দেখেছিলাম এক ইন্দ্রজিৎ

স্টিফেন হকিং। ছবি: লেখক
স্টিফেন হকিং। ছবি: লেখক

বিশ শতকের শেষ ভাগের শ্রেষ্ঠ কিছু বিজ্ঞানীকে আমি দেখেছি। তাঁদের কথা শুনেছি। তাঁদের ছবি তুলেছি। তাঁদের হাতের স্পর্শে শিহরিত হয়েছি। তাঁদের কাছে অটোগ্রাফ চাইতে গিয়ে শিশুর মতো হয়ে গেছি। তাঁদের স্বপ্নের উচ্চতা আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। প্রবলভাবে আন্দোলিত করেছে। সেসব বিজ্ঞানীদের একজন স্টিফেন হকিং। তাঁর মতো প্রাণশক্তির কাউকে দেখিনি। রোগ তাঁকে কাবু করতে পারেনি। মৃত্যু-ভয় তাঁকে গ্রাস করেনি। মৃত্যুর প্রহর গুনে তাঁর সময় কাটেনি। তাঁর মগজের নিউরনে ছিল ব্ল্যাকহোল। তাঁর কল্পলোক জুড়ে ছিল নক্ষত্রপুঞ্জের আলোকধারা। যে দূর থেকে আলোক এসে পৌঁছায় না, সেই দূরে চলে গেছে তাঁর ভাবনা। সেই দূরে চলে গেছে তাঁর কল্পনা শক্তি। তাঁর নায়ক, আইনস্টাইন বলেছিলেন—Imagination is more important than knowledge.

স্টিফেন হকিং ২০১৫ সালে স্টকহোমে এলেন। তিনি লেকচার দেবেন স্টকহোমের সবচেয়ে বড় হলে। সে কথা জানতে পারলাম। আমি তখন স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি শেষ বর্ষে কাজ করছি। সস্ত্রীক তাঁর লেকচার শুনতে গেলাম। হাজারো মেধাবীর ভিড়ে হিমালয়সম প্রাণশক্তি নিয়ে ঢুকলেন তিনি। সবাই দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালিতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি বললেন: Look up at the stars and not down at your feet. Try to make sense of what you see, and wonder about what makes the universe exist. Be curious (পদতলে নয়, নক্ষত্র পানে তাকাও। মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্মিত হও, যা দেখো তা নিয়ে ভাবো। কৌতূহলী হও)।

হকিং দেখিয়েছেন মানুষ মরে তার কল্পনায়। মানুষ মরে তার প্রাণশক্তিতে। মানুষের পরাজয় হয় যখন সে ভাবনায় মৃত। সারা পৃথিবীর তরুণেরা তাঁকে দেখে প্রাণশক্তি পেয়েছে। তাঁকে দেখে উজ্জীবিত হয়েছে। স্তিমিত হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো প্রাণ পেয়েছে তাঁকে দেখে। হকিং দেখিয়েছেন-মানুষ মরে তার কল্পনায়। মানুষ মরে তার প্রাণশক্তিতে। মানুষের পরজিত হয় যখন সে ভাবনায় মৃত। তিনি বলেছেন, If there is life, there is hope.

স্টিফেন হকিং। সংগৃহীত
স্টিফেন হকিং। সংগৃহীত

স্টিফেন হকিং চলে গেছেন। যে মানুষটি চলে যাওয়ার কথা ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, তিনি বেঁচে ছিলেন ছিয়াত্তর বছর। ডাক্তারেরা তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। নিউরো মটোর ডিজিজ তাঁকে গ্রাস করেছিল। তিনি প‍্যারালাইজড হয়ে ছিলেন। কথা বলতে পারতেন না। শরীর নাড়াতে পারতেন না। চেয়ারে বসে জীবন কাটিয়েছেন দশকের পর দশক। অথচ, সেসব কিছুই তাঁকে জগৎজয়ের স্বপ্ন থেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর মগজ দিয়ে তিনি মহাবিশ্বের কথা ভেবেছেন। সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ভেবেছেন। গণিতের সমীকরণে সেসব ভাবনাকে গেঁথে, সভ্যতার জন্য দিয়ে গেছেন প্রশ্ন, উত্তর ও ভাবনার খোরাক।

এই মানুষটি ঘরে বসে থাকতে পারতেন। কাজ-কর্ম ছেড়ে, শুয়ে-বসে জীবন কাটাতে পারতেন। জপমালা হাতে নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে পারতেন। মৃত্যু ভয়ে নিজেকে শপে দিয়ে, ভীতসন্ত্রস্ত হৃদয় নিয়ে থাকতে পারতেন। একজন যাজক সেজে, ধর্ম প্রচার করে বেঁচে থাকতে পারতেন। সাধুর বেশে হতে পারতেন ঠগবাজ! কিন্তু তিনি সেসব কিছুই করেননি। নিজের শরীরের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে তীব্র ভেংচি দিয়ে, এই মহাবিশ্ব নিয়ে ভেবেছেন। দুই চোখ দিয়ে যা দেখা যায় না, তা দেখেছেন। মানুষের ভাবনা যেখানে পৌঁছে না, সেখানে তিনি পৌঁছেছেন। সৃষ্টির ধাঁধাকে নগ্ন করে দেখার প্রচেষ্টায় মগ্ন ছিলেন। প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে কাটিয়েছেন কত প্রহর, কত কাল! জীবন তাঁকে যন্ত্রণা দিলেও, জীবন থেকে তিনি নিতে কার্পণ্য করেননি। আলস্য তাঁর কাছে এসে হাঁটু কম্পনে ধরাশায়ী হয়েছে।

জ্ঞানের সাম্রাজ্যে যিনি একটি অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেটার নাম কসমোলজি। তারুণ্যের মেধা দিয়ে সারা জীবনের বন্দিত্বকে জয় করেছেন। শারীরিক জঙ্গমতাকে জয় করেছেন। এই দুনিয়াতে মানুষ যখন মানুষকে মারছে পাখির মতো, তখন তিনি দেখেছেন নক্ষত্রপুঞ্জের প্রগাঢ় সৌন্দর্য। শুনিয়েছেন, মহাশূন্যের মহা গল্প। মানুষ যখন মানুষের মগজে বিষ্ঠা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তখন তিনি বলেছেন, নক্ষত্রের খই ফোঁটা গগনের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতে। বলেছেন, প্রশ্ন করতে। মানুষ যখন মানুষকে অন্ধকারের দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, হকিং তখন হৃদয়ের সমস্ত বিশালতা দিয়ে আলোকের সন্ধান করেছেন। অসংখ্য তারুণ্যকে সত্য সুন্দরের পথে মুসাফির হওয়ার আহ্বান করেছেন।

পঞ্চাশ বছর ধরে দুরারোগ্য রোগে ভুগেও যিনি জগৎ সৃষ্টির প্রহেলিকা উদ্‌ঘাটন করার ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, তিনি হলেন সত‍্যিকারের মৃত‍্যুঞ্জয়ী। তিনি হলেন সত‍্যিকারের ইন্দ্রজিৎ। তাঁর মৃত্যু নেই। এমন নক্ষত্ররা প্রাণের মিছিল থেকে স্খলিত হয়ে, অন্য গগনের নক্ষত্র হয়ে জ্বলতে থাকতে থাকে বহু কাল।

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>