়াম। অনুষ্ঠানে একক সংগীত পরিবেশন করেন শান্ত, রাইয়ান, আশরাফুল আলম, রিফাত, আয়েশা খান, যূথী ও তন্দ্রা।

সারি সারি পিঠা ও বাংলাদেশি সামগ্রীর পসরা
সারি সারি পিঠা ও বাংলাদেশি সামগ্রীর পসরা

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল পুথি পাঠ। নুরুল হুদা পলাশের পরিচালনায় সংগৃহীত পুথি ‘বেদের মেয়ে জরিনা’ পরিবেশিত হয়। পুথি পাঠ করেন কবির বকুল, আশরাফুল আলম ও মুশারফ হোসেন। দর্শকদের অংশগ্রহণে পিঠার ওপরে একটি মজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিজয়ীদেরসহ অংশগ্রহণকারী সকলকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার আশিক আহমেদ, সুমি ও নিরু।
এরপরে মঞ্চে আসেন অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ক্যালগেরিতে বসবাসরত মুনমুন আহমেদ। তিনি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে প্রায় ১০টির মতো বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় মেলোডিয়াস গান পরিবেশন করেন। সমবেত সকলে মুনমুনের সুমধুর কণ্ঠের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

দলীয় সংগীত পরিবেশনা
দলীয় সংগীত পরিবেশনা

অনুষ্ঠানে সমাগতদের বিনা মূল্যে র‍্যাফেল ড্রর কুপন প্রদান করা হয়। লটারির মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রথম পুরস্কার ছিল একটি বারবিকিউ মেশিন যা খন্দকার রফিকুল ইসলাম ল্যারির সৌজন্যে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার ছিল ন্যাচারাল ফ্রেশ মিট অ্যান্ড গ্রোসারির স্বত্বাধিকারী পিয়ার মোহাম্মদের সৌজন্যে ইলিশ মাছ।
এই মনোমুগ্ধকর বসন্তবরণ ও পিঠা মেলার আয়োজনে আর্থিক ও সার্বিক সহযোগিতা করে স্থানীয় হোমস বাই এনস এবং ব্লু বেল।

নুরুল হুদা পলাশ: সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা।