অনুভবেও বঙ্গবন্ধু

মঞ্চে অতিথিদের সঙ্গে খুদে আঁকিয়েরা
মঞ্চে অতিথিদের সঙ্গে খুদে আঁকিয়েরা

তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি

চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।।
শুরুটা ছিল এমনই। গিজগিজ করছে মানুষ। মূলত শিক্ষার্থীরাই টইটুম্বুর করে রেখেছে স্কুলের বৃহৎ এই মিলনায়তন। দুই সারি মাত্র অতিথি, অভিভাবক বা শিক্ষকদের। তারপর ওরা। এ এক আনন্দের ভুবন।
ওদের কলকাকলিতে মুখরিত পরিবেশ। কোনোভাবেই ওদের থামানো যাচ্ছে না। আর ওদের আনন্দ-উল্লাসে বাধা দেওয়ার প্রশ্নইবা আসছে কেন। আজ যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। তিনি শিশুদের ভালোবাসতেন, আদর করতেন। সে জন্যই আজ দিনটি জাতীয় শিশু দিবস। এ দিনটি একান্তভাবে তাদের।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কেটেছিল পল্লিতে। তাঁর চাঞ্চল্য সবাইকে আকর্ষণ করত। শিশু বয়সে বাড়ির গৃহশিক্ষকের কাছে তাঁর হাতেখড়ি। গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি স্কুল জীবনে শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে গোপালগঞ্জের সীতানাথ একাডেমি, মিশনারি স্কুল ও মাদারীপুর স্কুলে লেখাপড়া করেন।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

সেই বয়সের শিশুরা আজ এই এখানে। বারবার শিক্ষকেরা বলছিলেন চুপচাপ করে বসো তোমরা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বঙ্গবন্ধু কী এই বয়সে শুনেছিলেন কারও কথা? শেষ পর্যন্ত উপায় একটা বের করা হলো। বলা হলো, প্রধান অতিথি যখন হল ঘরে প্রবেশ করবেন তখন তোমরা নিঃশব্দ থাকবে। হ্যাঁ, এই কথায় ওরা রাজি হয়েছিল।
আয়োজনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের একদিন পর। অর্থাৎ ১৮ মার্চ রোববার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুল। সব মহলের মানুষ এসেছিলেন। তবে মূল নায়ক ওরা। ওরাই সেরা। ওরাই ওই দিনের রাজা। আর ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

উপস্থিত ছিলেন দূতাবাস মিনিস্টার কাউন্সেলর ইকবাল হাসান, স্কুলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সদস্য ওমর ফারুক, জনতা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আমিরুল হাসান। আরও ছিলেন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
রাষ্ট্রদূত কলকাকলির এ অনুষ্ঠানে ছোটদের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করলেন। বললেন, বঙ্গবন্ধু বিশাল হৃদয়ের এক মানুষ ছিলেন। সবার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন শিশুদের। সারা জীবন তিনি জনগণের কল্যাণে ব্যাপৃত ছিলেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। একটি জাতিকে স্বাধীন করেছেন। একটি দেশ দিয়েছেন। তিনি উপসংহারে বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান—নিজেই একটি ইতিহাস।
পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি জল্লাদরা কারাবন্দী রেখেছিল বঙ্গবন্ধুকে। কবর খুঁড়েও তারা তাঁকে হত্যা করার সাহস পায়নি। অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকেরা হত্যা করে। ক্ষমতার পালাবদলও ঘটে একই সময়। ঘাতকচক্রের বুলেটে সেদিন ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড। কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই ইতিহাস হয়ে রয়েছেন।

ছোটরা বঙ্গবন্ধুর কথা বলছে
ছোটরা বঙ্গবন্ধুর কথা বলছে

আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সেখানে টুঙ্গিপাড়ার সেই পাঠশালা সেই জনপদ দেখতে পায় শিশুরা। ধারা বিবরণীতে বর্ণনা করা হয় প্রতিটা ভাগ। ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধু খেলাধুলায় খুব আগ্রহী ছিলেন। ওই আগ্রহের সূত্র থেকে গোপালগঞ্জের ফুটবল টিমে অংশ নেন তিনি। গোপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস শেষে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। বেকার হোস্টেলে থাকার সুবাদে সে সময় বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন।
আয়োজনে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আবু তাহের। সেখানে আরও কিছুর সঙ্গে গান ছিল, ছিল নৃত্য। সব মিলে অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে একটি কবিতা।
আলোচনায় অংশ নেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ সংযুক্ত আরব আমিরাত সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল। তিনি বলেন, আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজই সফল একটি দেশ উপহার দিতে পারে। বঙ্গবন্ধু সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সারা দেশ ঘুরেছেন। মতবিনিময় করেছেন। মানুষকে অধিকার সচেতন করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তারই ফল এই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু নিজের সুখ সমৃদ্ধির কথা ভাবেননি। সিংহভাগ সময়ই তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ত্যাগে, উৎসর্গে বর্ণাঢ্য এক জীবন ছিল তাঁর।
সাংস্কৃতিক পর্বে স্কুলের শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ঢেলে দেয়। তারা কবিতা আবৃত্তি করে। কী সুন্দর সে উচ্চারণ! সবুজ-শ্যামল বনভূমি মাঠ নদী তীর বালুচর/ সবখানে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘর।/ তারা সব জায়গায় ক্ষণজন্মা এই পুরুষের অস্তিত্ব অনুভব করে। বঙ্গবন্ধুর অবয়ব, তাঁর হাসিমাখা ভালোবাসার মুখ আচ্ছন্ন করে শিশুদের। তাইতো তারা কবির ভাষায় বলে ওঠে, সোনার দেশের মাঠে মাঠে ফলে/ সোনা ধান রাশিরাশি/ ফসলের হাসি দেখে মনে হয় শেখ মুজিবের হাসি। এ কবিতার বৃন্দ আবৃত্তি করে চতুর্থ শ্রেণির মাহি, সাকিব, সাদিয়া, জাহারা ও মোহসিনা।
তারা নাচে। পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা/ আমার এ দেশ ভাইরে/ ধানের মাঠে ঢেউখেলানো/ এমন কোথাও নাইরে। নুসাইবা, উম্মে হাফসা, জয়নাব নাচে গানের সুরে।
ওরা শাড়ি পরে এসেছে আজ। হাতের চুড়ি, এর সঞ্চালনা ফসলের মাঠে, নদী পাড়ে নিয়ে যায় দর্শককে। তারা গায় গান। ফাইজা, আকলিমা, সুমাইয়া, ইশরা, রীম সুর তোলে দারুণ এক গানে। শিক্ষক শালিনি নন্দন তালিম দিয়ে গড়েছেন তাদের।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন

যদি রাত পোহালে শোনা যেত/ বঙ্গবন্ধু মরে নাই। বাংলার প্রকৃতি তুলে আনে ওরা। মনে হয় নিসর্গের আকুলতাও তাই। বঙ্গবন্ধুর মুখ ভেসে ওঠে। ছোটরা আবৃত্তি, নাচ আর গানে কাটায় গোটা প্রহর।
এর আগে দিনটি উপলক্ষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এদিন দেওয়া হয় সে পুরস্কার। প্রধান অতিথি অন্যান্যদের নিয়ে মঞ্চ থেকে পুরস্কার বিতরণ করেন।
ওদের সঙ্গে কথা হয়। নুসাইবা বলে, আনন্দের দিন আনন্দেই কাটাচ্ছি। মুখে ওর হাসি। পাইজা বলে, স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। জাহারা জান্নাত দাঁড়ানো ছিল পাশে। কথাটি তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সে যোগ করে, এ জন্যই দিনটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। আকলিমা তাবাসসুম রিবা বলে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কীই না আনন্দ হতো!
বঙ্গবন্ধুকে কেউ ভুলতে পারে না। তাঁরই উপস্থিতি সব জায়গায়। চলায় বলায় তাইতো তাঁরই কথা। তাদের অস্তিত্বে বঙ্গবন্ধু, অনুভবেও বঙ্গবন্ধু।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।