তিতাস পাড়ের গল্প

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমাকে কেউ যদি মন থেকে ভালোবাসত, বাড়ি ফেরার টিকিটটুকু আমি তার উদ্দেশেই কাটতাম। ট্রানজিটের অবকাশে কিনে নিতাম জীবনের জন্য খুব প্রয়োজনীয় নয় অথচ মন ভালো করে দেয় এমন কিছু গিফট, এই ধরো রুপা দিয়ে মোড়ানো হাতের রাখি—কিছু রংচঙে ড্রেস, একটি দুটি পারফিউম ইত্যাদি আর ভালোবাসার মানুষের কাছে চেয়ে নেব কিছু বেলি ফুল, আড়ংয়ে ঝোলানো বউ বসন্তের মনকাড়া নকশা, হলুদের ওপর সবুজ রং ছিটানো জামদানি শাড়িটি। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই তাকে দেখতে চাই কোঁকড়ানো চুল, মায়া জড়ানো আঁখিপল্লব, পরনে জিনস টি-শার্ট। যদিও আমার প্ল্যান ছিল দুই-তিন রঙের সুতো দিয়ে বুনন করা পাঞ্জাবি পরেই তাকে আসতে বলব কিন্তু বন্ধুটি আমার খুব হালকা আর আরামদায়ক পোশাকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। নকশি পাঞ্জাবি শুধুই অনুষ্ঠানে।

দেখাদেখি শেষে তূর্ণা নিশিথায় সরাসরি জন্মস্থান সুহিলপুরে, তিতাস পাড়েই সে বাড়ি। একটু মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতেই চোখে পড়বে মধু আর রস মিঠাইয়ে ভরা আম্রকানন। ঠিক মায়ের আদর দিয়ে ঘেরা। কী এক শীতল মায়াবী পরশ। পুরো গ্রামটি যেন একটি বাড়ি। বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই ছুটে আসবে তন্বী, তাসমিন, প্রিয়তি। সবার সঙ্গে শুরু হবে গলায় ঝোলাঝুলি করে ভাব বিনিময়। নথ ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আসবে পুঁতির মা। কয় বছরের জমানো কষ্টের থোকা থোকা বৃষ্টি গড়িয়ে পড়বে লাল আর ক্লান্ত গাল বেয়ে। বড় মামি ছুটে আসবেন, শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছবেন আমার। অন্তরে কষ্টের দাগগুলো ততক্ষণে অস্পষ্ট হতে শুরু করবে।' এক রঙা পুরির জীবনের গল্প জমতে শুরু করবে মন উঠোনে। গায়ের রং মলিন হওয়ার পুরোনো গল্পটি কাঁচা হলুদ রং ঢেলে কতটুকু ধলা করা যায়! ফুল পাখি প্রিয় কানন অচেনা হয়েছে বারবার কার কারণে? কার ইশারায়! জীবনের প্যাঁচ বোঝে না এমন মেয়েও কাঁদে, কষ্ট পায়।
অবশেষে স্বপ্নের ঘরে ফেরা। বৃষ্টি এলেই ভিজব দুজন। মনের বারান্দায় দিব্যি হংসের দল, কটি ঘাসফড়িং আর শিউলি-চামেলিরা ওড়াবে নৃত্য কেতন—এক পৌরাণিক-ঘরানায়। সংগত করবে ঘাসফুল। সন্ধ্যা হলেই উঠোনে জমবে গান আর পুথির আসর। ফুল পাখি, বুনো লতা আর কপোতীরা দখল নিবে উঠোনজুড়ে। জারি-সারি ভাটিয়ারিতে তিতাসের পূর্ববর্তী স্রোত বলবে প্রাচীন কিছু গল্পকথা। আমি কলাপাতায় দেব বোরো চালের ভাত আর হালকা মসলা দিয়ে তৈরি কই মাছের ঝোল। সঙ্গে বিন্নি চালের ফিরনি।
অবশেষে মধ্যগগনে চাঁদের হাসি আর মেঘের লুটোপুটি খেলায় ভেসে যাব আমি আর মন পবনের সেই—বাঁশিওয়ালা। বাঁশিওয়ালাও থেমে থাকবে না, বাজবে সুর—বাজবে বাঁশি। আমার অতলান্তিকের নোনা নুড়ির গায়ে যে ব্যথা শক্ত পাথর হয়ে জমেছে—তা অশ্রু হয়ে গড়াবে তিতাসে। ভরা জোছনা আর পঞ্চমীর রাগে আমি ততক্ষণে পৌঁছে যাব বাঁশিওয়ালার মনের বাড়ি—যেখানে বসত করে কিছু ঘাসফড়িং, অনাদি-শস্যকণা, শ্বেত-পায়রা আর একটি বাউল-মন।

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।